মােগল বণিকদের কয়ভাগে ভাগ করা হয়? ‘বানজারা’ কাদের বলে ? মােগলদের উপকুল বাণিজ্যের পরিচয় দাও। মােগল আমলের কয়েকটি বাণিজ্যপথ উল্লেখ করাে। এই যুগের আন্তর্বাণিজ্য সম্পর্কে লেখাে। মােগল আমলের শিল্প ও বাণিজ্য সম্বন্ধে লেখাে। উপকুল বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য, বাণিজ্যের শ্রেণিবিভাগ এবং সড়কপথ ও বাণিজ্যকেন্দ্র, নবম শ্রেণী

মােগল বণিকদের কয়ভাগে ভাগ করা হয়? ‘বানজারা’ কাদের বলে ? মােগলদের উপকুল বাণিজ্যের পরিচয় দাও?  বা,

মােগল আমলের কয়েকটি বাণিজ্যপথ উল্লেখ করাে। এই যুগের আন্তর্বাণিজ্য সম্পর্কে লেখাে।  বা, 

মােগল আমলের শিল্প ও বাণিজ্য সম্বন্ধে লেখাে।



মােগল ভারতে বাণিজ্যের প্রসার ও শিল্পের বিকাশ (Spread of Trade and growth of Industries in the Mughal India):-


মােগল যুগের অর্থনৈতিক অবস্থা। সম্পর্কে জানতে সমকালীন ইউরােপীয় পর্যটকদের বিবরণী এবং পারসিক সাহিত্য ও আঞ্চলিক সাহিত্য বিশেষভাবে সাহায্য করে। মানুচি বলতেন “বাংলা রেশমের প্রধান ভাণ্ডার ছিল।” মােগল বাণিজ্য বৃদ্ধির কারণগুলি হল—ক) শাসননীতি ছিল বণিক ও বাণিজ্যের অনুকুলে। কোনাে জবরদস্তি হস্তক্ষেপ বা ট্যাক্সের বাড়াবাড়ি ছিল না) (খ) অভ্যন্তরীণ শান্তি ও নিরাপত্তা বাণিজ্য বৃদ্ধির একটা বড়াে কারণ, কৃষি ও বাজারে যে বৈচিত্র্য। ছিল তা বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল মােগল বাণিজ্য আইন, মুদ্রাব্যবস্থা ও। ব্যাংক এক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। এছাড়া উন্নত পথঘাট, ডাচ ও পাের্তুগিজ বণিকদের আগমন এবং কর্মচারীদের বেতনরুপে অর্থ প্রদান তাদের ক্রয় ক্ষমতা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

বাণিজ্যঃ-

মােগল যুগে ৪টি শ্রেণিতে বণিকদের ভাগ করা হয়েছিল—

(১) ইউরােপীয় বণিক,

(২) ভারতীয় রপ্তানি বণিক,

(৩) অন্তর্বাণিজ্যে নিযুক্ত ভারতীয় বণিক ও

(৪) স্থানীয় ব্যবসায়ী। গুজরাটি হিন্দু বণিকরা সবচেয়ে অবস্থাপন্ন ছিলেন।

বণিক সম্প্রদায়:-

অঞ্চলভেদে বণিকদের বিভিন্ন নাম ছিল—লােহানাক্ষত্রি

বণিক (সিন্ধু ও পাঞ্জাবে), পারসি বণিক (পশ্চিম ভারতে), মাড়ােয়ারি ও আর্মানি বণিক (পূর্ব ভারতে), কোমতি (অন্ত্রে), বােহ্‌রা, খােজা মেনন বণিক (গুজরাটে), চেট্টিয়ার বণিক (মাদ্রাজে) প্রভৃতি। তবে বানজারা বণিক (চাল, গম, চিনি প্রভৃতির ভ্রম্যমাণ ব্যবসায়ী), দশানামি ও ফেরিওয়ালা বণিকশ্রেণির অস্তিত্ব ছিল।

মােগল আমলের ব্যাবসা-বাণিজ্যঃ-

মােগলযুগের বাণিজ্যকে তিন ভাগে ভাগ করা। যায় : (ক) স্থানীয় বাণিজ্য, (খ) অন্তর্বাণিজ্য ও উপকূল বাণিজ্য এবং (গ) বহির্বাণিজ্য। গ্রামেগঞ্জের হাটে-বাজারে স্থানীয় বাণিজ্য প্রয়ােজনভিত্তিক চাহিদার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছিল। দেশের অভ্যন্তরে অসংখ্য রাস্তাঘাট ও নদীপথে বাণিজ্যের অন্তর্বাণিজ্য ও উপকূল বাণিজ্য চলত। 

বাণিজ্যের শ্রেণিবিভাগ এবং সড়কপথ ও বাণিজ্যকেন্দ্রঃ-


এই প্রধান কেন্দ্রগুলি হল—আগ্রা, লাহাের, মুলতান ও গুজরাট। সােনারগাঁও থেকে লাহাের, আগ্রা থেকে বুরহানপুর, আগ্রা-দিল্লি থেকে রাজপুতানা হয়ে গুজরাটের সুরাট পর্যন্ত বিস্তৃত সড়কপথগুলির বাণিজ্যিক গুরুত্ব অপরিসীম। রাস্তায় কোতােয়াল, ফৌজদার প্রভৃতি পাহারাদার নিযুক্ত ছিল। সিন্ধুদের লাহাের ও মুলতান ছিল বড়াে নদীবন্দর। গঙ্গার তীরে সপ্তগ্রাম, পাটনা, এলাহাবাদ, বারাণসী এবং যমুনার তীরে আগ্রা বন্দর ছিল বিখ্যাত। প্রায় ৩/৪ শত টন মাল নিয়ে বড়াে নৌকা বা জাহাজগুলি ঢাকা, শ্রীপুর, কলকাতা, হুগলি, দিল্লি, লাহাের, আগ্রা, সুরাট, আলকণ্ড (হিরের জন্য বিখ্যাত) প্রভৃতি বাণিজ্যকেন্দ্রে যাতায়াত করত। 

অন্তর্বাণিজ্যঃ-


উপকল বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাংলার সপ্তগ্রাম বন্দর দিয়ে মালবােঝাই জাহাজ চাল, চিনি,সতাে, তামাক ইত্যাদি নিয়ে অন্ত্র, তামিলনাড়ু ও কেরালায় যেত। দক্ষিণ ভারত থেকে লংকা, মরিচ ও মশলা বাংলাতে আসত। শায়েস্তা খাঁর আমলে বাংলায় এক টাকায় ৭/৮ মন চাল বিক্রি হত। কবিকঙ্কণ   মুকুন্দবামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যে ধনপতি চাঁদসদাগর সপ্তডিঙা মধুকর নিয়ে সিংহলে। বাণিজ্যের যে বর্ণনা আছে তা কাল্পনিক নয়।


উপকুল বাণিজ্য  ও বহির্বাণিজ্যঃ-


বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্থলপথে কাবুল, কান্দাহার, পারস্য ও তুরস্ক প্রভৃতির সঙ্গে বাণিজ্য চলত। জলপথে বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে গুজরাটের সুরাট, ব্রোচ, কাম্বে বন্দর, পশ্চিম উপকূলের গােয়া, কালিকট, কোচিন, দাবল, বেসিন বন্দর এবং পূর্ব উপকূলের মাদ্রাজ, নেগাপম, মুসলিপম, সাতগাঁও, সােনারগাঁও, চট্টগ্রাম ইত্যাদি বন্দর বহির্বাণিজ্যের অন্যতম মাধ্যম ছিল। চিন থেকে ভারতে আসত চিনের রেশমবস্ত্র, চিনামাটির পাত্র, লাক্ষার জিনিস, কপূর ও নানা প্রসাধন দ্রব্য। বার্মা থেকে আসত মশলা ও লবঙ্গ, মধ্যএশিয়া ও আরব থেকে আনা হত ঘােড়া ও মৃগনাভি। আর রপ্তানি হত সুতিবস্ত্র, রেশমবস্ত্র ও নীল। পারস্য থেকে আনা হত গালিচা, কার্পেট, ভেলভেট ইত্যাদি। গুজরাটের বণিকরা মালাবার, | গােয়া, এডেন, হরমুজ, পেগু ও এশিয়ার আরও বহু স্থানে বাণিজ্য করতে যেত। তখন ভারতীয় পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল মিশর, মালাক্কা, পােল্যান্ড, পারস্য, তুরস্ক, রাশিয়া প্রভৃতি দেশে। মালাবারের রাহাবি পরিবার এবং সুরাটের বাহারজি, আবদুল গফুর ও বােহরা বণিকদের এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা ছিল। তখন ভারত রপ্তানি করত আফিম, নীল, তৈলবীজ, চিনি, মসলিন, মশলা, সুতিবস্ত্র, রেশমবস্ত্র, চাল, তামাক, সালফার ইত্যাদি। আর আমদানি করা হত বিদেশ থেকে ঘােড়া, সােনা, রুপা, পাথর, সুগন্ধি দ্রব্য, কাচ, কার্পেট, কপূর, পাের্সেলিন দ্রব্য, দাস ইত্যাদি।

শিল্পঃ-


* আবুল ফজলের বিবরণী থেকে জানা গেছে মােগল আমলে তুলা ও রেশম | ব্যাপকভাবে চাষ হত বলে সুতি ও রেশমবস্ত্রের উৎপাদন বেশি হত। তখন। বাংলাকে ‘রেশমভাণ্ডার’ বলা হত। উত্তরপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের ‘চিনিশিল্প’, অমৃতসরের শাল, পশম ও গালিচাশিল্প, গুজরাটের সােনা ও রুপার শিল্প, গােলকুণ্ডর লৌহশিল্প, কাশ্মীর। ও লাহােরে গালিচা ও শালশিল্প, খান্দেশ ও ফৈজাবাদের জরিশিল্প এবং কাপড় রং করার জন্য রওনশিল্প ইত্যাদি গড়ে উঠেছিল। বাংলার সুতিবস্ত্রশিল্প বিশেষত  ঢাকাই মসলিন ও ক্যালিকো বস্ত্র এবং কাশ্মীরের পশমবস্ত্রশিল্প খুব খ্যাতিলাভ করেছিল। বাংলায় সুতিবস্ত্রশিল্পের পর রেশমশিল্প উন্নতিলাভ করেছিল। বাংলা ছাড়া লাহাের, ফতেপুর সিক্রি ও আগ্রাতে রেশমশিল্প ও পশমশিল্পের উন্নতি ঘটেছিল। চর্মশিল্প ও ধাতুশিল্পের সন্তোষজনক অগ্রগতি ঘটেছিল। মােগলযুগে ব্রোঞ্জের তৈরি ভারী কামান, ক্ষেপণাস্ত্র, জাহাজ ইত্যাদি নির্মাণের উন্নত কারিগরিবিদ্যার প্রসার সম্পর্কে ড. ইরফান হাবিব (Technology in Medieval India'গ্রন্থে) আলােচনা করেছেন বেসিন, সুরাট ও কালিকটের জাহাজনির্মাণশিল্প, কামান, বন্দুক, বুলেট, বারুদ ও উৎক্ষেপণ বা বাণ’ তৈরির কারখানা সম্পর্কে। ড. ওমপ্রকাশ, ড. অশীন দাশগুপ্ত-এর মতেও পাের্তুগিজ গ্রন্থ ‘সুম্মাথিয়াে লজিকা’ তে সুরাট বন্দরের আন্তর্জাতিক গুরুত্বের কথা বলা আছে।






একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ