ঔপনিবেশিক শাসনের প্রতিষ্ঠা (Foundationof Colonial Rule):-
কোম্পানি ক্ষমতার ক্রমােন্নতিঃ-
স্যার যদুনাথ সরকার বলেছেন, “পলাশির যুদ্ধে (১৭৫৭) বাংলায় মুসলিম রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে প্রভাবশালী বিদেশিরাই এখানকার রাজা-নির্মাতা হয়ে উঠেছিলেন।” বক্সারের যুদ্ধের (১৭৬৪ খ্রিঃ) পর কোম্পানি মােগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের কাছ থেকে দেওয়ানি লাভ (১৭৬৫ খ্রিঃ) করায় ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি অনেক বৃদ্ধি পায়। কোম্পানির ক্ষমতার বণিকের ‘মানদণ্ড’ কেবল রাজদণ্ডে’ পরিণত হয়নি। ভারতের রাজনীতিতে কোম্পানি সরাসরি প্রবেশ করে দেওয়ানি লাভের পর। অপদার্থ শাহ আলম কোম্পানির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারকে আইনগত স্বীকৃতি জানালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভাগ্য প্রসন্ন হয়েছিল।
কোম্পানির সর্বময় কর্তৃত্বঃ-
তারপর বাংলা-বিহার-ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করে ইংরেজ কোম্পানি প্রথমে রাজস্ব বা দেওয়ানি বিভাগের সর্বময় কর্তা হয়ে ওঠে। মিরজাফরের দ্বিতীয় পুত্র নজম-উদ দৌল্লার সঙ্গে এক চুক্তি অনুসারে কোম্পানির মনােনীত প্রার্থী রেজা খাঁ বাংলার নায়েব-নাজিম’ বা নায়েব দেওয়ান নিযুক্ত হন। এইভাবে প্রকারান্তরে কোম্পানিই বাংলার ‘নিজামত’ ও ‘দেওয়ানি সকল ক্ষমতা হস্তগত করে। বাংলার রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা দখলে অন্যতম নেপথ্য নায়ক ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ।
বাংলার প্রশাসনে রাসার অংশ না নেবার কারণ:-
ক্লাইভের দেওয়ানি অধিকারলাভের সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক সাফল্যের জন্য এতহাসিকরা একে ‘আইনি ধোঁকা’ ('Legal fiction') আখ্যা দিয়েছেন। বাংলার প্রশাসনে তখন সরাসরি কোম্পানির অংশগ্রহণ না করার কয়েকটি কারণ হল—
(১) নবাবকে স্বপদে বহাল রেখে জনগণের চোখে কোম্পানির কর্মচারীরা ভালােমান সাজতে চেয়েছিল। (২) ফরাসি ও ডাচ কোম্পানি ক্লাইভকে বাধা দিতে পারে এই আশঙ্কা থেকে গিয়েছিল।
(৩) বাংলার ভাষা ও প্রচলিত রীতিনীতি ইংরেজদের অজানা ছিল।
দ্বৈতশাসন কী?
বক্সারের যুদ্ধের পর ক্লাইভ বাংলায় দ্বৈতশাসন (Diarchy) প্রবর্তন করেন। বাংলার নবাব নিজাম-উদ-দৌল্লা এক চুক্তির দ্বারা ২০ ফেব্রুয়ারি, ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রশাসনিক ও সামরিক ক্ষমতা কোম্পানির হাতে তুলে দেন। নামসর্বস্ব মােগল সম্রাট শাহ আলম ব্রিটিশ কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব মেনে নেওয়াতে ব্রিটিশের সম্মান বাড়ে। বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পরের বছর কোম্পানি দ্বৈতশাসন প্রতিষ্ঠা করে। ঐতিহাসিক ড. নন্দলাল চ্যাটার্জির মতে বাংলার নবাব কোম্পানির হাতের পুতুলে পরিণত হন। আর কোম্পানি প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে। দ্বৈত শাসনের দুটি রূপ—কোম্পানি প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী, আর নবাব নামমাত্র শাসক। কোম্পানির হাতে সামরিক ও অর্থনৈতিক দায়দায়িত্ব। নবাবের হাতে ছিল রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দায়িত্ব।
দ্বৈতশাসনের কুফল মাত্রা ছাড়ায়। পার্সিভাল স্পিয়ার মনে করেন, সমস্ত শক্তি ছিল ‘সিংহাসনের পশ্চাতে’’ (Power behind the throne)। নবাব ও কোম্পানির সম্পর্কে ‘ক্ষমতাহীন দায়িত্ব, আর দায়িত্বহীন ক্ষমতার’ (responsibility without power and power without responsibility) রাজনীতি ছিল। এইভাবে দ্বৈতশাসন প্রবর্তনের ফলে নবাবের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক ‘ছায়ার সঙ্গে কায়ার সম্পর্কে’র মতাে হয়।
সুপারভাইজার বা পর্যবেক্ষক পদ সৃষ্টি:-
ক্লাইভের পরবর্তী বাংলার গভর্নর লর্ড ভেরেলেস্ট (১৭৬৭-১৭৬৯ খ্রিঃ) দ্বৈত-শাসনের এই ভয়াবহ দুর্নীতি ও কুফল বন্ধ করতে বাংলার প্রতিটি জেলাতে একজন করে ‘সুপারভাইজার’ বা পর্যবেক্ষক নিয়ােগ করেন (১৭৬৯ খ্রিঃ)। এই বছর কোম্পানির এক কর্মচারী মাইকেল বেচার লিখেছিলেন “কোম্পানির দেওয়ানিলাভের পর এদেশ ও এদেশের মানুষের অবস্থা অনেক খারাপ হয়েছিল।”
সিলেক্ট কমিটি ওদ্বৈতশাসনের অবসান:-
এই যুগে কোম্পানির আয়ের উৎস দিনে-দিনে কমতে থাকে। কোম্পানি চরম আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে। তার ওপর দ্বৈতশাসনের নৈরাজ্য কোম্পানির রাজনৈতিক সংকটকে আরও তীব্রতর করে তলেছিল। এই আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে পরিত্রাণের জন্য কোম্পানির। স্বার্থে গঠিত হয় ‘সিলেক্ট কমিটি’। কমিটির তদন্তে কোম্পানির কর্মচারীদের ব্যাপক দুর্নীতি ও কারচুপি প্রকাশ পায়।

0 মন্তব্যসমূহ