ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের কারণ ও ফলাফল লেখাে। ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণগুলি আলােচনা করাে। প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৪-১৭৪৮ খ্রিঃ), তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৫৬-১৭৬৩ খ্রিঃ), ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণ, নবম শ্রেণী

দাক্ষিণাত্যে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতা :-

প্রায় কুড়ি বছর ধরে ভারতে ইংরেজ ও ফরাসি কোম্পানির মধ্যে সংঘর্ষ চলেছিল। তা ইঙ্গ-ফরাসি সংঘর্ষ নামে পরিচিত। আবার কর্ণাটকের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সিংহাসন দখলকে কেন্দ্র করে উদ্ভত গৃহবিবাদে। ইংরেজ ও ফরাসিরা লিপ্ত হয়েছিল বলে এটি কর্ণাটকের যুদ্ধ নামেও পরিচিত।

ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণ :-

অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের প্রভাবঃ-

 ইউরােপে ‘অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ’ (১৭৪০-৪৮ খ্রিঃ) ভারতে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকদের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল। অস্ট্রিয়ার ষষ্ঠ চার্লসের মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা মারিয়া টেরেসা সিংহাসনে বসলে, দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে প্রাশিয়ার রাজা দ্বিতীয় ফ্রেডারিক অস্ট্রিয়ার সমৃদ্ধিশালী অঞল সাইলেশিয়া দখল করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হয়। এইসময় ইংল্যান্ড অস্ট্রিয়াকে ও ফ্রান্স প্রাশিয়াকে সমর্থন করে। তখন কর্ণাটকে ইংরেজ ও ফরাসিদের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যঘাঁটি ছিল। সেখানে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকগােষ্ঠী ইউরােপের রাজনৈতিক সূত্র টেনে এনে পরস্পর সংঘর্ষ বাধালে কর্ণাটকের নবাব তাতে হস্তক্ষেপ করে।

অসম বাণিজ্যঃ-

অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকরা দক্ষিণ ভারতের করমণ্ডল উপকূলে শক্তিশালী বাণিজ্যঘাঁটি ও দুর্গ গড়ে তুলেছিল। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৭০৭-১৭৪০ খ্রিঃ মধ্যে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে আমদানিকৃত দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ৫ লক্ষ থেকে ১৭,৯৫,০০০ পাউন্ডে দাঁড়ায়। ফরাসিদের বাণিজ্যও দ্রুত বৃদ্ধি পায়। ১৭২৮-১৭৪০ খ্রিঃ মধ্যে ভারত থেকে ইংল্যান্ডে আমদানিজাত পণ্যের মূল্য ৮৯,০০০ পাউন্ড থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৮৮০,০০০ পাউন্ডে ।

ফরাসিদের বন্দর ও ফরাসিদের বাণিজ্যঘাঁটি স্বল্পতাঃ- 

* ইংরেজদের প্রধান তিন বাণিজ্যকেন্দ্র কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম, মাদ্রাজে ফোর্ট সেন্ট জর্জ ও বােম্বে দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। ফরাসিদের বাণিজ্যঘাঁটি পন্ডিচেরির কাছে ফোর্ট সেন্ট ডেভিড নামে আর একটি শক্তিশালী দুর্গ ছিল। ফরাসিদের একমাত্র শক্তিশালী বাণিজ্যঘাঁটি ছিল ভারত মহাসাগরের মরিশাস দ্বীপে।

রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপনের ইচ্ছাঃ- 

করমণ্ডল উপকূল অঞ্চলে ভারতীয় শাসকদের তেমন প্রভাব না থাকায় ফরাসি ও ইংরেজরা বিনা বাধায় বাণিজ্য বৃদ্ধির পাশাপাশি নিজেদের প্রধান্য স্থাপনে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু পশ্চিম উপকূলে মারাঠাদের প্রাধান্য ও বাংলাদেশে নবাবের প্রাধান্য থাকায় ইংরেজ ও ফরাসিরা এখানে রাজনৈতিক প্রাধান্য স্থাপন অপেক্ষা দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটকের রাজনৈতিক শূন্যতার সুযােগ গ্রহণ করতে ইংরেজ ও ফরাসি শক্তি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।

প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৪-১৭৪৮ খ্রিঃ) :-

ইংরেজরা আগ বাড়িয়ে সবসময় ‘যুদ্ধং দেহি মনােভাব’ ব্যক্ত করে এসেছে। ১৭৪৪ খ্রিঃ ইংরেজ নৌসেনাপতি বানেট আচমকা ফরাসিদের কয়েকটি যুদ্ধজাহাজ দখল করলে ফরাসি সেনাপতি ডুপ্লে তার প্রত্যুত্তর দিলেই প্রথম কর্ণাটকের যুদ্ধ শুরু হয়। মরিশাসের ফরাসি শাসক লা-বুরদানে ডুপ্লেকে সাহায্যের জন্য সসৈন্যে মাদ্রাজে হাজির হলে ভয়ে ইংরেজরা মাদ্রাজ ত্যাগ করে। ফলে সহজেই ডুপ্লে সেন্ট ডেভিড দুর্গ দখল করে প্রচুর ধনসম্পদ লুণ্ঠন করলে লা-বুরদানে ও ডুপ্লের মধ্যে মনােমালিন্য হয়। ফলে ফরাসিদের ঐক্য ভেঙে পড়ে। তারপর প্রচণ্ড ঝড় উঠলে লা-বুরদানে মাদ্রাজ ছাড়তে বাধ্য হন। তবে ১৭৪৮ খ্রিঃ ‘আই-লা শাপেলের’ সন্ধি দ্বারা ইউরােপে অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলে, ভারতে। ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্বের অবসান হয়।

দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৯-১৭৫৫ খ্রিঃ) :-

উচ্চাভিলাষী ডুপ্লে ইংরেজদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনে কোনােভাবে আগ্রহী ছিলেন না। তাই আই-লা-শাপেলের শান্তিচুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের রাস্তা খুঁজছিলেন। ঠিক তখনই দুটো ঘটনা ঘটে—(এক) ১৭৪৮ খ্রিঃ হায়দ্রাবাদের নিজাম আসফ খাঁর মৃত্যু এবং (দুই) ১৭৪৯ খ্রিঃ কর্ণাটকের নবাব আনােয়ার উদ্দিনের মৃত্যু। এই দুই নবাবের মৃত্যুতে ডুপ্লে চাদ সাহেবকে কর্ণাটকের সিংহাসনে এবং নিজামের দৌহিত্র মুজফফর জঙ্গকে হায়দ্রাবাদের সিংহাসনে। বসান। এই ঘটনায় দাক্ষিণাত্যে ফরাসিদের প্রাধান্য লক্ষ করে ইংরেজরা চাদ সাহেব ও মুজফফর জঙ্গের বিরােধী পক্ষ। আনােয়ার উদ্দিনের পুত্র মহম্মদ আলিকে কর্ণাটকে ও নিজামের পুত্র নাসির জগকে হায়দ্রাবাদের সিংহাসনে বসাতে তৎপর হয়ে। উঠলে, ইংরেজ ও ফরাসিদের মধ্যে দ্বিতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৪৯ খ্রিঃ) শুরু হয়।

তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধ (১৭৫৬-১৭৬৩ খ্রিঃ) :-

 ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দে ইউরােপে ‘সপ্তবর্ষ ব্যাপী যুদ্ধ’ (১৭৫৬-১৭৬৩ খ্রিঃ) শুরু হলে ইংরেজরা ফরাসি বাণিজ্যঘাঁটি আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে ইংরেজ নৌসেনাবাহিনীর প্রধান ছিলেন পােপক। ফলে আবার ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ শুরু হয়। এইভাবে তৃতীয় এবং শেষ ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব শুরু হলে ফরাসি কর্তৃপক্ষ ১৭৫৮ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে সেনাপতি কাউন্ট ডি লালিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতে পাঠান। তিনি দুমাস অবরােধের পর ইংরেজদের কাছ থেকে ফোর্ট সেন্ট ডেভিড দখল করলেও (১৭৫৮ খ্রিঃ জুন) নৌসেনানায়ক দাখ্‌ (D'Ache) তাকে সাহায্য না করায় লালি বেকায়দায় পড়েন। তিনি বুসিকে হায়দ্রাবাদে সরিয়ে নিলে ইংরেজদের সুবিধা হয়। ক্লাইভের নির্দেশে ইংরেজ সেনাপতি কর্নেল ফোর্ড ফরাসিদের কাছ থেকে উত্তর সরকার দখল করেন এবং নৌসেনানায়ক পােক্ক ফরাসি নৌসেনাধ্যক্ষ দাখ্‌কে পরাস্ত করেন। সর্বশেষ আঘাত হানেন ইংরেজ সেনাপতি স্যার আয়ার কুট। তিনি ১৭৬০ খ্রিঃ ‘বন্দিবাসের যুদ্ধে’ ফরাসি সেনাপতি। লালিকে শােচনীয়ভাবে পরাস্ত করে পন্ডিচেরি, মাহে ও জিঞ্জি নামক স্থানগুলি ফরাসিদের হাত থেকে দখল করে নেন। শেষ পর্যন্ত ১৭৬৩ খ্রিঃ প্যারিসের চুক্তির মাধ্যমে ইউরােপের সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের অবসান ঘটলে ভারতেও ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিসমাপ্তি ঘটে।

ফরাসিদের ব্যর্থতার কারণঃ- 

ফরাসিদের ব্যর্থতার প্রধানতম কারণ ছিল অর্থসংকট। সংগঠন ও আর্থিক সমৃদ্ধির দিক থেকে ইংরেজ কোম্পানি ফরাসি অপেক্ষা বহুগুণে সমৃদ্ধ ছিল। তৃতীয় কর্ণাটকের যুদ্ধের সময় বাংলার বিপুল ঐশ্বর্য ইংরেজদের অর্থাভাব মেটায়।

নৌশক্তির দৌর্বল্যঃ-

ভারতবর্ষে ইংরেজদের পক্ষে সাম্রাজ্য স্থাপনের প্রধান শর্ত ছিল শক্তিশালী নৌবহর। ফরাসিদের কোনাে শক্তিশালী নৌবহর না থাকায়  ইংরেজদের কাছে পরাজয় স্বীকার করতে হয়। ঐতিহাসিক পি. ই. রবার্টস ব্রিটিশ নৌশক্তিকে শ্রেষ্ঠ মনে করতেন।*

যােগাযােগের অভাবঃ-

মাদ্রাজ, বােম্বাই ও কলকাতাতে ইংরেজদের শক্তিশালী বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল। সেখান থেকে যুদ্ধের সরঞ্জাম, সৈন্য ও রসদপত্র জোগাড় করা তাদের কাছে সহজসাধ্য হয়। কিন্তু ফরাসিদের নিকটতম কেন্দ্র ছিল সুদুর মরিশাস। ফরাসিদের একমাত্র অবলম্বন পন্ডিচেরির পতন হলে সুদুর মরিশাস থেকে । যােগাযােগের অভাবে সাহায্য না আসায় ফরাসিদের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।

ভারতে সাম্রাজ্য গড়ে স্থাপনে অনীহাঃ-

সপ্তবর্ষব্যাপী যুদ্ধের সময় ইউরােপে ও আমেরিকায় ইঙ্গ-ফরাসি দ্বন্দ্ব চলছিল। ফরাসি সরকার তখন ইউরােপ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। ভারতে ফরাসি সাম্রাজ্য গডে তােলার কোনাে ইচ্ছাই না থাকায় ফরাসি কর্তৃপক্ষ এদেশের দিকে লক্ষ দেননি।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ