সুফি আন্দোলন (sufi Movement):-
উৎসঃ-
ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে হিন্দুধর্মে যেমন ভক্তি আন্দোলন, মুসলিম ধর্মেও তেমনি সুফিবাদী আন্দোলন শুরু হয়। দশম শতাব্দী থেকেই সুফিবাদের উন্মেষ ঘটে। কিন্তু পূর্ণ বিকাশ ঘটে ত্রয়ােদশ, চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে। তবে সুফিবাদীরা উদারপন্থী ছিলেন বলে গোড়া উলেমারা তাদের পছন্দ করতেন না। সুফিবাদীরা বিশ্বাস করতেন, সুব ধর্মই হল, ‘সত্যকে জানার ইস্তেহারপত্র’।
সুফির অর্থঃ-
সুফিবাদের মূল বক্তব্য :-
'সুফি' শব্দটি ‘সুফ’ ও ‘সাফা’ শব্দ থেকেই এসেছে। সুফ কথার অর্থ, যারা মােটা পশমের বস্ত্র পরিধান করে। 'সাফা’ কথার অর্থ, পবিত্র জীবনযাপন। তাই সুফি-সন্ত বা পিররা ঈশ্বর সাধনার দ্বারা মানুষ ও ঈশ্বরের মধ্যে মেলবন্ধন করতেন এবং সরল ও পবিত্র জীবনযাপনের কথা বলতেন।
সুফিবাদের বিভাজন :-
সুফিবাদকে কেন্দ্র করে তিনটি সুফি সম্প্রদায় জনপ্রিয়। হয়ে ওঠে :-
(১) চিস্তি পন্থা এবং
(২) সুরাবর্দি পন্থা ও
(৩) ফিরদৌসি পন্থা।
পঞ্চদশ শতকের শেষে আরও নতুন নতুন পন্থার উদ্ভব ঘটে। যেমন--কাদেরি,কালন্দরি, সাত্তারি ও নক্শবন্দি পন্থা। উদারপন্থী সুফি-সন্তরা ‘বি-সাহারা’ (Be-sahara) এবং অপেক্ষাকৃত গোঁড়া সুফি সাধকরা ‘বা-সাহারা’ (Ba-shara) নামে পরিচিত। পঞ্চদশ শতকে ভারতে কাদেরি, সাত্তারি ও নকশবন্দি পন্থা নামে সুফি সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটে। এঁরা সবাই শরিয়তের বিধান মেনে চলতেন। তবে কালন্দরি পন্থীরা শরিয়ত মানতেন না। এঁদের উদার, সামাজিক সাম্যের নীতি নিম্নবর্ণের হিন্দুদের অনুপ্রাণিত করেছিল।
সুফিবাদী প্রচারকবৃন্দ :-
সুফিবাদীরা তাদের ধর্মমত প্রচারের জন্য মােট ১৫টি। শিলশিলায় (দলে) বিভক্ত হয়েছিলেন। এই উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থানে ‘খান্কা’ বা ‘দরগা গঠিত হয়েছিল।
খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তি (১১৪২-১২৩৬ খ্রিঃ):-
চিস্তি সম্প্রদায়ের প্রচারকরা অনেক উদার প্রকৃতির। পাঞ্জাব, রাজপুতানা, সিল্ক, দিল্লি। উত্তরপ্রদেশ, বাংলা প্রভৃতি স্থানে চিস্তি পন্থা বেশি জনপ্রিয় ছিল। আজমিরে মইনদ্দিন তাঁর দরগা স্থাপন করেন। তিনি ১১৯২ খ্রিঃ চিস্তি পন্থার প্রতিষ্ঠা করেন। আজমিরকে কেন্দ্র করে তিনি সুফিধর্ম প্রচার করেছিলেন। তিনি শিষ্যদের বলতেন “নদীর মতাে ঔদার্য, সূর্যের মতাে অনুরাগ এবং পৃথিবীর মতাে আতিথেয়তা আয়ত্ত করতে...”। তাঁর প্রধান শিষ্য কুতুবউদ্দিন বক্তিয়ার। কাকি, যিনি ইলতুৎমিসের শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন।
নিজামউদ্দিন আউলিয়াঃ-
আফগানিস্তান থেকে দিল্লিতে এসে সুফিবাদের প্রচার শুর করেন নিজামদিন। আউলিয়া। ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি সুফিবাদের প্রচারের জন্য আলাউদ্দিন খলজির। সহযােগিতায় দিল্লিতে একটি দরগা স্থাপন করেন। তার অন্যতম শিষ্যদের মধ্যে খাজা শাহজালাল, নাসিরউদ্দিন চিরাগ অন্যতম ।’ভারতের তােতাপাখি’ আমির খসরু নাসিরুদ্দিনকে ‘চিরাগ-ই-দিল্লি’ বা দিল্লির আলাে বলেছেন। চিস্তি পন্থার প্রচারকরা মনে করতেন অর্থ ধর্মচিন্তার প্রতিবন্ধক এবং রাজনীতিও ধর্মীয় জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর। সিরাজউদ্দিন আখি সিরাজ বাংলাতে এই মত প্রচারকরেন। কয়েকজন মহিলা সুফি সাধিকা হলেন বিবি জুলাখা, বিবি ফতিমা সাম, সৈয়েদা জায়নাব খাতুন প্রমুখ।
শেখ শিহাবুদ্দিন সরাবর্দিঃ-
সরাবর্দি পন্থার সন্তরা মনে করতেন অর্থ ও রাজনীতি ধর্মের ক্ষতি করে না। তাই রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের প্রত্যক্ষ যােগ ছিল। সিন্ধু, পাঞ্জাব, মুলতান ও বাংলাতে এই পন্থার প্রচার হয়েছিল। ১২০৪ খ্রিস্টাব্দের পর সুরাবর্দি পন্থার প্রচার পণ সুরাবদি শুরু হয়। শিহাবুদ্দিনই এই পন্থার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তাঁর প্রধান শিষ্য ছিলেন হামিদ-উদ্দিন নাগােরি। তবে সুরাবর্দি পন্থার জনপ্রিয়তা তুলনামূলকভাবে কম। ফিরদৌসি পন্থার প্রবর্তক ছিলেন শেখ শরাফউদ্দিন ইয়াহিয়া শিষ্যদের উদ্দেশ্যে লেখা তাঁর পত্রসংকলনের নাম হল মক্তুবাৎ'।
সুফিবাদের সমন্বয়বাদী প্রভাব বা গুরুত্ব :-
সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি। ক্ষেত্রে সুফিবাদের প্রভাব রয়েছে। ঐতিহাসিক তাহের আলি বলেন, সুফিবাদীদের সেবামূলক কাজের দিকটি সমাজে প্রভাব ফেলেছিল। সুফিবাদের প্রভাব বিশ্লেষণ করে বলা যায় :-
(১) হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ধর্মীয় সমন্বয়ের ফলে বনবিবি, ওলাবিবি, ঝােলাবিবি, গাজিবাবা, দক্ষিণরায়, মা শীতলা, ধর্মঠাকুর, সত্যপির, জয়াপির, মানিকপির প্রভৃতি সবার উপাস্য দেবদেবী হয়ে ওঠে।
(২) সাহিত্য-সংস্কৃতি অনেকটাই পূর্ণতাপ্রাপ্ত হয়। আমির খসরু (মধ্যযুগের রবীন্দ্রনাথ’), হাসান খসরু, ওমর খৈয়ম, রুমি, হাফেজ, শেখ সাদি প্রমুখ বিখ্যাত লেখকদের লেখনীতে সুফিবাদের প্রভাব পড়েছিল।
সমন্বয়বাদী সাংস্কৃতিক চেতনার ধারাঃ-
(৩) ভারতীয় শাসকদের মধ্যে ধর্ম সমন্বয়ের আদর্শ স্থাপনে সুফিবাদের প্রভাব রয়েছে। শেরশাহ, আলাউদ্দিন খলজি, আকবর, শাহজাহান সুফিবাদের প্রভাবে উদার হয়েছিলেন। বাংলার শাসক হােসেন শাহ ‘সত্যপির আন্দোলন শুরু করেছিলেন।
(৪) ভক্তিবাদের বিকাশে সুফিবাদের অবদান রয়েছে। জিতেন্দ্র মিত্র (তাঁর Tagore without ॥lusion গ্রন্থে) বলেন, উত্তর ভারতের বৈষম্যদুষ্ট সমাজে সাংস্কৃতিক ও ভাববিপ্লব এনেছিল সুফিবাদ।
(৫) হিন্দু-মুসলিম ঐক্য স্থাপনে সুফিবাদের প্রভাব রয়েছে। সুফি সাধক শাহ মহিবুল্লাহ বলেন যে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে তফাত করা ইসলামবিরুদ্ধ। আবার উদারতার জন্য সাধক সারমাদকে যেমন প্রাণ দিতে হয়েছিল তেমনি আবার সাধক জালালউদ্দিন তাবরিজি বাঙালির। শ্রদ্ধাভাজন হয়েছিলেন বলে জলায়ুদ মিশ্রের ‘শেখ শুভদয়’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে। আহম্মদ শরিফ বাংলার সফি সাহিত্য' গ্রন্থে জানিয়েছেন, সাম্যবাদী ইসলাম ভারতে পুরানাে যুগের অবসান ও নতুন যুগের সূচনা করেছে।
(৬) মুসলিমদের মধ্যে ধর্মসহিষ্ণুতার বােধ বৃদ্ধি হয়। আকবর ‘দীন-ই-ইলাহি’র ধারণা সুফিবাদ থেকেই পেয়েছিলেন। সুফিতত্ত্বের উপর রচিত ‘সাম সংগীত’ গাইতেন মালিক মহম্মদ জয়সি, ফিরদৌসি সাধক প্রমুখ। ভালােবাসা ও সাম্য হল সুফিবাদের মূলকথা।
0 মন্তব্যসমূহ