ইউরােপীয় ধনতন্ত্র ও ঔপনিবেশিক অর্থনীতি (European Capitalism and Colonial Economy):-
ধনতন্ত্র বনাম সাম্রাজ্যবাদ :-
ভৌগােলিক আবিষ্কারের পর উপনিবেশ গঠনের নামে সাম্রাজ্যবাদ ও বাণিজ্যের মাধ্যমে নির্লজ্জ অর্থশােষণের ফলে ইউরােপীয় ধনতন্ত্রের (European Capitalism) উন্মেষ ঘটতে থাকে। ল্যাটিন শব্দ ‘Capitalis' যার অর্থ সঞ্চিত অর্থ, সুদ ও পণ্য থেকে ‘ক্যাপিটাল’ কথাটি এসেছে (১২৮৩)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উপর সাম্রাজ্যবাদী থাবা বসিয়ে ইউরােপীয় বণিক ও শাসকরা অর্থাগমের পথ প্রশস্ত করেছিল। এতিহাসিক ড, রজনি পাম দত্ত বলেন “ভারতের অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ পুঁজিবাদের সমৃদ্ধি ঘটেছিল।”
অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথের (১৭২৩-১৭৯০ খ্রিঃ) ‘ওয়েলথ অব নেশনস’* (১৭৭৬) ও পি. জে. মার্শালের ইস্ট ইন্ডিয়া ফরচুন’গ্রন্থে ইউরােপীয় ধনতন্ত্রের উত্থানে দেশে-দেশে ঔপনিবেশিক শােষণমূলক অর্থনীতিকে দায়ী করেছেন। ‘সম্পদের নির্গমন’ ও ‘অবশিল্পায়নের’ এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা ছিল। সম্পদের নির্গমন বলতে বােঝায় ভারতের সম্পদ বেনামে, ব্যক্তিগত বাণিজ্যের দ্বারা হুন্ডি, পলকাটা হিরের মাধ্যমে দিনেমার বাণিজ্য সংস্থার মাধ্যমে ইংল্যান্ডে চলে যাওয়া। জর্জ সলিভ্যান গঙ্গার তীর থেকে সম্পদ টেমসের তীরে স্থূপীকৃত হওয়াকে সম্পদের নির্গমন (Drain of Wealth) বলেছেন। আর অবশিল্পায়ন (de-industrialisation) হল নতুন শিল্প না গড়া, কুটিরশিল্পের ধ্বংস, ভারী ও যন্ত্রশিল্পের পত্তন না করা ইত্যাদি। এককথায় ভারতীয় শিল্পের ধ্বংসসাধন। প্রধানত ইংল্যান্ডের শিল্পবিপ্লব, অবাধ বাণিজ্যভিত্তিক পুঁজিবাদ ও ঔপনিবেশিক নীতি ইউরােপীয় পুঁজিবাদের বিকাশ ত্বরান্বিত করেছিল।
মার্কেনটাইল অর্থনীতির রূপান্তরঃ-
মার্কেনটাইল অর্থনীতি ভেঙে গিয়ে নতুন এক মুক্ত বাণিজ্যনীতির (Lessaiz faire policy) জন্ম হয়। ফলে ব্রিটিশ অর্থনীতি অনেকটা বিপথগামী হয়ে পড়ে। আবার মার্কেনটাইল নামে সংরক্ষিত বাণিজ্যনীতির কিছু তাত্ত্বিক দিক ছিল। যাইহােক ইউরােপীয়রা বিশ্ববাণিজ্যের দিকে চালিত হয় মুক্ত বাণিজ্যনীতি চালু হওয়ার পর।
ইংরেজরা ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠনের পর একে একে সুরাট (১৬১২ খ্রিঃ), মাদ্রাজ (১৬৩৯ খ্রিঃ), ঢাকা (১৬৬৮ খ্রিঃ), বােম্বে (১৬৬৯ খ্রিঃ) ও কলকাতায় (১৬৯৬ খ্রিঃ) বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেছিল। ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্যের ‘সনদ’ (Charter) লাভ ও ১৭০৮ খ্রিস্টাব্দে তা নবীকরণের মাধ্যমে কোম্পানি এদেশে ধনতন্ত্রের ভিত মজবুত করে তােলে। এর আবার তিনটি ভাগ হল বণিকপুঁজি (সপ্তদশ-উনিশ শতক), শিল্পপুঁজি (১৮১৩-১৮৫৭ খ্রিঃ) ও মহাজনি পুঁজির যুগ (১৮৫৮-১৯৪৭ খ্রিঃ)।
১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে ‘হফ্তম আইন’-এ জমিদারদের কৃষকদের উচ্ছেদ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। পরে ‘পনজম আইন’-এও একই নীতি কার্যকর থাকে। ‘দাদন প্রথা’র সুবাদে ১০ থেকে ৪০ ভাগ কম দামে কোম্পানি কাঁচামাল কিনত। এতে দেশীয় শিল্পের চরম সর্বনাশ ঘটেছিল। শিল্পপুঁজির যুগে (Age of Industrial Capital) ভারতীয় শিল্পের দ্রুত জ্বংসসাধন ও ইউরােপীয় শিল্পমূলধন বা ধনতন্ত্রের অগ্রগতি ঘটতে থাকে। এইভাবে ইউরােপীয় ধনতন্ত্রের প্রসারের ফলে সামগ্রিকভাবে ভারতীয় কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনীতির অন্যান্য ক্ষেত্রে ধ্বংসাত্মক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। লেনিন বলেছিলেন, “নির্ভেজাল ব্রিটিশ একনায়কতন্ত্রের কাছে একান্ত নির্মমভাবে ও সামন্ততান্ত্রিক কায়দায় প্রায় ৩০ কোটি ভারতীয় লুণ্ঠিত হচ্ছেন।”

0 মন্তব্যসমূহ