চিত্রকলা, স্থাপত্য ও সাহিত্য (Painting. Architecture and Literature):-
সুলতানি ও মােগল যুগে চিত্রশিল্প, স্থাপত্য ও সাহিত্য চরম উন্নতি লাভ করে। মূলত রাজানুকুল্যে সংস্কৃতির এইসব অঙ্গনে নবজাগরণ এসেছিল। এক্ষেত্রে সমন্বয়ধর্মীতা মূল। বৈশিষ্ট্যরূপে ফুটে উঠেছিল। তাই এই যুগের চিত্র, স্থাপত্য ও সাহিত্যে কেবল মুসলিম। সংস্কৃতির ছাপ ছিল না ; অন্য বর্ণ ও সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি সমান তালে এগিয়েছিল। মােগল যুগের আকবর ও জাহাঙ্গির চিত্রকলা, স্থাপত্য ও সাহিত্যের গভীর অনুরাগী ছিলেন।
চিত্রশিল্প (Painting):-
সুলতানি যুগে সুনিশ্চিত কোনাে চিত্র ও চিত্র দ্বারা সুসজ্জিত পাণ্ডুলিপি আজও পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। সম্ভবত দিল্লির সুলতানরা চিত্রশিল্প বা পাণ্ডুলিপিতে চিত্রাঙ্কন ব্যবস্থাকে বিশেষ উৎসাহ দেখাননি। তবে আমির খসরু, মৌলানা দাউদ, সামই-সিরাজ-আফিফের প্রমুখ পণ্ডিতদের লেখনীতে দেয়ালচিত্র ও নানা চিত্রকরের নাম উল্লেখ রয়েছে। তবে তুর্কো-আফগান যুগে এ ব্যাপারে সুলতানদের দারুণ। উৎসাহ ছিল। তাঁরা পারস্য ও ইরাক থেকে বহু চিত্রাঙ্কিত পাণ্ডুলিপি আনিয়েছিলেন।
সুলতানি আমলের চিত্রকলা ও সমন্বয়ধর্মীতাঃ-
গুজরাট, জৌনপুর, মালব, মাণ্ডু ও আহমেদাবাদে বহু জৈনমন্দির সংলগ্ন 'জ্ঞানভাণ্ডারে’ (গ্রন্থাগার) পঞ্চদশ ও ষােড়শ শতকের বহু অঙ্কিত চিত্র আছে। তবে ত্রয়ােদশ শতকে গুজরাটে চিত্র অঙ্কন ও রং-এর ব্যবহারে বিপ্লবের সূচনা হয়। চতুর্দশ শতকে ‘কল্পসূত্র কালকাচার্য কথা’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির চিত্রগুলােতে শিল্পীর দ্বিধাগ্রস্ততা লক্ষ করা যায়। গ্রন্থটি মুম্বাই-এর ‘প্রিন্স অব ওয়েলস মিউজিয়ামে’ ও ‘দিল্লির ন্যাশনাল মিউজিয়াম’ এ সংরক্ষিত আছে। মেওয়ারের দেলবাদের ‘সুপাসনাহ্ চারিয়াম’ (১৪১৩ খিঃ), মাণ্ড, ‘কল্পসুত্র’ (১৪২৫ খ্রিঃ) থেকে সেখানকার চিত্রশিল্পের পরিচয় মেলে। ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে আমেদাবাদের চিত্রগুলিতে পারস্য শিল্পরীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল। ১৪৫১ খ্রিস্টাব্দে আমেদাবাদে আঁকা ‘বসন্তবিলাস’-এর পাণ্ডুলিপিতে মােঙ্গল শিল্পরীতির প্রভাব ছিল।
আমেদাবাদ মাণ্ড ও জৌনপুরে সুলতানরা পরিবর্তিত চিত্রশিল্পের প্রভাব থেকে নিজেদের মুক্ত করতে পারেননি। মাণ্ডুতে এরূপ ৪টি শিল্প ও চিত্রসংবলিত পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল ‘নিমনামা’ (রন্ধনশিল্পের উপর লেখা গ্রন্থ)। গ্রন্থটির প্রচ্ছদে গিয়াসুদ্দিন খলজির পুত্র নাসিরুদ্দিনের নাম ও বহু ছবি রয়েছে। জৈনশিল্পকলা এখানে প্রাধান্য পেলেও মাণ্ডুর সুলতানের দরবারের চিত্রটি পারস্যরীতিতে আঁকা। অনুরূপ প্রভাব মিফতা-উল ফুজলার ‘অভিধান', হাজি মােহম্মদের ‘বুস্তান', আজাইব-উস-সানতি ও আনােয়ার ইসুহেইলির পাণ্ডুলিপিয়ে লক্ষ করা যায়। অযােধ্যার ‘গাথা মৃগবতী’-কে কেন্দ্র করে কুতবন সুলতান হােসেইন শাহ্ সরক্কির শাসনকালে (১৪৫৮-১৪৭৯) রচিত, পাণ্ডলিপিতে বহু চিত্র রয়েছে। ‘খামসা-ই-আমির খসরু’, ‘হামজা নামা’, শাহনামা-তুতিনামা’ ও ‘সিকন্দারনামাইবারি’ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপিতে সুলতানি যুগের বহু চিত্র আছে।
মােগল চিত্রকলা ও সমন্বয়ের প্রতিফলনঃ-
মােগলযুগের আগে পূর্ব ও পশ্চিম ভারতে চিত্রশিল্পের প্রচলন ছিল। বাবর চিত্রশিল্পের পৃষ্ঠপােষক হলেও তা ছিল ক্ষুদ্রাকতির। প্রাকতিক দৃশ্য, যুদ্ধের কাহিনি বা রাজসভার বর্ণনার মধ্যে চিত্রশিল্পের স্থান ছিল। ভারতের প্রাদেশিক শাসকরাও নিজ নিজ উদ্যোগে মালব, জৌনপুর, গুজরাট, রাজপুতানা, পাঞ্জাব, দক্ষিণ, উত্তর ও পশ্চিম ভারতে চিত্রকলার উন্নতি ঘটিয়েছিল। হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন ও মুসলিম চিত্রকলার সমন্বয়ে মােগল চিত্রকলা নতুন ও বিস্ময়কর।
বাবরের শাসনকালে (১৫২৬-৩০) তুর্কো-আফগান শক্তিকে দমন করতে গিয়ে চিত্রশিল্পের প্রতি বিশেষ নজর দিতে পারেননি। তবে চিত্রকলার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ ছিল। প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হলেন হুমায়ুন। চিত্রশিল্পের বিরােধী পারস্যরাজ শাহ ওহ্মাম্প তাঁর দুই বিখ্যাত চিত্রকর মির সৈয়দ আলি ও আবদুল সামাদকে তাড়িয়ে দিলে হুমায়ুন তাঁদের কাবুলে আশ্রয়। দেন এবং আকবরের চিত্রশিক্ষক নিয়ােগ করেন। হিরাটের শাসক হােসায়ন মির্জার চিত্রকর বিহ্জাদ (১৪৫০-১৫৩৬)-এর শিল্পধারাকে তাঁরা অনুকরণ করেছিলেন। ওই সময়কার আর এক শিল্পী আবদুস সামাদ-এর আঁকা কিছু ছবি তেহ্রানের গুলিস্তানের রাজদরবারে আছে। এই চিত্রগুলি জাহাঙ্গিরের সংগৃহীত ‘গুলসান আলেখ্য কবিতা’তে রয়েছে। মােগ, চিত্রশালার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আকবরের শিক্ষক আবদুস সামাদ ও সৈয়দ আলি। এই চিত্রশালার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি হল ‘দাস্তান-ই-আমির-হজম’ বা ‘হামজা-নামা বা হজমনামা’ (১৫৬৭)। বৃহদাকার ১০০৪ পাতার (বারাে খণ্ড) এই বইতে প্রায় ১২০০ চিত্র সংরক্ষিত ছিল। বর্তমান এই চিত্রের কিছু-কিছু ভিয়েনার ‘মিউজিয়াম অব ইন্ডাসট্রিয়াল আর্ট’ (Museum of Industrial Art) ও লন্ডনের ‘ভিক্টোরিয়া’, ‘অ্যালবার্ট’ ও ‘ব্রিটিশ মিউজিয়ামে’ দেখা যায়। বাউনি, শাহনওয়াজ খান ও আবুল ফজলের লেখায় হজমনামার শিল্পীদের পরিচয় আছে। শাহনওয়াজ খান বলেন, “আকবরের নির্দেশে মির সৈয়দ আলি ও আবদুস। সামাদের তত্ত্বাবধানে পঞ্চাশজন চিত্রকর পনেরাে বছর ধরে বহু ছবি আঁকেন”। 'নফেইসউল-মাসির’ গ্রন্থে আলাউদ-দ্দৌলা কাজবিনি একই কথা বলেছেন। তবে তিনি হুমায়ুনকে। হজমনামার প্রকত প্রতিষ্ঠাতা বলেছেন। ১৫৬৮ খ্রিস্টাব্দে আশিকোর ও ১৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আনােয়ার ই-সহেইলি ও তিলসামের পাণ্ডলিপিতে বহু চিত্র ও রাশিচক্রের ছবি আছে। পুষ্প,বৃক্ষ, গুল্ম, পাখির বহু চিত্র রয়েছে এখানে। এগুলির মধ্যে অনেক চিত্র ‘লন্ডন স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ’-এ আছে। “ক্লিভল্যান্ড মিউজিয়াম অব আর্ট’ (leveland Museum of Art)-এ তুতিনামার উন্নত চিত্রশিল্পগুলি আছে। আবুল ফজল আকবরের যে প্রধান পনেরােজন শিল্পীর নাম লিখেছিলেন তা হল কেশব, মহেশ, মিশকিন WIShkin), দসওয়ানথ বা দশবন্দ, লাল, বসাওয়ান, মুকুন্দ, কারুক, মধু, ক্ষেমাচরণ, জনান,তারা, রাম হরিবনস, সানওয়ালা ও ফারুক। তাঁদের আঁকা চিত্র ‘কলকাতার ভারতীয় মিউজিয়াম’, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফগ মিউজিয়াম’ (Fogg Museum), পাটনার ‘খুন্ডাবাজ ওরিয়েন্টাল লাইব্রেরি ও অক্সফোর্ডের বােডলিয়ান গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত আছে। বেনারসেদ কলাভবনে ও দিল্লির জাতীয় জাদুঘরে এ যুগের বহু চিত্র রয়েছে।
জাহাঙ্গিরের সময় চিত্রশিল্পে অসামান্য উন্নতি ঘটেছিল। প্রায় পঞ্চাশজন চিত্রশিল্পী তাঁর পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেছিল। পূর্ণ অবয়ব আঁকার ক্ষেত্রে এইসময় যাঁরা পারদর্শিতা দেখান তাঁদের মধ্যে বিষেনদাস, মনােহর, নানহা, আবুল হাসান, ফারুকবেগ, হাসিম, দৌলত, মনসুর অন্যতম ছিলেন। প্রাকৃতিক দৃশ্য, পশুপাখি, বক্ষ লতাপাতা ইত্যাদি অঙ্কনে বিচিত্র রং ও রেখায় অনুপম সৌন্দর্য লাভ করে। তাই জাহাঙ্গির ওস্তাদ মনসুরকে ‘নাদির অল-অসর’ ও আবুল হাসানকে ‘নাদির-উস-জামান’ উপাধি দিয়েছিলেন। শাহজাহান নাদির সমরকান্দিকে চিত্রকররূপে প্রথমে নিয়ােগ করলেও পরে তিনি চিত্রকলা অপেক্ষা স্থাপত্যশিল্পে আকৃষ্ট হন। ঔরঙ্গজেব চিত্রশিল্পের ঘাের বিরােধী ছিলেন। ফলে বহু চিত্রকর কর্মহীন হয়ে পড়েন।
স্থাপত্য (Architecture):
সুলতানি স্থাপত্যঃ-
দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধের (১১৯২ খ্রিঃ) পর মহম্মদ ঘােরির সেনাপতি কুতবউদ্দিন-আইবক দিল্লি জয়কে (১৯৯৬) স্মরণীয় করতে প্রথম মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শনরূপে ‘কোয়াত উল ইসলাম মসজিদটি’ তৈরি করেন। অনেকে একে হিন্দু মন্দিরের উপর তৈরি বলে মনে করেন। ঐতিহাসিক পার্শি ব্রাউন বলেন, “মসজিদটি দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই।”* কুতুবউদ্দিনের জামাতা ইলতুৎমিস ১২৫ ফুট উঁচু দিল্লির কুতবমিনারটি তৈরি করেন। ফিরােজ তুঘলকের সময় - কুতুবমিনারে বাজ পড়ে এর অনেক ক্ষতি হয়। পণ্ডিত ফারগুসন বলেন, “কুতুবমিনার পৃথিবীর সর্বোত্তম মিনার।
” স্যার জন মার্শালও কুতবমিনারের একনিষ্ঠ গুণগ্রাহী ছিলেন। এছাড়া আজমিরের ‘আড়াই-দিনকা ঝােপড়া', ‘নাসির উদ্দিনের স্মৃতিসৌধ, মালকাপুরের ‘সুলতান ঘারি’ ‘কুতব-অল-মসজিদ’, বদাউনের 'হাউজইশামসি’, 'সামনি ইদগা’, ‘জামি মসজিদ’, রাজস্থানের যােধপুরের 'আর্কিনকাদরওয়াজা' অন্যতম স্থাপত্যকীর্তি। বলবনের সময়ে কিলা-ই-রায় পিথৌরার দক্ষিণ-পূর্বে তাঁর স্মৃতিসৌধ। নির্মিত হয়। আলাউদ্দিনের আমলে তৈরি হয় ‘আলাইদরওয়াজা’, ‘সিরি নগরী’, ‘হাউসই-আলাই’, ‘জামাৎখানা মসজিদ’, ভরতপুরের বায়নার ‘উমা মসজিদ’ ইত্যাদি।
ইলিয়াস শাহি ও হুসেন শাহ্ যুগের স্থাপত্যঃ-
সিকান্দার শাহের সময় মালদহে পাণ্ডুয়ার বিখ্যাত আদিনা মসজিদটি ১৩৬৮ খ্রিঃ তৈরি হয়। দামাস্কাসের মসজিদের অনুকরণে এই মসজিদটি তৈরি করতে কুড়ি বছর সময় লাগে। হােসেন শাহের রাজত্বকালে গৌড়ের ‘ছােটো সােনা মসজিদ’, নসরৎ শাহের বড়াে সােনা মসজিদ’, ‘কদম বসলভবন’ (১৫৩১) নির্মিত হয়। রাজাদের সােনা, রুপা ও তামার নানাপ্রকার মুদ্রা থেকে
mainly a patchwork of older materials, beautiful in detail...but as a whole a confused and somewhat incongruous improvisation".
ইতিহাসের বহু তথ্য জানা যায়। স্যার স্ট্যানলি লেনপুল মুদ্রার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে দিয়েছেন।* স্থাপত্য নিদর্শনগুলির মধ্যে ‘আলাই দরওয়াজা, কুতুবমিনার,আদিনা মসজিদ’ ইত্যাদি উল্লেখ্য।
মােগল স্থাপত্যঃ-
বাবর তাঁর চার বছর রাজত্বে আগ্রার ‘লােদি দুর্গ’, পানিপথের ‘কাবুলি বাগ সজিদ’, ‘রােহিলখণ্ডের জামই-মসজিদ’ ছাড়াও বহু মিনার, অট্টালিকা, শিক্ষায়তন আগ্রা, ফতেপুর, চোলপুর, কিউলে, গােয়ালিয়র প্রভৃতি স্থানে তৈরি করেছিলেন। শেরশাহ তাঁর পাঁচ বছর রাজত্বে দিল্লির ‘পুরানা কিল্লা, সাসারামের সমাধি’ ও বহু প্রাসাদ, অট্টালিকা ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন। শিল্পক্ষেত্রে তিনি হিন্দু, মুসলিম, জৈন, বৌদ্ধ ও পারসিক শিল্পরীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়েছিলেন। হুমায়ুনের সময়ে কয়েকটি সৌধ ও দুটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। আকবরের আমলে ‘ফতেপুর সিক্রির ইবাদৎখানা’, ‘হুমায়ুনের সৌধ’, ‘দেওয়ানইআম’, ‘দেওয়ান-ই-খাস’, ‘আগ্রা দুর্গ’, ‘জাম-ই-মসজিদ’, বুলন্দ দরওয়াজা’, ‘যােধাবাই প্রাসাদ’, ‘পাঁচ মহল’ ও ‘সেকেন্দার আকবরের সমাধি’ ইত্যাদি আশ্চর্য কীর্তি তৈরি হয়। জাহাঙ্গির তাঁর পত্নী নুরজাহানের পিতা ইতিমাদ-উদ-দৌল্লার সুন্দর সমাধিসৌধটি নির্মাণ করান। এছাড়া আকবরের সমাধির নির্মাণকার্য তিনি শেষ করেছিলেন। শাহজাহানকে ঐতিহাসিকরা স্থাপত্যকীর্তির জন্যই মূলত ‘Engineer King' ও ‘Prince builder| বলেছেন। তিনি আগ্রার ‘দেওয়ানই-আম’, ‘দেওয়ানই-খাস’, ‘শিশমহল’, ‘খাসমহল’, ‘মােতি মসজিদ’, ‘জামা মসজিদ’ (সবচেয়ে বড়াে মসজিদ), লালকেল্লা’, আগ্রার তাজমহল’ (থপতি—ঈশা খাঁ), ময়ূর সিংহাসন’ (থপতি—বেবাদল খাঁ) ইত্যাদি নির্মাণ করেছিলেন। ঔরঙ্গজেব স্থাপত্যশিল্পের বিরােধী ছিলেন।
সাহিত্য (Literature):
সুলতানি যুগের সাহিত্যঃ-
এইসব রচনার মধ্যে নিরপেক্ষতার যথেষ্ট অভাব আছে। মিনহাজউদ্দিন ১২৬০ খ্রিঃ তাঁর ‘তবকৎ-ই-নাসিরি’ গ্রন্থে মহম্মদ ঘােরির বিজয় অভিযান ও গিয়াসুদ্দিন বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শের উল্লেখ করেছেন। ‘হিন্দুস্থানের তােতাপাখি’ নামে পরিচিত কবি আমির খসরু মােট ছয়টি গ্রন্থ রচনা করেন—‘খাজাইন-উল-ফুতুহ’, মুফ-উল-ফৎ, মুতা-উল-ফুতুহা’, ‘কিরান-উসাদিন’, ‘তুঘলকনামা’, ‘আসিক। এইসব গ্রন্থে জালালউদ্দিন খলজি থেকে বিন-তুঘলক পর্যন্ত সকলের কথা লেখা আছে। ১২৯০-১৩৩৫ খ্রিঃ পর্যন্ত দিল্লির সুলতানি ইতিহাস জানতে আমির খসরুর গ্রন্থগুলি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মহম্মদ-বিন-তুঘলকের বন্ধু জিয়াউদ্দিন বরনি তারিখ-ই-ফিরােজশাহি’ ও ‘ফতােয়া-ই-জাহান্দরি’ গ্রন্থদুটি রচনা করেন। শামসইসরাজ আফিফের তারিখ-ই-ফিরােজশাহি’ থেকে ফিরােজ তুঘলক সম্পর্কে জানা যায়। ‘খাজা আবু মালিক ইসামির 'ফুতুহ্-উস্-সালাতিন’ এবং আবু নাসের বিন উৎবির ‘কিতাবউলইয়ামিনি’ গ্রন্থ থেকে গজনির সুলতান মামুদ-এর সময় থেকে বিন-তুঘলকের সময়
We may look upon Muhammadan coins as the surest foundation for an exact history of the dynasties by which they were issued".
পর্যন্ত সমস্ত ঘটনার কথা জানা যায়। এক অজ্ঞাতনামা লেখকের ১৩৭০ খ্রিঃ লেখা ‘সিরাৎ-, ই-ফিরােজশাহি’ গ্রন্থ ফিরােজ তুঘলক সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। এছাড়া কবিয়ে দোহা’, নানকের ‘গ্রন্থসাহেব’, ‘মঙ্গলকাব্য’ ইত্যাদি আঞ্চলিক সাহিত্য থেকেও অৈ কথা জানা যায়। এরপ্রগড় (Errapragada)-এর তেলুগু রামায়ণ ও ভিল্লিপুওুর তামিল মহাভারত ‘ভারতম্’ উল্লেখ রচনা।
আলবেনির বিবরণীঃ-
৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে আবুরৈহান মহম্মদ ইবন আহম্মদ আলবেরুনির জন্ম। তাঁর জীবনকাল ৯৭৩-১০৪৮ খ্রিস্টাব্দ | ভারত ভ্রমণ সংক্রান্ত আলবেনি, বিখ্যাত গ্রন্থ 'তহকক-ই-হিন্দ’ ১০৩০ খ্রিস্টাব্দে রচিত হয় আরবিতে রচিত এই গ্রন্থটি। চলিত নাম ‘কিতাব-উল-হিন্দ’। 'তহ্কক্-ই-হিন্দ’-এর বাংলা অর্থ হল— “বুদ্ধি বিচারে যা গ্রহণযােগ্য এবং যা গ্রহণযােগ্য নয় তার পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দুদের চিন্তার বিশ্লেষণমূলক বর্ণনা”। এই তহকক-ই-হিন্দ’ গ্রন্থে মােট ৭৬টি অধ্যায়ের বিষয়বস্তুগুলি ৮টি ভাগে বিভক্ত। এই আটটি ভাগ হল—
(১) সামাজিক রীতিনীতির বিশ্বাস,
(২) হিন্দুদর্শন,
(৩) আইন,
(৪) সাহিত্য,
(৫) ব্যাবহারিক বিজ্ঞান-প্রকৃতিবিজ্ঞান, গণিত ও জ্যোতিষবিদ্যা,
(৬) ভূতত্ত্ব সংক্রান্ত বিদ্যা,
(৭) ধর্ম, পূজা উপাচার ও দেবতা এবং বিবিধ বিষয়। আলবেনি তাঁর বিবরণীতে নারীকে স্ত্রীধন’, শূদ্রদের ‘অচ্ছুত’ ও ‘ব্রাত্মণদের দাম্ভিক পণ্ডিত বলেছেন। তথ্যসমৃদ্ধ আলবেরুনির এই বিবরণীকে ‘ভারতকোশ’ বলা হয়।
ত্রয়ােদশ শতকে ভারত-চিন ঘুরে ইটালির পর্যটক মার্কোপােলাে তাঁর ‘স্মৃতিকথাতে’ বহু তথ্য লিখেছেন। আফ্রিকার মরক্কোর জাঞ্জিবারের পর্যটক ইবন বতুতা ১৩৩৩-১৩৪২ খ্রিঃ পর্যন্ত মহম্মদ-বিন-তুঘলকের ‘কাজি’ পদে নিযুক্ত হন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবউর-রাহেলাব’ (Kitab-ur-Rahlab) থেকে বিন-তুঘলক সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়।
মােগল যুগের সাহিত্যঃ-
ইতিহাস সাহিত্য, অনুবাদ সাহিত্য ও কাব্য—এই তিন ধরনের সাহিত্য মূলত ফারসি, হিন্দি ও বাংলা ভাষাতে রচিত হয়েছিল। ফারসি ভাষায় রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে । বাবরের লেখা ‘বাবরনামা', হুমায়ুনের কন্যা গুলবদন বেগমের ‘হুমায়ুননামা’, জাহাঙ্গিরের রচিত ‘তুজুক-ই-জাহাঙ্গিরি’, ঐতিহাসিক আবুল ফজলের ‘আকবরনামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরি’,আব্বাস সেরওয়ানির ‘তারিখই-শেরশাহি’, বাউনির মন্তাখাব- উল-তােতায়ারিক, মােল্লা দাউদের ‘তারিখ-ই-আলাফি’, নিজামউদ্দিন আহমেদ বখশির ‘তবাক-ই-আকবরি’, এনায়েত আলি খাঁর ‘শাহজাহাননামা’ আবদুল হামিদ লাহােরির ‘পাদশাহনামা', ফেরিস্তার ‘তারিখ-ই-ফিরিস্তা’, মির্জা মহম্মদ কাজিমের আলমগিরনামা’, ভীমসেনের ‘নকস্-ই-দিলখুসা'। দারা শিকোহ রচিত ‘মাজমা উল বাহরাইন’ (দুই সমুদ্রের মিলন) অন্যতম।
আঞ্চলিক ভাষা—বাংলা,হিন্দি ও আঞ্চলিক সাহিত্যঃ-
হিন্দি ভাষায় বীরবলের কবিতা, তুলসীদাসের ‘রামচরিত মানস’, আবদুর রহিম খান খানানের ‘দোঁহা’, মীরার ‘ভজন’, আমির খসরুর প্রণয়ধর্মী রচনা ‘আশিক’ ও ‘লায়লা মজনু', সুরদাসের ‘দোঁহা’ হিন্দি সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ সম্ভার। বাংলা সাহিত্যের মধ্যে কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’, বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’, জয়ানন্দ ও ত্রিলােচন দাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’, কাশীরাম দাসের ‘মহাভারত’,রূপ গােস্বামীর ‘ললিত মাধব’ ও ‘বিদগ্ধ মাধব’ গ্রন্থ মুকুন্দরাম চকবর্তীর ‘কবিকঙ্কণ চণ্ডী’,হরিহর চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর’ ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। বাংলায় রামপ্রসাদের 'শাকগীতি', ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’, ‘বিদ্যাসুন্দর কাব্য' ইত্যাদি কালজয়ী সৃষ্টি ছিল।
সংগীত সাহিত্যঃ-
বাবর ও হুমায়ুন এঁরা দুজনেই সংগীতপ্রিয় ছিলেন। আকবরের রাজসভায় ৩৬ জন সংগীতশিল্পীর মধ্যে তানসেন, বৈজিবাওরা, রামদাস, সুরদাস প্রভৃতি প্রধান ছিলেন। মেঘমল্লার, তােড়ি, সরঙ্গ প্রভৃতি রাগ-রাগিণী এবং কাড়া-নাকাড়া, তবলা প্রভৃতি এযুগের আবিষ্কার ছিল। সম্রাট জাহাঙ্গির তাে “দিনরাত্রি গায়ক ও নর্তকী পরিবেষ্টিত থাকতেন।” তিনি বহু হিন্দি গান রচনা করেছিলেন। শাহজাহান নিজেই সুগায়ক ও গীতিকার ছিলেন। তাঁর দরবারে প্রত্যহ সন্ধ্যায় মেহ্ফিলে আসর বসত।
0 মন্তব্যসমূহ