মহম্মদবিন-তুঘলক এর কৃতিত্ব আলোচনা করো।
তুঘলক বংশের কৃতিত্ব বর্ণনা করো । নবম শ্রেণী
তুঘলক বংশঃ-
‘কারানা তুর্কি’ গাজি মালিক শেষ খলজি শাসক খসরু শাহকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসন লাভ করেন (১৩২০ খ্রিঃ)। তিনিই তুঘলক বংশের প্রতিষ্ঠাতারূপে গিয়াসুদ্দিন তুঘলক’ নাম ধারণ করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর জ্যেষ্ঠ পুত্র ফকরুদ্দিন জুনা খাঁ ‘মহম্মদ-বিন-তুঘলক’ নাম ধারণ করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন (১৩২৫ খ্রিঃ) তিনি ১৩২৫-১৩৫১ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন।
মহম্মদ বিন-তুঘলক (১৩২৫-৫১ খ্রিঃ):-
পাগলা রাজা কী?
মহম্মদ-বিন-তুঘলক মধ্যযুগের একজন প্রতিভাবান সুলতান ছিলেন। উত্তর আফ্রিকার মরক্কো থেকে আগত ইবন বতুতা তাঁর “কিতাব-উর-রাহেলা’ গ্রন্থে বলেছেন, সুলতানি যুগের তিনিই একমাত্র শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ও যুক্তিবাদী শাসক ছিলেন। তার প্রজাহিতৈষণা, উদারতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও উচ্চ চিন্তাভাবনা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। কিন্তু পাশাপাশি তার বাস্তববুদ্ধির অভাব, ধৈর্যহীনতা, কল্পনাপ্রবণ স্বভাবের জন্য কোনাে কর্মসূচি সফল। হতে পারেনি। তাই তাঁকে ‘পাগলা রাজা’ বলা হয়। আসলে তিনি কিন্তু পাগল নন। ঐতিহাসিকরা তাঁকে ‘mixture of opposite' বলতেও ছাড়েননি।
মুহাম্মদ বিন-তুঘলক
দোয়াব অঞ্চলে রাজস্ব বৃদ্ধি (১৩২৬ খ্রিঃ):-
গঙ্গা-যমুনা-দোয়াব অঞ্চল উর্বর, কৃষিজ পণ্যের ফলনও ভালাে। তাই সুলতান এই অঞ্চলের ভূমিরাজস্ব ৫০% থেকে কিছুটা বাড়িয়েছিলেন। বরনির মতে, এই বৃদ্ধির হার ৫-১০ গুণ ছিল। ফেরিস্তার মতে, বিন তঘলক ৩-৪ গুণ রাজস্ব বৃদ্ধি করেছিলেন। আমির-ই-কোহি’ নামে রাজস্ব বিভাগের কর্মচারীরা বর্ধিত হারে রাজস্ব আদায় করতে গিয়ে দমনপীড়নের আশ্রয় নেন। রাজধানী স্থানান্তর (১৩২৬ - ২৭ খ্রিঃ)সুলতান দিল্লি থেকে দেবগিরিতে (মহারাষ্ট্র) রাজধানী স্থানান্তরের জন্য দিল্লি থেকে দেবগিরি পর্যন্ত ৭০০ মাইল লম্বা একটি রাস্তা তৈরি করেন । বরনির মতে, মহম্মদ বিন তুঘলকই দেবগিরির নামকরণ করেন দৌলতাবাদ। এই পরিকল্পনার ' পেছনে যেসব প্রধান কারণ ছিল -তা হল—
(ক) মােঙ্গল আক্রমণ থেকে সুলতানি রাজধানীকে রক্ষা করা,
(খ) সুশাসন প্রবর্তন ও রাজনৈতিক শান্তি প্রতিষ্ঠা করা,
(গ) বরনির মতে, দেবগিরি ভারতের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ায় সর্বত্র লক্ষ রাখা সম্ভব হবে। ঐতিহাসিক লেনপুলের মতে তাই “দৌলতাবাদ শুধুমাত্র অনিয়ন্ত্রিত উদ্যমের স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে রইল”।*
* দ্রষ্টব্য : ১ জিতল = 7. টাকা বা ৩ পয়সার সমান।১ তঙ্কা = ১১/ টাকা ও ১ মন = ১৫কেজি,। আমির খসরুর মতে তখন ১ টাকায় ৮. মন ভালাে সরু চাল (fine rice) কেনা যেত। "Daulatabad remained as a moument of misdirected energy"
তামার নোটের প্রচলন (১৩৩০ খ্রিঃ):-
১৩২৯-৩০ খ্রিঃ বিন-তুঘলক যে তামার নােট (নাম ‘দোকানি’) প্রচলনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, তার পশ্চাতেও চতুর্দশ শতকের রৌপ্য সংকট ও তামার পর্যাপ্ততা, চিনা বাজাদের ‘চ্যাও’ নামক কাগুজে নােট এবং পারস্যের রাজা গাইখাতু খান (১২৯৩)-এর প্রতীকী মুদ্রার প্রেরণা ছাড়াও আরও যথেষ্ট বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি ছিল। তাঁর সময় স্বর্ণমুদ্রা দিনার’, রৌপ্যমুদ্রা ‘টঙ্কা’ বা ‘তঙ্কা’ ও তামার। পয়সা ‘জিতলের ব্যবহার ছিল। ১ দিনার = ১০ টঙ্কা। কিন্তু বিশাল সাম্রাজ্যের প্রয়ােজনের তুলনায় তা অনেককম ছিল। বরনির মতে সুলতান দান বা খয়রাতি। খাতে ও খােরাসন জয়ের কথা ভাবতে গিয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় করেন।
কারাজল ও খােরাসন জয়ের পরিকল্পনাঃ-
সুলতান ভেবেছিলেন, রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযােগে অভিযান প্রেরণ করলে সবদিক থেকে লাভের সম্ভাবনা অনেক বেশি। তাই বরনির মতে, খােরাসন তল জয়ের পরিকল্পনা করতে গিয়ে মহম্মদ বিন তুঘলক ৩,৭০,০০০ সৈন্য সংগ্রহ করে তাদের সমস্ত ভরণপােষণ করেছিলেন প্রায় এক বছর ধরে। কিন্তু খােরাসন ও ইরাকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্রাটের প্রতিকূলে যাওয়াতে সুলতান সৈন্যদল ভেঙে দেন।
অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহঃ-
সুলতানের অদুরদর্শিতার কারণে অভিজাত ও সাধারণ মানুষ দেশের নানা প্রান্তে। বিদ্রোহ শুরু করেন।সিন্ধু, মুলতান, পাঞ্জাব, দেবগিরি, গুজরাট ও বাংলাতে সুলতানবিরােধী বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। গুলবর্গার শাসক বাহাউদ্দিন ঘুরশাম্পের বিদ্রোহ, দেবগিরির সিংগড়ের হিন্দুদের বিদ্রোহ, সিন্দু ও মুলতানে বাহরাম আইবার বিদ্রোহ, মালাবারে সৈয়দ আহসান শাহের বিদ্রোহ, লাহােরে মােঙ্গল নেতা হালাজুনের বিদ্রোহ, দেবগিরি, মালব ও খান্দেশের আমিরদের বিদ্রোহ, গুজরাটে মালিক তাৰ্ঘির বিদ্রোহ ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। হরিহর ও বুব্ধ বিদ্রোহীদের সাহায্যে বিজয়নগর রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। আলাউদ্দিন বাহমন শাহ বিদ্রোহী আমিরদের সাহায্যে স্বাধীন বাহমনি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলায় গিয়াসুদ্দিন বাহাদুরের বিদ্রোহ উল্লেখযােগ্য। ফিরােজ তুঘলক (১৩৫১-৮৮ খ্রিঃ) মহম্মদ তুঘলক ও আলাউদ্দিনের যে সামরিক প্রতিভা ছিল ফিরােজ তুঘলকের তা ছিল না। ১৩৫৩ খ্রিঃ ও ১৩৫৯ খ্রিঃ বাংলার বিদ্রোহ দমন করতে একডালা দুর্গ অবরােধ করে শেষে ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন। ১৩৬০ খ্রিঃ ওড়িশার জাজনগর ও কাংড়ার নগরকোট দুর্গ পুনরুদ্ধার করে এখানকার জ্বালামুখী মন্দির থেকে প্রচুর সংস্কৃত নথিপত্রদিল্লিতে নিয়ে আসেন।
ফিরােজের জনকল্যাণমূলক কার্যাবলিঃ-
ফিরােজের জনহিতকর কার্যাবলি রূপায়ণের পেছনে উজির বা প্রধানমন্ত্রী মালিক মকুবলের মুখ্য ভূমিকাছিল। প্রধান জনহিতকর কার্যাবলি হল—রাজস্বক্ষেত্রে ভূমিরাজস্বের হার কমিয়ে দিয়ে ও মহম্মদ-বিন- তুঘলকের সময়কার ২৪ প্রকার অবৈধ কর বাতিল করে, কোরানে উল্লিখিত চারটি কর আদায় করেছিলেন মাত্র। এগুলি হল :-
(১) খিরজ বা খারাজ বা ভূমিরাজস্ব ৫ ভাগের ১ ভাগ - ৩ ভাগের ১ ভাগ,
(২) খামস্ বা লুণ্ঠিত দ্রব্যের ৫ ভাগের ১ ভাগ,
(৩) জজিয়া বা অমুসলমানদের থেকে গৃহীত ধর্মকর ও
(৪) জাকাৎ বা মুসলমানদের সংগৃহীত ২এর অর্ধেকভাগ ধর্মকর। এছাড়া সেচকর বা ‘সাব’ ১০ এর ১ ভাগ আদায় করা হত উৎপন্ন ফসলের মাধ্যমে। বাণিজ্যে আন্তর্বাণিজ্য শুল্ক বা চুঙ্গিকর তুলে দেন। ফলে নিত্যপ্রয়ােজনীয় সমস্ত জিনিসের দাম কমে যায়। আফিফের ‘তারিখ-ই- ফিরােজশাহি’ গ্রন্থ থেকে এইতথা জানা যায়। সেচব্যবস্থার উন্নতির জন্য ফিরােজ তুঘলক পাঁচটি বড়াে খাল খনন করেছিলেন। তাই হেনরি এলিয়ট তাঁকে ‘সুলতানি যুগের আকবর’ বলেছেন।
তৈমুর লঙ:-
মধ্য এশিয়ার সমরখণ্ডের তুর্কি নেতা আমির তাৰ্ঘির পুত্র তৈমর লঙ-এর জন্ম হয় ১৩৩৬ খ্রিঃ। দিল্লির তুঘলকবংশীয় শেষ সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ শাহের শাসনকালে (১৩৯৪-১৪১৩ খ্রিঃ) ১৩৯৮ খ্রিঃ তৈমুর ভারত আক্রমণ (১৩৯৮-১৩৯৯ খ্রিঃ) করেন।
ফলাফল:-
(১) তৈমূর পনেরাে দিন ধরে দিল্লিতে নির্বিচারে লক্ষাধিক নরনারীকে হত্যা করেন।
(২) বাউনির মতে, এই হত্যাকাণ্ডের ফলে দিল্লির আকাশে তিন মাস কোনাে পাখি ওড়েনি। সমগ্র দিল্লি জুড়ে শ্মশানের শূন্যতা নেমে এসেছিল।
(৩) ১৩৯৯ খ্রিঃ সমরখণ্ডে ফেরার পথে মিরাট, হরিদ্বার, ফিরােজাবাদ, জম্মু, শিবালিক পার্বত্য অঞ্চল ইত্যাদি লুণ্ঠন করে প্রচুর ধনরত্ন ও বন্দি নারীপুরুষকে নিয়ে দেশে ফেরেন।
(8) তৈমুরের আক্রমণে শুধু একদিনে দিল্লির প্রবেশপথের কাছে ১,০০,০০০ হিন্দুকে হত্যা করা হয়। অসংখ্য গবাদি পশু খাদ্যসংকটে মারা যায়। চারদিকে মড়ক ও মন্বন্তর নেমে আসে।
(৫) তৈমুরের আক্রমণের সূত্রে ভারতীয় শিল্প-স্থাপত্য মধ্য-এশিয়াতে বিস্তারলাভ করেছিল।
(৬) পরবর্তীকালে বাবরের ভারত আক্রমণের (১৫২৬ খ্রিঃ) পথ তৈমুরই সহজ করে দিয়েছিলেন। আবদুল কাদের বদাউনি লিখেছেন, “যাঁরা তৈমুরের হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন, তারা কিছুদিনের মধ্যে দুর্ভিক্ষ ও মহামারির কবলে পড়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ