দিল্লির সুলতানি যুগের সংক্ষিপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাস (Brief political History of Delhi Sultanate period):
আরবদের সিন্ধুবিজয়ঃ-
উমায়াদবংশীয় খলিফাদের রাজত্বকালে (৬৬১-৭৫০ খ্রিঃ) মহম্মদ-বিন-কাশিম নামে এক আরব আক্রমণকারী প্রথম ভারত আক্রমণ করেন। ইরাকের শাসনকর্তা অল হজ্জাজের সেনাপতি মহম্মদ-বিন-কাশিমের সিন্ধু আক্রমণের পেছনে কিছু বিশেষ উদ্দেশ্য বা কারণ ছিল (৭১২ খ্রিঃ আরবদের সিন্দুজয়ের মূল কারণগুলি ছিল : --
(১) ভারত মহাসাগরের উপকূলের বিভিন্ন বন্দরে আরবদের বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। কিন্তু গুজরাট, মাকরান ও সিন্ধু উপকূলের জলদস্যুরা বহুবার আরবদের বাণিজ্যতরি লুঠ করেছিল। এই জলদস্যুদের দমন করাই আরবদের সিন্দুজয়ের প্রধান কারণ।
(২) সিন্ধুর হিন্দু রাজা গোঁড়া ব্রাত্মণ ছাছ অত্যাচারী ছিলেন। তার রাজধানী ছিল আলাের (বর্তমান নাম রােরি)। সামন্তরাও রাজার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ছাছের মৃত্যুর পর তার পুত্র দাহিরও পিতার মতাে অত্যাচারী হয়ে ওঠেন। তাই অতিষ্ঠ সামন্তবর্গ ও সাধারণ কর্মচারী আরবদের পক্ষ নিয়ে দাহিরের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করতে উৎসাহ দেন।
(৩) সিন্ধুর রাজা দাহির খলিফার বহু শত্রুকে তার রাজ্যে আশ্রয় দিয়েছিলেন। দাহিরের এই উদ্ধত আচরণই আরবদের সিন্দুজয়ে উৎসাহিত করেছিল। ৭১২ খ্রিঃ সেনাপতি মহম্মদ-বিন-কাশিম অবশেষে রাওয়ের যুদ্ধে’ দাহিরকে পরাজিত ও নিহত করেন। আরবদের সিন্ধু ও মুলতান জয়ের মধ্যে দিয়ে ভারতে মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটে। প্রায় তিনশাে বছর ধরে আরবরা সিন্ধুপ্রদেশ শাসন করেছিলেন। আরবদের সূত্রে বহির্বিশ্বে ভারতীয় বাণিজ্য দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছিল।
গজনির সুলতান মামুদঃ-
সুলতানি যুগের ভ্রাম্যমাণ বণিকদের বলে ‘সুলতানি যুগে ক্যারাভান’। সুলতান মামুদ মােট সতেরােবার ভারত আক্রমণ করেছিলেন। ১০০০ ফ্রি! প্রথম আক্রমণে শাহিরাজ জয়পাল ও আনন্দপালকে পরাস্ত করলে জয়পাল অগ্নিতে ‘জহরব্রত’ পালন করে প্রাণবিসর্জন দেন। এখান থেকে প্রচুর ধনসম্পদ তিনি পান। ১০০১ খ্রিঃ মামুদ মুলতানের কারমাথিয়ান শিয়া মুসলমান ফতে দাউদকে পরাস্ত করেন। ১০০ খ্রিঃ পাঞ্জাবের সন্নিকটে দিল্লি ও নগরকোট দখল করেন। ১০০৮ খ্রিঃ মুলতান গজনির অন্তর্ভুক্ত হয়। ১০১৮ খ্রিঃ গঙ্গা-যমুনা-দোয়াব অঞ্চলের মথুরা ও কনৌজের বহু নগর। এদির লুণ্ঠন করে প্রচুর ধনসম্পত্তি লাভ করেন। ১৯১৯ খ্রিঃ মামুদ আনন্দপালের লে ত্রিলােচন পালকে পরাস্ত করেন। ১০১৫-১০২২ খ্রিঃ মধ্যে মামুদ দুবার কাশ্মীর লাকমণের ব্যর্থ চেষ্টা করেন। ১৯২২ খ্রিঃ মামুদ চান্দে রাজ্য আক্রমণ ও কালিওর দর্গ অবরােধ করেন। গুজরাটের অনহিলবাড়ার সােমনাথ মন্দিরে বিপুল ধনসম্পদের খবর শুনে ১০২৫ খ্রিঃ জানুয়ারি মাসে ৮০,০০০ সৈন্য নিয়ে মন্দির আক্রমণ ও ধ্বংস করেন। এখান থেকে দু-কোটি স্বর্ণমুদ্রা, ২০০ মন সােনা ও প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে গজনিতে ফেরার পথে সিন্ধুর জাঠরা মামুদকে বাধা দিলে তিনি আবার ১০২৬ খ্রিঃ। ভারত আক্রমণ করেন। সম্ভবত এটাই তার শেষ অভিযান মামুদ ভারতের ধনসম্পদ লণ্ঠনের জন্য ভারত আক্রমণ করেন। এদেশে কোনাে স্থায়ী সাম্রাজ্য গড়ে তােলার ইচ্ছাই তার ছিল না। যাইহােক ১০৩০ খ্রিঃ ৫৯ বছর বয়সে মামুদের মৃত্যু হয়।
মহম্মদ ঘােরিঃ-
মামুদের মতাে লুঠপাট না চালিয়ে ভারতে স্থায়ী মুসলিম সাম্রাজ্য ও শাসনব্যবস্থা গড়ে তােলাই মহম্মদ ঘােরির লক্ষ্য ছিল। ১১৯১ খ্রিঃ দিল্লি ও আজমিরের চৌহানবংশীয় রাজা তৃতীয় পৃথ্বীরাজ চৌহানের কাছে মহম্মদ ঘােরি তরাইনের প্রথম যুদ্ধে পরাস্ত হন। যুদ্ধের কারণ হিসাবে চারণকবি চাঁদবরদৈ-এর ‘পৃথ্বীরাজরাসাে গ্রন্থে উল্লেখ আছে কনৌজের গাহােড়বালবংশীয় রাজা জয়চাঁদের সুন্দরী কন্যা সংযুক্তাকে অপহরণ করে পৃথ্বীরাজ বিবাহ করলে অপমানিত হয়ে জয়চাঁদ তাঁর বিরুদ্ধে মহম্মদ ঘােরিকে যুদ্ধে প্ররােচিত করেন। তবে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে পূর্বপরাজয়ের তরাইনের যুদ্ধের প্রতিশােধ নিতে মহম্মদ ঘােরি পৃথ্বীরাজের বিরুদ্ধে ‘দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধে’ পরস্পর অস্ত্রধারণ করেন। এই যুদ্ধ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ --
তরাইনের যুদ্ধের গুরুত্বঃ-
(ক) পৃথ্বীরাজকে দ্বিতীয় তরাইনের যুদ্ধে (১১৯২ খ্রিঃ) পরাস্ত করার পর সামানা, সরস্বতী ও হাসি দুর্গ মহম্মদ ঘােরি দখল করে নেন। দিল্লিতে ‘সুলতানিরাজ’ স্থাপিত হয় ।
(খ) ১২০৬ খ্রিঃ মহম্মদ ঘােরি সিন্ধুর খােকর বা ইসলামিয়া সম্প্রদায়ের আক্রমণে নিহত হলে তাঁর ক্রীতদাস ও সেনাপতি কুতবউদ্দিন আইবক ঘােরির বিজিত অঞলের অধীশ্বর হন এবং দিল্লির দাসবংশের প্রতিষ্ঠা করেন।*
(গ) প্রাচীন যুগ তথা হিন্দু যুগের অবসান ও মুসলিম যুগ তথা সুলতানি শাসনের পত্তন ঘটে এই যুদ্ধের দ্বারা।
0 মন্তব্যসমূহ