ভক্তি আন্দোলনের কারন ও ফলাফল বর্ণনা করো , ভক্ত কবির (১৩৯৮-১৫১৮ খ্রিঃ) , বাংলায় শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিঃ),মীরাবাই ও শংকরদেব, ফলাফল বা প্রভাব বা গুরুত্ব—সমন্বয়বাদী সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষ, নবম শ্রেণী।


ভক্তি আন্দোলন (Bhakti Movement):-

উৎস:-

ঐতিহাসিক গিয়ারসন বলেন, খ্রিস ধর্মের থেকেই ভক্তিবাদের আদর্শ হিন্দুধর্মে এসেছে। অধ্যাপক ইউসুফ হাসান মনে করেন, ইসলামধর্মে আল্লাহের প্রতি যে ভক্তির দৃষ্টান্ত রয়েছে, তার থেকেই ভক্তিবাদের উৎপত্তি।* কেউ বলেন বেদই ভক্তিবাদের উৎস। বিষ্ণুপুরাণ, গীতা, ভাগবৎ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থে ভক্তিভাবের উল্লেখ আছে অনেকে মনে করেন। হিন্দুদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থই ভক্তি আন্দেলনের মূল উৎসস্থল।

ভক্তিবাদের মূল বক্তব্যগুলি হলঃ-


মূল নীতিঃ-

() একেশ্বরবাদে বিশ্বাস।

() যথার্থ ভক্তির দ্বারা ব্যক্তি যােগসাধনায় সফল হতে পারেন।

() সব মানুষই সমান এবং তাঁরা পারস্পরিক। ঘৃণা-দ্বেষ বর্জন করে সামাজিক সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্ব গড়তে পারেন।।

() যথার্থ গুরু ঈশ্বরের ধারণা দিতে পারেন।

() রাম ও কৃ উপাসনা।

() মূর্তিপূজা, পুরােহিতপ্রাধান্য, জাতপাতকে ঘৃণা।

() অন্ধবিশ্বাস, অর্থহীন উপাচার ও জটিল ধর্মীয় রীতিনীতির পরিবর্তে যুক্তিসংগত আচার-আচরণের উপর জোর দেওয়া।

বিভিন্ন ভক্তিবাদী প্রচারক :-

দক্ষিণ ভারতে শংকরাচার্য ও রামানুজঃ-

শংকরাচার্য ‘অদ্বৈতবাদ’ ও রামানুজ (দশম শতক) ‘বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ’-এর দ্বারা দক্ষিণ ভারতে হিন্দুধর্মের পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিলেন। এছাড়া নিম্বার্ক (১১ দশক), মাধবাচার্য (১২ দশক), বেদান্ত দেশিক (১৩ দশক), তেলুগু ব্রাত্মণ বল্লভাচার্য ও কর্ণাটকের মাধবাচার্য অন্যতম প্রচারক ছিলেন। বৌদ্ধধর্মের হাত থেকে হিন্দুধর্মকে রক্ষা করার জন্য জগৎগুরু শংকরাচার্য ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যােশী মঠ, গােবর্ধন মঠ, শূঙ্গেরি মঠ ও সারদা মঠ নির্মাণ করেছিলেন। রামানুজ ১১৬৬ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে জন্মগ্রহণ করেন। দক্ষিণ ভারতে তাঁর বহু অনুগামী রয়েছে। তিনি দক্ষিণ ভারতে ভক্তি আন্দোলনের রূপকার হলেও শৈব নায়নার ও বৈষ্ণব আলবারপন্থীরা যথাক্রমে শিব ও বিষ্মর উপাসনার জন্য মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। দাদু দয়াল ‘পরমব্রত্ম সম্প্রদায়’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ভক্ত কবির (১৩৯৮-১৫১৮ খ্রিঃ) 


উত্তর ভারতে কবির ও রামানন্দঃ-

এলাহাবাদের বাসিন্দা রামানন্দের প্রধান শিষ্য ছিলেন। ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে বারাণসীতে কবিরের জন্ম। আবার কেউ কেউ বলেন ১৪৪০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর জন্ম। সুলতান সিকন্দর লােদির সমসাময়িক বলে অনেকে কবিরকে দাবি করেছেন। তিনি এক বিধবা ব্রাত্মণীর গর্ভজাত অবৈধ সন্তান ছিলেন। তাই তার মা তাঁকে পুকুরপাড়ে ফেলে গেলে নীরু নামে এক নিঃসন্তান মুসলিম তাঁতি (বা জোলা) তাঁকে পালন করেন। তাই ছােটো থেকেই তাঁর মধ্যে হিন্দু ও মুসলিম ভাবধারার সমন্বয় ঘটে। তিনি বলতেন “হিন্দু ও মুসলিম আসলে একই মাটি দিয়ে গড়া দুটি পাত্র। রাম, রহিম, হরি, আল্লা, সাঁই, ঈশ্বর সবই একই পরমেশ্বরের বহুরূপ। মূর্তিপূজা,নামাজ, তীর্থ করে সিদ্ধিলাভ হয় না। অন্তরের ভক্তি ও পবিত্রতাই হল জীবনের লক্ষ্য। তাঁর নীতি ও উপদেশাবলি হিন্দিতে ‘দোঁহা’ নামে সংকলনুগ্রন্থে স্থান পেয়েছে। কবিরের অনুগামীরা ‘কবিরপন্থী’ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিক তারাচাঁদ তাঁর সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “সর্বধর্ম ও সর্ববর্ণ সমন্বয়ে প্রেমের আদর্শ প্রচার করাই কবিরের লক্ষ্য ছিল।” 

পাঞ্জাবে নানকঃ-

শিখধর্মের প্রথম গুরু নানক (১৪৬৯-১৫৩৮ খ্রিঃ) লাহােরের তালবন্দি গ্রামে (বর্তমান নানখানা) ১৪৬৯ খ্রিস্টাব্দে ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুঝেছিলেন যে, মূর্তিপূজা, তীর্থযাত্রা, ধর্মীয় আড়ম্বর করে মােক্ষলাভ হয় না। আধ্যাত্মিক জীবন ও গার্হস্থ্য জীবনের মধ্যে সমন্বয়সাধনই হল তার লক্ষ্য। তিনি বলতেন, সত্যরূপী ভগবানকে আরাধনা করতে। তবে তার আগে 'নাম’ (ভগবানের নামগান), ‘দান’ (জীবসেবা) ও ‘স্থান’ (দেহশুদ্ধি) করা দরকার। জাতপাত, অস্পৃশ্যতা বিরােধী এই ধর্মমত সামাজিক সাম্য রচনায় এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তিনি বলতেন, একে অন্যের ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শিখলে সমাজ ও ধর্মীয় জীবনে। নতুন গতির সার ঘটে। তাঁর শিষ্যরা ‘শিখ’ নামে পরিচিত এবং তাঁর উপদেশগুলি ‘গ্রন্থসাহেব’ বা আদিগ্রন্থে সংকলিত আছে।

বাংলায় শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রিঃ):- 

১৪৮৬ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি মাসে দোল পূর্ণিমার দিন রাতে নদীয়ার নবদ্বীপের এক ব্রাক্ষ্মণ পরিবারে শ্রীচৈতন্যের জন্ম। তাঁর বাল্যনাম ‘বিশ্বম্ভর’, বাবা-মা আদর করে ডাকতেন ‘নিমাই’। গায়ের রং গৌর বা ফর্সা বলে প্রতিবেশীরা ‘গৌরাঙ্গ’ বলেই ডাকতেন। নিমাই-এর মা শচীদেবী এবং বাবা জগন্নাথ মিশ্র। এগারাে বছর বয়সে তিনি পিতৃহারা হয়েছিলেন। পঠনপাঠন শেষ করে মাত্র কুড়ি বছর বয়সে চৈতন্যদেব একটি শ্রীচৈতন্য টোলের অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হন। এইসময় পণ্ডিত কেশব কাশ্মীরিকে তর্কযুদ্ধে হারিয়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাইশ বছর বয়সে ঈশ্বরপুরীর। কাছে তিনি কৃষ্ণুমন্ত্রে দীক্ষা নেন। চৰ্বিশ বছর বয়সে নিমাই পত্নী বিষ্ণুপ্রিয়াকে ত্যাগ। করে সন্ন্যাসী হন এবং নাম হয় ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’। শেষ চব্বিশ বছর তিনি ধর্মপ্রচারে কাটিয়েছিলেন। তিনি বলতেন, “তৃণাদপি সুনীচেন তরােরপি সহিষ্ণুনা। অমানীনা মানদেন কীর্তনীয়া সদা হরি”। বিমানবিহারী মজুমদার বলেন, ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই মাত্র। আটচল্লিশ বছর বয়সে পুরীধামেই তার অকালপ্রয়াণ ঘটে।

মীরাবাই ও শংকরদেবঃ-

আনুমানিক ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে যােধপুরের কুড়কি গ্রামে মীরাবাই-এর জন্ম এবং মৃত্যু  ১৫৬৩-৭৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কোনাে একসময়ে। ঐতিহাসিক কর্নেল টড বলেন, আকবরের সমসাময়িক রানা কুম্ভের পত্নী ছিলেন মীরাবাই। কেউ বলেন, রানা সংগ্রাম সিংহের পুত্র শিশােদিও রাজা ভােজরাজ তাঁর স্বামী। অনেকে তাকে আকবর,ভক্তমাল ও রূপ গােস্বামীর সমসাময়িক বলে মন্তব্য করেছেন। মীরাবাই গৃহবধূ হলেও শেষপর্যন্ত রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে মথুরা ও বৃন্দাবনে চলে আসেন। এখানে রধারীলাল শ্রীকৃষ্ণের প্রেমে বিভাের হয়ে নামগানে মেতে ওঠেন। আসামের ব্রহ্মপুএ উপত্যকায় শংকরদেব (১৪৪৯-১৫৬৮) ভক্তিধর্ম প্রচার করেছিলেন।                         

ফলাফল বা প্রভাব বা গুরুত্ব—সমন্বয়বাদী সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষঃ- 

ভক্তিবাদ ভারতীয় সমাজ, ধর্মীয় জীবন, রাজনীতি, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল।

প্রথমত, ভক্তিবাদের প্রভাবে সাহিত্যে কবিরের ‘দোঁহা’, নানকের ‘গ্রন্থসাহেব', কৃষ্ণদাস। কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’, বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থ ছাড়াও বহু আঞ্চলিক ভাষায় সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল।

দ্বিতীয়ত, সমাজে নারী-পুরুষ, উচ্চনীচ ভেদাভেদ অনেক। কমে। মধ্যযুগীয় অসূর্যম্পশ্যা নারীরা ধর্মীয় ও সামাজিক স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করে।

তৃতীয়ত, ধর্মীয় জটিলতা ও বাহ্যিক আড়ম্বর অনেকটা দূর হয়। ফলে ধর্ম সকলের জন্য উন্মুক্ত হয়। মূর্তিপূজা, পুরােহিত প্রাধান্য ইত্যাদি কমে যায়।

চতুর্থত, ভক্তিবাদী নেতাদের প্রভাবে হিন্দুধর্মে উদার ও ভাতৃত্বের ভাব গৃহীত হয়েছিল। নিম্নবর্ণের হিন্দু ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনা অনেক কমে।

পঞ্চমত, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতিসাধনে ভক্তিবাদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ