খলজিশাসন খলজি শাসন সম্পর্কে আলোচনা করো।
খলজি বিপ্লবঃ-
খলজি বংশের প্রতিষ্ঠাতা জালালউদ্দিন খলজি (১২৯০-৯৬ খ্রিঃ) দিল্লির দাসবংশের শেষ তুর্কি সুলতান কাইকোবাদ ও তার শিশুপুত্র কাইমুর্সকে খলজি বিপ্লব হত্যা করে দিল্লির খলজি বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। এই ঘটনাকে ইতিহাসে ‘খলজি বিপ্লব’ বলা হয়। আলাউদ্দিন খলজি ১২৯৬- ১৩১৬ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
আলাউদ্দিন খলজি (১২৯৬-১৩১৬ খ্রিঃ):-
রাজ্যজয়ঃ-
ড. এ. এল. শ্রীবাস্তব বলেন, “তিনি রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্র হিসাবে তৈরি করেছিলেন। তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মালিক কাফুর দাক্ষিণাত্য অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিন্ধ্যর দক্ষিণ-পশ্চিমে যাদব বংশীয় রাজা রামচন্দ্রদেবকে পরাস্ত করে দেবগিরি দখল করেন। পরে রামচন্দ্র আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য অভিযানে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিলেন। ১৩০৬-০৭ খ্রিঃ বঙ্গল বা তেলেঙ্গানার কাকোতীয় বংশের রাজা প্রতাপরুদ্রকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন এবং প্রচুর ধনরত্ন, ১০০ হাতি, ৭০০ ঘােড়া ও একটি বহুমূল্য হীরকখণ্ড লাভ করে মালিক কাফুর দিল্লিতে ফিরে আসেন।
আলাউদ্দিন খলজি
নব-মুসলমান হত্যাঃ-
জালাউদ্দিনের হাতে বন্দি হয়ে যেসব মােঙ্গল দিল্লির উপকণ্ঠে বসবাস শুরু করে- তারাই ‘নব-মুসলমান’ নামে পরিচিত। এই নব-মুসলমান তথা মােঙ্গলরা বিদ্রোহী হয়ে উঠলে আলাউদ্দিনের নির্দেশে একদিনের মধ্যে ত্রিশ হাজার নবমুসলমানের শিরচ্ছেদ করা হয়।
আলাউদ্দিনের শাসনতান্ত্রিক সংস্কার :
শাসনতান্ত্রিক সংস্কারঃ-
আলাউদ্দিন সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তাঁর উজির বা প্রধানমন্ত্রীর নাম ছিল খাজা খাতির। তাই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থার শীর্ষে তার অবস্থান ছিল। কেন্দ্রীয় শাসনের পথে প্রধান প্রতিবন্ধক ওমরাহ হাজিমৌলা, ভাইপাে আকাত খাঁ, ভাগনে উমর ও মগু খার বিদ্রোহ তিনি দমন করেন। কুচক্রান্তেরঅবসান ঘটিয়ে কেন্দ্রীয় শাসনকে সুদৃঢ় করতে আলাউদ্দিন যেসব শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন, তা হল---
(ক) বারিদ’ ও ‘মুনহি' নামে গুপ্তচর নিয়ােগ,
(খ) মিলকফ্, ওয়াকফ্ ও ইনাম বাবদ যেসব জমি বা জায়গির দরবারি অভিজাতদের দেওয়া হত তা বাজেয়াপ্ত হয়,
(গ) মদ্যপান ও অভিজাতদের মধ্যে বিনা অনুমতিতে বিবাহ বা মেলামেশা নিষিদ্ধ হয়,
(ঘ) আর্থিক স্বচ্ছলতার সব উৎসই বন্ধ করা হয়।
সামারিক সংস্কারঃ-
আলাউদ্দিনের শাসনব্যবস্থার মূল স্তম্ভ ছিল শক্তিশালী সেনাবিভাগ। ‘আরিজ-ই-মুমালিক’ নামে সমরমন্ত্রী সেনা নিয়ােগ করতেন। ‘বকশি-ই-ফৌজ’ একটি অশ্বপিছ ২৩৪ তঙ্কা বার্ষিক বেতন দিতেন এবং অতিরিক্ত একটি অশ্বের জন্য আরও ৭৮ তঙ্কা দেওয়া হত। জায়গিরের পরিবর্তে নগদ অর্থে বেতন দেওয়া হত। সামরিক বিভাগের দুর্নীতি বন্ধ করতে ‘দাগ’ (অশ্ব চিহ্নিতকরণ) ও ‘হুলিয়া’ (সৈন্য চিহ্নিতকরণ) প্রথা চালু করেন। ফেরিস্তার মতে, ৪,৭৫,০০০ অশ্বারােহী সৈন্য। তার সংগ্রহে ছিল। তিনিই প্রথম দিল্লিতে স্থায়ী ও সংরক্ষিত সেনাদল গঠন করেন।
বিচারব্যবস্থাঃ-
‘কাজি-উল-মুমালিক’ বা প্রধান কাজি বিচারকার্য পরিচালনা করলেও, সম্রাট নিজেই আপিল আদালতের মাধ্যমে বহু মামলার নিষ্পত্তি করতেন। তাঁর ফৌজদারি আইনগুলি। অত্যন্ত কঠোর ছিল। mমৃত্যুদণ্ড, শূলে চড়ানাে, অঙ্গহানি, বেত্রাঘাত ইত্যাদি শাস্তি প্রচলিত ছিল। জিয়াউদ্দিন রনির মতে, আলাউদ্দিনের বিচারবিভাগে যথেষ্ট দুর্নীতি ছিল। তিনি শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সাম্রাজ্যকে ১১টি প্রদেশে ভাগ করে, প্রতিটিতে পৃথক বিচার, রাজস্ব, সেনাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। সরকারি খবর আদানপ্রদানের জন্য তিনি ‘দাভা’ বা পাইক ও আউলাখ’ বা অশ্বারােহী ডাকের প্রচলন করেছিলেন। শাসক ও রাজ্যবিজেতারপে আলাউদ্দিন নতুন নজির mস্থাপন করেছিলেন সন্দেহ নেই। যদিও কাজি মুঘিসউদ্দিনকে তিনি বলেছিলেন, জনগণের কল্যাণসাধনই তাঁর শাসননীতির। মূল উদ্দেশ্য, তথাপি সবাই তার শাসনে আতঙ্কে ছিল। আমির খসরু নিজেই স্বীকার"। করেছেন, “সম্রাটের রাজমুকুটের প্রতিটি মুক্তা, দরিদ্র কৃষকের অক্ষরিত জমাট রক্তবিন্দুমাত্র।”
অর্থনৈতিক সংস্কার :
রাজস্বব্যবস্থাঃ-
আলাউদ্দিন রাজস্ববিভাগে ‘দেওয়ান-ই-আশরফ’বা হিসাবরক্ষক নিয়ােগ করেছিলেন। ‘দেওয়ান-ই মুস্তাফি’ বা হিসাব পরীক্ষক তার নীচে ছিলেন। এরপরে কারকুন, মুটাশরিফ, মুহাশিল ও গােমস্তাদের স্থান ছিল। আলাউদ্দিন পূর্ববর্তী ইক্তাপ্রথা, তুলে দিয়ে সমস্ত কৃষিযােগ্য জমিকে ‘খলিসা’ বা ‘খাস’ বা সরকারের নিজস্ব জমিতে পরিণত করেন। ফলে স্থানীয় জমিদার খুৎ, মুকাদ্দাম, চৌধুরিরা আর্থিকস্বচ্ছলতা হারায়। জমি জরিপ করে তিনি ৫০% খিরিজ বা ভূমিরাজস্ব ছাড়া চারণকর, গৃহকর, জিজিয়া কর, করহি কর (হিন্দু বণিকরা ১০% ও মুসলিম বণিকরা ৫% হারে এই শুল্ক দিত) আদায় করতেন। সুলতানি যুগের ভ্রাম্যমাণ বণিকদের। ‘ক্যারাভ্যান’ বলা হত, যেহেতু তারা উটের পিঠে করে মাল সরবরাহ করত।
রেশনব্যবস্থাঃ-
আলাউদ্দিনই সর্বপ্রথম রেশনব্যবস্থা (Rationing system) চালু করেছিলেন। মূল উদ্দেশ্য হল সম্পত্তির রাষ্ট্রীয়করণ। এই রেশনের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষের বা অনাবৃষ্টির সময় দুটি ক্রীতদাসযুক্ত পরিবারপিছু আধমন করে খাদ্যশস্য দেওয়া হত। মােরল্যান্ড (Moreland) বলেন, দিল্লি ও তার আশপাশে রেশনব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে খরা কিংবা দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়নি।
বাজার নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাঃ-
সমকালীন লেখক বারনি, দেহলভি প্রমুখের মতে, তিনি তিন ধরনের বাজার গঠন। করেছিলেন :-
(১) খাদ্যশস্যের বাজার,
(২) দাস-দাসী, ঘােড়া ও গবাদি পশুর বাজার ও
(৩) বস্ত্র ও বিলাসদ্রব্যের বাজার। বাজার তত্ত্বাবধানের জন্য ‘শাহানা-ই-মন্ডি’ নামে দপ্তর গঠিত হয়েছিল। এই কর্মচারীরা ব্যবসায়ীদের নাম নথিভুক্ত করা ছাড়া তাদের বাটখারা পরীক্ষা করত। আর একটি বিভাগ ছিল ‘দেওয়ান-ই রিয়াস'। কোনাে ব্যবসায়ী ওজন কম দিলে তার দ্বিগুণ ওজনের মাংস ওই Uসায়ীর শরীর থেকে কেটে নেওয়া হত। আলাউদ্দিন প্রজাদের ‘খালক-ই- খুদাই’ মনে তঙ্কা বার্ষিক বেতন দিতেন এবং অতিরিক্ত একটি অশ্বের জন্য আরও ৭৮ তঙ্কা দেওয়া হত। জায়গিরের পরিবর্তে নগদ অর্থে বেতন দেওয়া হত। সামরিক বিভাগের দুর্নীতি বন্ধ করতে ‘দাগ’ (অশ্ব চিহ্নিতকরণ) ও ‘হুলিয়া’ (সৈন্য চিহ্নিতকরণ) প্রথা চালু করেন। ফেরিস্তার মতে, ৪,৭৫,০০০ অশ্বারােহী সৈন্য। তার সংগ্রহে ছিল। তিনিই প্রথম দিল্লিতে স্থায়ী ও সংরক্ষিত সেনাদল গঠন করেন।
বিচারব্যবস্থাঃ-
‘কাজি-উল-মুমালিক’ বা প্রধান কাজি বিচারকার্য প রিচালনা করলেও, সম্রাট নিজেই । আপিল আদালতের মাধ্যমে বহু মামলার নিষ্পত্তি করতেন। তাঁর ফৌজদারি আইনগুলি। অত্যন্ত কঠোর ছিল। মৃত্যুদণ্ড, শূলে চড়ানাে, অঙ্গহানি, বেত্রাঘাত ইত্যাদি শাস্তি প্রচলিত ছিল। জিয়াউদ্দিন রনির মতে, আলাউদ্দিনের বিচারবিভাগে যথেষ্ট দুর্নীতি ছিল। তিনি শাসনকার্যের সুবিধার জন্য সাম্রাজ্যকে ১১টি প্রদেশে ভাগ করে, প্রতিটিতে পৃথক বিচার, রাজস্ব, সেনাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। সরকারি খবর আদানপ্রদানের জন্য তিনি ‘দাভা’ বা পাইক ও আউলাখ’ বা অশ্বারােহী ডাকের প্রচলন করেছিলেন। শাসক ও রাজ্যবিজেতারপে আলাউদ্দিন নতুন নজির স্থাপন করেছিলেন সন্দেহ নেই। যদিও কাজি মুঘিসউদ্দিনকে তিনি বলেছিলেন, জনগণের কল্যাণসাধনই তাঁর শাসননীতির। মূল উদ্দেশ্য, তথাপি সবাই তার শাসনে আতঙ্কে ছিল। আমির খসরু নিজেই স্বীকার" করেছেন, “সম্রাটের রাজমুকুটের প্রতিটি মুক্তা, দরিদ্র কৃষকের অক্ষরিত জমাট রক্তবিন্দুমাত্র।”
অর্থনৈতিক সংস্কার :
রাজস্বব্যবস্থাঃ-
আলাউদ্দিন রাজস্ববিভাগে ‘দেওয়ান-ই-আশরফ’বা হিসাবরক্ষক নিয়ােগ করেছিলেন। ‘দেওয়ান-ই মুস্তাফি’ বা হিসাব পরীক্ষক তার নীচে ছিলেন। এরপরে কারকুন, মুটাশরিফ, মুহাশিল ও গােমস্তাদের স্থান ছিল। আলাউদ্দিন পূর্ববর্তী ইক্তাপ্রথা, তুলে দিয়ে সমস্ত কৃষিযােগ্য জমিকে ‘খলিসা’ বা ‘খাস’ বাসরকারের নিজস্ব জমিতে পরিণত করেন। ফলে স্থানীয় জমিদার খুৎ, মুকাদ্দাম, চৌধুরিরা আর্থিকস্বচ্ছলতা হারায়। জমি জরিপ করে তিনি ৫০% খিরিজ বা ভূমিরাজস্ব ছাড়া চারণকর, গৃহকর, জিজিয়া কর, করহি কর (হিন্দু বণিকরা ১০% ও মুসলিম বণিকরা ৫% হারে এই শুল্ক দিত) আদায় করতেন। সুলতানি যুগের ভ্রাম্যমাণ বণিকদের। ‘ক্যারাভ্যান’ বলা হত, যেহেতু তারা উটের পিঠে করে মাল সরবরাহ করত।
রেশনব্যবস্থাঃ-
আলাউদ্দিনই সর্বপ্রথম রেশনব্যবস্থা (Rationing system) চালু করেছিলেন। মূল উদ্দেশ্য হল সম্পত্তির রাষ্ট্রীয়করণ। এই রেশনের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষের বা অনাবৃষ্টির সময় দুটি ক্রীতদাসযুক্ত পরিবারপিছু আধমন করে খাদ্যশস্য দেওয়া হত। মােরল্যান্ড (Moreland) বলেন, দিল্লি ও তার আশপাশে রেশনব্যবস্থা প্রবর্তনের ফলে খরা কিংবা দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্যসংকট সৃষ্টি হয়নি।
বাজার নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থাঃ-
সমকালীন লেখক বারনি, দেহলভি প্রমুখের মতে, তিনি তিন ধরনের বাজার গঠন। করেছিলেন :-
(১) খাদ্যশস্যের বাজার,
(২) দাস-দাসী, ঘােড়া ও গবাদি পশুর বাজার ও
(৩) বস্ত্র ও বিলাসদ্রব্যের বাজার। বাজার তত্ত্বাবধানের জন্য ‘শাহানা-ই-মন্ডি’ নামে দপ্তর গঠিত হয়েছিল। এই কর্মচারীরা ব্যবসায়ীদের নাম নথিভুক্ত করা ছাড়া তাদের বাটখারা পরীক্ষা করত। আর একটি বিভাগ ছিল ‘দেওয়ান-ই রিয়াস'। কোনাে ব্যবসায়ী ওজন কম দিলে তার দ্বিগুণ ওজনের মাংস ওই সায়ীর শরীর থেকে কেটে নেওয়া হত। আলাউদ্দিন প্রজাদের ‘খালক-ই- খুদাই’ মনে করতেন। তাই জনগণের সেবার জন্য মূল্যতালিকা নির্ধারণ অনিবার্য বলে তিনি মনে করেছিলেন। তার একটি নমুনা নিম্নরূপ :---
গম প্রতি মন = ৭ জিতল*।
বার্লি প্রতি মন = ৪ জিতল।
চাল প্রতি মন = ৫ জিতল।
ডাল প্রতি মন = ৫ জিতল।
শিম-মটর প্রতি মন = ২ জিতল ।
লবণ প্রতি মন = ২ জিতল।
চিনি প্রতি সের = ১ এর হাফ জিতল।
বাটার প্রতি ২১ সের = ১ জিতল।
একটি সাধারণ দাসী = ৫-১২ তঙ্কা ;
একটি সাধারণ দাস = ১০-১৫ তঙ্কা ;
একটি সুন্দরী যুবতিদাসী = ১০০-১৫০ তঙ্কা ;
একটি শক্তিশালী দাস = ৪০-১৬০ তঙ্কা ।
0 মন্তব্যসমূহ