সামাজিক রূপান্তর কি? প্রাচীন ভারতে তা কিভাবে এলো? এই রূপান্তরের পরিণতি কি হয়েছিল? সামাজিক রূপান্তরের কারণ, অর্থনৈতিক জীবন (Economic Life), কৃষির প্রাধান্য (Supremacy of Agriculture), উন্নত কৃষি-অর্থনীতি, নবম শ্রেণী

সামাজিক রূপান্তর কি? প্রাচীন ভারতে তা কিভাবে এলো? এই রূপান্তরের পরিণতি কি হয়েছিল?নবম শ্রেণী

প্রাচীন ভারতে সামাজিক রূপান্তর (Social transition in Ancient India):- 

সামাজিক রূপান্তরের কারণ:-


পরবর্তী বৈদিক যুগকে (৬০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দ) সামাজিক রূপান্তর ও পরিবর্তনের যুগ বলে। ভারতীয় সমাজে কোনাে বিবর্তন ছিল না বলে পাশ্চাত্য পণ্ডিতরা মনে করেন। সমাজে দাসপ্রথা প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। এই সমাজ প্রাচীন কৃষি ও হস্তশিল্পভিত্তিক, স্বয়ম্ভর গ্রামকেন্দ্রিক, স্বৈরাচারী ও রাজতন্ত্র শাসিত একটি অপরিবর্তনীয় ‘এশিয়াটিক সমাজের দৃষ্টান্ত। গর্ডন চাইল্ডমর্গান-এর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তর যুগকে ‘বর্বরতার যুগ’ এবং তাম্র-প্রস্তর যুগকে ‘সভ্যতার যুগ’ বলা হয়। তবে লৌহযুগে প্রকতপক্ষে মানবসভ্যতার পত্তন ঘটে। দার্শনিক ফ্রেডারিক এঙ্গেলস বলেন, প্রাচীন যুগে পরিবার, ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও শ্রেণিবিভক্ত সমাজ ছিল না, অর্থাৎ সমাজ ছিল সাম্যবাদী। আধুনিক গবেষক লেসলি এ. হােয়াইট, মার্শাল, ডি. সাহলি, এলম্যান আর সার্ভিস প্রমুখ সমাজের রূপান্তরের কিছু স্তর উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল দল-উপদলভিত্তিক সমাজ, জনভিত্তিক সমাজ, জনপতির চালিত সমাজ ও রাষ্ট্রভিত্তিক সমাজ। সভ্যতার যুগে প্রথম সমাজ রূপান্তরের ঘটনা ঘটে হরপ্পার যুগে। বর্ণে বর্ণে সংকরায়ণের ফলে যে সামাজিক মাৎস্যন্যায় নেমে আসে তা দূর করতে রাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়।



(ক) সামাজিক রূপান্তরে নগরায়ণের বিশেষ ভূমিকা ছিল। বৌদ্ধযুগের সমাজে বণিকশ্রেণির বিশেষ প্রভাব ছিল।

(খ) ভারতীয় সমাজে বর্ণপ্রথার প্রধান প্রধান বিধিনিষেধ হল—

(১) অন্য বর্ণে বিবাহ চলবে না, 

(২) বর্ণ হবে জন্মগত, 

(৩) ব্যক্তির বর্ণ বদলানাে যাবে না, 

(৪) উচ্চ ও নিম্নবর্ণের একত্রে আহার নিষিদ্ধ, 

(৫) প্রতিটি বর্ণের। ধর্মকর্মও নির্দিষ্ট এবং 

(৬) ব্রাত্মণ হবেন বর্ণশ্রেষ্ঠ। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘ভারতীয় সমাজ পদ্ধতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, সংঘাত চলেছিল ব্রাত্মণ-ক্ষত্রিয়ের মধ্যে এবং ব্রাত্ম-ক্ষত্রিয় আঁতাতের। সাথে বৈশ্য-শূদ্রের মধ্যে। ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা বলেন, বৌদ্ধযুগ থেকে গুপ্তযুগ। পর্যন্ত যে ‘বৈশ্য-শূদ্র জোট’ তৈরি হয়েছিল, তাদের আর্থিক শক্তিকে সমাজ স্বীকৃতি দিয়েছিল। 

(গ) প্রতিটি দেশের সমাজব্যবস্থার সঙ্গে যেমন প্রাচীনপন্থী ও উদারপন্থীদের। যােগসাজশ থাকে ভারতীয়

সমাজে তা অব্যাহত ছিল। মনুসংহিতার মতে অসবর্ণ এবং অনুলােমপ্রতিবােম বিবাহের ফলে ভারতীয় সমাজে বহু জাতির সৃষ্টি হয়। অসুবিধায় পড়ে মানুষ অনেক সময় আপদধর্ম’কে স্বীকার করে অন্য ধর্ম গ্রহণ করে থাকে। ভারতীয় সমাজের রুপান্তর পর্যালােচনা করলে পশ্চিমি পণ্ডিতদের ‘এশিয়াটিক সমাজের তত্ত্ব’ আজ অচল, সীমাবদ্ধ ও ত্রুটিপূর্ণ মনে হওয়াই স্বাভাবিক।


একঝলকে এই সামাজিক রূপান্তরের চিত্রটা দেখে নেওয়া যায় এভাবে—


(ক) সিন্ধ সভ্যতার সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক, যদিও সমাজতান্ত্রিক সেই ব্যবস্থায় বর্ণপ্রথা বা জাতপাতের ধারণা ছিল না। 


(খ) আর্যসমাজ পিতৃতান্ত্রিক। তবে নারীস্বাধীনতা ছিল। কিন্তু পরে তা খর্ব হয় এবং বর্ণপ্রথা ও জাতপাত মাথাচাড়া দেয়। 


(গ) মৌর্য সমাজে বর্ণপ্রথা মিশ্রবর্ণে পরিণত হয়। এ সমাজে সাতশ্রেণির মানুষ ছিল (শুদ্র ও চণ্ডালদের ‘পঞ্চমজাতি’ বলা হত। পরে শক, হুন, কুষাণ, পহুবদের এদেশে আগমনের ফলে বর্ণসংকর প্রথা গড়ে ওঠে। 


(ঘ) গুপ্তযুগে ব্রাত্মণদের প্রাধান্য থাকলেও বিভিন্ন বর্ণ ও উপবর্ণের মধ্যে অবাধ মেলামেশা চলত। তখন পেশার ও বর্ণের মধ্যে ভালাে সম্পর্ক ছিল বলে রােমিলা থাপার মনে করেন। 


(ঙ) পাল ও সেনযুগে ব্রাত্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র ছাড়াও তেলি, মালাকার, বৈদ্য, কুলীন কায়স্থ, কুলীন ব্রাক্ষ্মণের ধারণা গড়ে ওঠে। এই সমাজিক রূপান্তরে বিপ্লব আসে। 


(চ) দক্ষিণি সমাজে জাতিভেদ প্রথা কঠোর হয়। শুদ্র ও চণ্ডালদের অবস্থা শােচনীয় হয়। ব্রাহ্ণ ও অব্রাত্মণ ছাড়া এই সমাজে বৈশ্য ও ক্ষত্রিয়দের মতাে মধ্যবর্তী শ্রেণি ছিল না।


      ৭০০ খ্রিঃ থেকে ১২০০ খ্রিঃ ভারতে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যেমন কেন্দ্রীয় শক্তির পতন এবং আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটেছিল, ঠিক তেমনি সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা বিবর্তন সূচিত হয়েছিল (কথিত আছে বল্লালসেন বাংলার সমাজজীবনে কৌলীন্য প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন। কুলীন কারা, সে বিষয়ে প্রচলিত প্রবাদও আছে।*

অর্থনৈতিক জীবন (Economic Life):-


প্রাচীন ভারতের অর্থনৈতিক জীবন স্বচ্ছল ছিল। হরপ্পা সভ্যতার যুগে কৃষিপ্রধান জীবিকা হলেও, শিল্প, বাণিজ্য ইত্যাদিও ছিল। বৈদিক যুগেও কৃষি, পশুপালন, শিল্প ও বাণিজ্যকে মানুষ প্রধান জীবিকারুপে গ্রহণ করেছিল। বৌদ্ধযুগে (৬০০-৩০০ খ্রিঃ পূঃ) কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে চরম উন্নতি ঘটেছিল। মৌর্য  অর্থনীতির মূল বৈশিষ্ট্য হল অর্থনীতির উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল। দক্ষিণ ভারতে মৌর্যোত্তর যুগে মুদ্রা অর্থনীতি প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে (সাতুবাহনরাজাদের সিসার মুদ্রা পােটিন, চোলদের স্বর্ণমুদ্রা ‘ক্যাশু’ এইসময় ব্যাপকভাবে চালু হয়। গুপ্তযুগেও কৃষি শিল্প, বাণিজ্য অব্যাহত ছিল। পাল ও সেন যুগে তা অব্যাহত ছিল।

কৃষির প্রাধান্য (Supremacy of Agriculture):- 


খ্রিস্টীয় ৭০০-১২০০ অব্দের মধ্যে ভারতের সর্বত্র সামন্ত অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল। বেতনের পরিবর্তে
জমিদানের রীতি থাকায় রাজার অধীনে প্রচুর সামন্ত কর্মচারীর উদ্ভব হয় । ‘খাসজমি’কে প্রাচীন কালে
সীতা’ বলা হত, যার তত্ত্বাবধায়ককে ‘সীতাধ্যক্ষ’। 

উন্নত কৃষি-অর্থনীতিঃ-


ঐতিহাসিক রােমিলা থাপারের মতে,  “১০০০ খ্রিঃ পর থেকে সামরিক প্রয়ােজন বৃদ্ধি পায়।” তাই রাজস্ব আদায় ও সামরিক দায়িত্ব ঠিক-ঠিক পালনের জন্য আরও বেশি করে জমি বা গ্রাম দান শুরু হয়। ওড়িশার গঙ্গরাজ অনন্ত বর্মন বহু করমুক্ত গ্রাম দান  করেছিলেন। চালুক্যদের সময়ে শক্তিশালী সামন্তরা

‘মহামণ্ডলেশ্বর’, ‘মহাসামন্ত প্রভৃউপাধি নিতেন। আর অপেক্ষাকৃত ছােটো সামন্তরা ‘রাণক’, ‘ঠাকুর’, ‘রাজা’, ‘সামন্ত ‘ ভোক্তা ইত্যাদি উপাধি নিতেন। গুপ্তযুগে সামন্ত ও উপসামন্ত শ্রেণি ছিল। তাই কৃষি মানুষের প্রধান জীবিকা হয়ে ওঠে। আর সেইজন্যই কৃষির উন্নতির নানা তথ্য আমরা পণ্ডিত মেধাতিথির

গ্রন্থ বা ‘অভিধানরত্নমালা’ গ্রন্থে পাই। এই যুগের উন্নত কৃষিজ মরে মধ্যে চাল, ডাল, সরষে, পাট, তুলাে, নীল, সুপারি, নারকেল, খেজুর, পান, কলা, ভন লবঙ্গ ইত্যাদি প্রধান। ‘অর্থশাস্ত্রের’ মতে রাষ্ট্র কৃষির প্রসার ঘটাতে ‘জনপদ’ গড়ে ললে। ইহা ‘জনপদ নিবেশ’ নামে পরিচিত। জনপদে শূদ্ররা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।

মার্কোপোলোর মতে বাংলায় তখন উন্নত আঁশযুক্ত তুলাে উৎপন্ন হত। আরবীয়  পর্যটকদের মতে, গুজরাটে ভালাে ধান, আম, মধু, নারকেল উৎপন্ন হত। বাংলায় রেশম ও গটিপােকা চাষের উল্লেখ দ্বাদশ শতকের চর্যাপদগুলিতে আছে। গুপ্তযুগে ‘অমরকোশে’ | বারাে প্রকার জমির উল্লেখ আছে। যেমন—

ক্ষেত্র (কর্ষণযােগ্য), বাপক্ষেত্র (জলে ভিজা বীজ বপনে উত্তম), খিল (অকর্ষিত জমি), অপ্রহত (পতিত জমি), অপ্রদ (কাউকে না দেওয়া জমি), বাস্তুজমি, পশুপালনের জমি ইত্যাদি। কেউ বলেন এই জমির মালিকানা রাজার ছিল। কেউ বলেন অন্যের ছিল, রাজার নয়।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ