দিল্লির সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা, কুতবউদ্দিন আইবক , ইলতুৎমিস, সুলতান রাজিয়া, মুইজউদ্দিন থেকে নাসিরউদ্দিন, গিয়াসুদ্দিন বলবন । নবম শ্রেণী


দিল্লির সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা, কুতবউদ্দিন আইবক , ইলতুৎমিস, সুলতান রাজিয়া, মুইজউদ্দিন থেকে নাসিরউদ্দিন, গিয়াসুদ্দিন বলবন ।

কুতবউদ্দিন আইবকঃ-

অপুত্রক মহম্মদ ঘােরির মৃত্যর পর তাঁর অন্যতম ক্রীতদাস ও সুদক্ষ সেনাপতি কুতবউদ্দিন আইবক(১২০৬-১২১০ খ্রিঃ) ১২০৬ খ্রিঃ দিল্লির স্বাধীন শাসক নিযুক্ত হন। এইসময় তিনি ‘মালিক’ এবং ‘সিপাহসালার’ উপাধি নেন। ১২০৮ খ্রিঃ মহম্মদ ঘােরির বংশধর গিয়াসদ্দিন ঘােরি কুতবউদ্দিনকে ‘সুলতান’ উপাধি দিলে তিনি দাসত্ব থেকে মুক্তি পান এবং সার্বভৌম শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠেন। দিল্লি, কনৌজ; গােয়ালিয়র, রণথম্বাের জয় করে দিল্লিতে সুলতানি সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপন করেন। ১২০৬ খ্রিঃ লাহােরে কুতুবউদ্দিনের অভিষেকের (coronation) পর তিনি হিন্দুস্থানের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে ওঠেন। মহম্মদ ঘােরির দুই সেনাপতি তাজউদ্দিন ইলদুজ ও নাসিরউদ্দিন কুবাচা ছিল কুতবউদ্দিনের প্রধান শত্রু। তাই কুতবউদ্দিন এদের সঙ্গে আত্মীয়তা করতে নিজেই ইলদুজের কন্যাকে বিবাহ করেন ও তার ভগ্নীকে কুবাচার সঙ্গে বিবাহ দেন। অন্যদিকে কুতবউদ্দিনের নির্দেশে বখ্‌তিয়ার খলজি বাংলা ও বিহার আক্রমণ করে বিক্রমশীলা, ওদন্তপুরী ও নালন্দা মহাবিহার ধ্বংস করেন। বাংলার লক্ষ্মণ সেনকে। পরাজিত করে উত্তরবঙ্গের দেবীকোটে বখতিয়ার খলজি নতুন তুর্কি রাজধানী স্থাপন। করেন। বখতিয়ার খলজির মৃত্যুর পর আলিমর্দান খলজি বাংলার শাসক হন, কুতুবউদ্দিনের নির্দেশে। এইসময় থেকে দিল্লির অধিরাজত্ব বাংলায় গড়ে ওঠে। এছাড়া দিল্লির তুর্কি ও অ-তুর্কি (তাজিক) কর্মচারীরা কুতুবউদ্দিনের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিলেন।



ইলতুৎমিস (১২১১-৩৬ খ্রিঃ) : -

সিংহাসন লাভঃ-

ইলতুৎমিস দিল্লির আমির-ওমরাহদের অনুরােধে কুতবউদ্দিনের অপদার্থ পালিত পুত্র আরাম শাহের অকর্মণ্যতার জন্য তাঁকে হত্যা করে সিংহাসন লাভ করেন। প্রথম জীবনে ইলতুৎমিস দাস ছিলেন। পরে ভাগ্যগুণে তিনি দিল্লির সুলতান হন (১২১১ খ্রিঃ)। সামসুদ্দিন ইলতুৎমিস সুলতানি শাসনের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। কারণ— 

(১) রাজনৈতিক সুস্থিতি ফেরাতে নির্মম দমননীতির আশ্রয় নেন। 


(২) সর্বপ্রথম অযােধ্যা, বারাণসী, বাউন, শিবালিক, দিল্লি প্রভৃতি স্থানের কুচক্রী আমির-ওমরাহদের ১২১২-১২১৫ খ্রিঃ মধ্যে দমন করে নিজের ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করেন।

 

(৩) ১২১৬ খ্রিঃ তাজউদ্দিনের বিদ্রোহ ও ১২১৭ খ্রিঃ মানসেরার যুদ্ধে নাসিরুদ্দিন কুবাচার বিদ্রোহ দমন করে সিন্ধু, পাঞ্জাব এমনকি গজনির উপর আধিপত্য স্থাপন করেন। 

সমস্যার সমাধানঃ-

() ১২২৫-১২২৭ খ্রিঃ বাংলার বিদ্রোহ দমন করে ইলতুৎমিস পুত্র নাসিরুদ্দিন মামুদকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। কিন্তু তাঁর অকালমৃত্যুতে (১২২৯ খ্রিঃ) ইক্তিয়ারউদ্দিন বল্‌কা খলজিবাংলার সিংহাসন লাভ করলেও তার উদ্ধত আচরণে ১২৩০-৩১ খ্রিঃ ইলতুৎমিস। তাঁকে হত্যা করে মালিক আলাউদ্দিন জানিকে বাংলার অনুগত শাসকরুপে নিয়ােগ করেন। 


() ১২২১ খ্রিস্টাব্দে কুখ্যাত মােঙ্গল নেতা তেমুজিন বা চেঙ্গিজ খাঁ, জালালউদ্দিন মাঙ্গবরনির রাজ্য মধ্য এশিয়ার খিবা বা খােয়ারিজম প্রদেশ আক্রমণ করলে মাঙ্গারনি পালিয়ে এসে ইলতুৎমিসের কাছে আশ্রয়ভিক্ষা চান। কিন্তু ইলতুৎমিস চেঙ্গিজের ভারত আক্রমণের ভয়ে মাঙ্গবরনির আবেদন প্রত্যাখ্যান করলে তিনি ভারত ত্যাগ করেন। চেঙ্গিজ তার পিছু ধাওয়া করে সিন্ধুতীরে এসে সিন্ধু ও পাঞ্জাবে লুঠপাট চালিয়ে ফিরে চলে যান।

খলিফার স্বীকৃতিঃ-

ইলতুৎমিস যেভাবে দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের শিশু বৃক্ষকে একটা মহিরহে পরিণত করেছিলেন, তা এক বিরল ঘটনা। তাই বাগদাদের খলিফা (মুসলিম ধর্মগুর) আল-মুসতানসির বিল্লাহ (Al-Mustansir billah) ইলতুৎমিসকে ‘সুলতান-ই- আজম’ বা শ্রেষ্ঠ সুলতান উপাধিতে ভূষিত করেন।

অন্যান্য কৃতিত্বঃ-

ইলতুৎমিস ভারতে শুধু তুর্কি সাম্রাজ্য গঠন করেননি, সেই সাম্রাজ্যকে সার্বভৌম  শক্তির উপর প্রতিষ্ঠা করতে ও সুশাসন গড়ে তুলতে ‘চল্লিশের চক্র বা বন্দেগি-ই চিহালগানি’ গঠন করেছিলেন। তিনি প্রথম আরবি মুদ্রার প্রচলন করেন। এছাড়া তাম্রমুদ্রা ‘জিতল’ ও রৌপ্যমুদ্রা ‘তঙ্কা’ তিনি প্রবর্তন করেন। তিনিই প্রথম ‘ইকতা’ বা জায়গির প্রথা চালু করেন। তাঁর রাজসভায় মিনহাজউদ্দিন সিরাজ, নিজাম উল-মুলকজুনাইদি, ফকর-উল-মুলকইসামির মতাে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিতবর্গ থান করতেন। ঐতিহাসিক ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ তাই মনে করেন, “ইলতুৎমিস নিঃসন্দেহে দাসবংশের প্রকৃত স্থাপয়িতা ছিলেন”।

সুলতান রাজিয়া (১২৩৬-৪০ খ্রিঃ):

ইলতুৎমিস তাঁর পুত্রদের অকর্মণ্যতা লক্ষ করে তাঁর একমাত্র বুদ্ধিমতী বিদুষী কন্যা রাজিয়াকে দিল্লির

উত্তরাধিকারিণী মনােনীত করে গিয়েছিলেন। সুলতান* রাজিয়া ১২৩৬ খ্রিঃ সিংহাসনে বসেন এবং ১২৪০ খ্রিঃ পর্যন্ত মাত্র চার বছর সগৌরবে রাজত্ব করেন। সমকালীন পণ্ডিত ইসামির ‘ফুতুহা-উস্-সালাতিন’গ্রন্থ থেকে রাজিয়ার রাজত্বকাল সম্পর্কে অনেক কথা জানা যায়। রাজিয়াই মধ্যযুগের একমাত্র মহিলা। যিনি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হয়ে সিংহাসনে বসেন। তিনি ছিলেন। বুদ্ধিমতী, দয়াপ্রবণ ও যােদ্ধা। তাই অশ্ব ও অস্ত্রচালনায় দক্ষ ছিলেন। পুরুষের পােশাক পরে রাজসভায় শাসনকার্য পরিচালনা করতেন। শাসনদণ্ড হাতে নিয়ে রাজিয়া সর্বপ্রথম তুর্কি অভিজাতদের হাত। থেকে সমস্ত ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে কেন্দ্রীভূত শাসন প্রণয়নের উপর জোর দেন। তিনি তুর্কি অভিজাতদের নিয়ে গঠিত পূর্ববর্তী ‘চল্লিশের চক্র’ ভেঙে দেন। বহু অ-তুর্কি মুসলমানকে উচ্চপদে নিয়ােগ করেন। জালালউদ্দিন ইয়াকুৎ খাঁ নামে এক হাবসি নেতা অ-তুর্কি দল গঠনে রাজিয়াকে সাহায্য করেছিলেন। প্রাদেশিক বিদ্রোহী নেতা নিজাম-উল-মুলকজুনাইদিকে হত্যার ব্যাপারে রাজিয়া কবির খান ও মালিক ইজুদ্দিনের সাহায্য পেয়েছিলেন।

মুইজউদ্দিন থেকে নাসিরউদ্দিন (১২৪১-১২৬৫ খ্রিঃ):-

রাজিয়ার মৃত্যুর পর তুর্কী আমীরগণ তাঁর ভাই মুইজউদ্দিন বাহরাম শাহকে সিংহাসনে বসান ও নিজেদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত করেন। এতে ক্রুদ্ধ হয়ে সুলতান আমীরদের কুচক্রী নেতা আইতাগিনকে হত্যা করেন। তাই ১২৪২ খ্রিঃ মােঙ্গল আক্রমণের সুযােগে আমীরগণ মুইজউদ্দিনকে নিহত করে নাসিরউদ্দিনের পৌত্র অপদার্থ আলাউদ্দিন মামুদ শাহকে দিল্লির সিংহাসনে বসান। এই দুই সুলতানের ছয় বছর রাজত্বে শান্তি-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে ও প্রজাদের জীবন দুর্বিষহ। হয়ে ওঠে। তার উপর ১২৪৫ খ্রিঃ আবার মােঙ্গল আক্রমণ সংকটজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি। করলে আমীর ওমরাহগণ ইলতুৎমিশের কনিষ্ঠ পুত্র নাসিরউদ্দিন মামুদ শাহকে ১২৪৬ খ্রিঃ দিল্লির সিংহাসনে বসান। তিনি দাসবংশের শেষ সুলতানরুপে ২০ বছর (১২৪৬-১২৬৫)। রাজত্ব করেন। কিন্তু তিনি শান্তিপ্রিয় মানুষ বলে শাসনভার তাঁর শ্বশুর মন্ত্রী উলুঘ খাঁ। (বলবন)-এর উপর অর্পণ করেন। ১২৬৫ খ্রিঃ নিঃসন্তান নাসিরউদ্দিনের মৃত্যুর পর বলবন দিল্লির সুলতান হন (মিনহাজ-উস-সিরাজের ‘তাবাকাৎ-ই-নাসিরি’ গ্রন্থটি সুলতান নাসিরউদ্দিনের নামে উৎসর্গ করা হয়েছিল।

তুরকি ভাষায় ‘সুলতানা কথার অর্থ হল সুলতানের পত্নী। তাই রাজিয়াকে ‘সুলতান রাজিয়া’ বলা ভালাে। তাছাড়া রাজিয়া তার নামাঙ্কিত মুদ্রাতেও নিজেকে ‘সুলতান’ বলে উল্লেখ করেছেন* ড ঈশৰীপ্রসাদের ভাষায়, তিনি হলেন, “ranks among the great pioneers of Muslim conquest in India".

গিয়াসুদ্দিন বলবন : 

ষাট বছরের বৃদ্ধ বলবন (উলুঘ খাঁ) স্বৈরাচারী শাসক হিসাবে ১২৬৬-১২৮৭ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর রাজতান্ত্রিক আদর্শ হল—এইসময়। তিনি তুর্কি অভিজাতদের থেকে নিজেকে বেশি শক্তিশালী বলে প্রমাণ করেছিলেন। ফরাসি সম্রাট চতুর্দশ লুই-এর ন্যায় বলবন নিজেকে ‘নায়েবৎই-খুদাই’ বা ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে প্রচার করেন। তিনি পারস্যের সাসানীয় বংশের রাজাদের ন্যায় ‘জিলিল্লাহ’ উপাধি নেন ও বহুমূল্য রত্নখচিত পােশাক পরিধান করতেন। তিনি ‘পাওবস’ (সুলতানের পদযুগল চুম্বন) ও ‘সিজদা’

(সিংহাসনের সামনে নতজানু থাকা) প্রথা চালু করেন। রাজদরবারে হাসিঠাট্টা, আমােদ-আল্লদ, মদ্যপান নিষিদ্ধ ছিল।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ