মোগল সাম্রাজ্যে আকবরের কৃতিত্ব বর্ণনা কর | নবম শ্রেণী অথবা, মোগল সাম্রাজ্যের প্রসারে আকবর শাহাজাহান ঔরঙ্গজেবের কৃতিত্ব আলোচনা করো | ঔরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিঃ), শাহজাহান (১৬২৮-১৬৫৮ খ্রিঃ), আকবরের ধর্মনীতি, আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিঃ),নবম শ্রেণী

মোগল সাম্রাজ্যে আকবরের কৃতিত্ব বর্ণনা কর | নবম শ্রেণী

 অথবা,

মোগল সাম্রাজ্যের প্রসারে আকবর, শাহাজাহান ঔরঙ্গজেবের কৃতিত্ব আলোচনা করো । নবম শ্রেণী

আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিঃ):-


আকবর সিংহাসনে আরােহণের পর একটানা চল্লিশ বছর ধরে বিভিন্ন রাজ্য জয়। করে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। ঐতিহাসিক শ্ৰীমতী বেভারিজ তাই আকবরকে ঘাের সাম্রাজ্যবাদীরূপে চিহ্নিত করে বলেছেন,“আকবর ছিলেন এমন এক শক্তিশালী ও বলিষ্ঠ সাম্রাজ্যবাদী, যাঁর সাম্রাজ্যবাদী সূর্যালােকের কাছে ডালহৌসিরসাম্রাজ্যবাদী তারকা অতি ম্লান।”*১




রাজ্যজয় :-


আকবর তাঁর বাল্য অভিভাবক বৈরাম খাঁর সাহায্য নিয়ে পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধে আদিল শাহের হিন্দু সেনাপতি হিমুকে পরাস্ত করে (১৫৫৬ খ্রিঃ) দিল্লি ও আগ্রা দখল করেন। বৈরাম খাঁর অভিভাবকত্ব ও সাহায্য নিয়ে আকবর চার বছরের (১৫৫৬-১৫৬০ খ্রিঃ) মধ্যে আজমির, জৌনপুর ও গােয়ালিয়র জয় করেন। গণ্ডােয়ানা ছিল, মধ্যপ্রদেশের একটি ছােট্ট রাজ্য। এর রাজধানী ছিল। জব্বলপুরের গড়কাটাতে । হঠাৎ আকবরের বিনা অনুমতিতে তার সেনাপতি আসফ খাঁ গণ্ডােয়ানা রাজ্য আক্রমণ করে বীরনারায়ণকে হত্যা করলে রানি দুর্গাবতী অপমানে আত্মহত্যা করেন। ফলে আকবর দলপথ শাহের বংশধর চন্দ্রধর শাহকে গণ্ডােয়ানার সিংহাসনে (১৫৬৪ খ্রিঃ) বসিয়ে তাঁকে বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করেন।

রাজপুতনীতিঃ-


চিতােরের পতনের পর রণথম্বােরের রানা সুরজন রাই আকবরের সঙ্গে যুদ্ধ করা বৃথা ভেবে ১৫৬৯ খ্রিঃ ফেব্রুয়ারি আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন। তারপর ১৫৬৯ খ্রিঃ আগস্ট মাসে কালিঞ্জরের শাসকও

আকবরের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেন। এইভাবে কালিঞ্জুর ও রণথম্বাের অধিকারের ফলে আকবরের সম্মান বৃদ্ধি পায়। ১৫৭০" খ্রিঃ জয়সলমিরের শাসক হর রাই তার কন্যাকে আকবরের সাথে বিবাহ দিয়ে পারস্পরিক সুসম্পর্ক গড়ে তােলেন। ১৫৭৬ খ্রিঃ হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবরের সেনাপতি মানসিংহ মেবারের রানা প্রতাপ সিংহকে পরাস্ত করলে মেবার মােগলদের অধীন হয়। ১৫৭৬ খ্রিঃ দাউদ খাঁকে    রাজমহলের যুদ্ধে পরাস্ত করেন এবং তাঁর স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত ব্রাক্ষ্মণ সেনাপতি ‘কালাপাহাড়’ গুরুতর আহত হন। বন্দি দাউদকে নিয়ে গিয়ে তােডরমল তাকে হত্যা করেন।

বারাে ভূইয়া সমস্যাঃ-


১৫৭৬ খ্রিঃ বাংলা ও বিহার মােগল সাম্রাজ্যভুক্ত হলেও বাংলা হিন্দু-মুসলিম বহু জমিদার (চাদ রায়, কেদার রায়, প্রতাপাদিত্য, ইশা খাঁ, মুশা খাঁ প্রমুখ) মােগলদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এঁরা বাংলার বিখ্যাত বারাে ভূঁইয়া’ নামে পরিচিত। আকবরের সেনাপতি মানসিংহ বারাে ভূঁইয়াদের পরাস্ত করে বাংলায়। শান্তি স্থাপন করেছিলেন।তাঁর জীবনে শেষ যুদ্ধ হল আসিরগড় যুদ্ধ (১৬০১)।

আকবরের ধর্মনীতি :-

ধর্মসহিষ্ণু ও উদার মনােভাবাপন্ন আকবর ‘আধ্যাত্মিক  সংকট’ নিরসনের জন্য ‘দার-উল ইসলাম’ ও ‘দার-উল-হার্ব’- এর দেশ ভারতবর্ষকে ‘সলহইকল’ বা ধর্মসহিষ্ণুতার দেশে পরিণত করেছিলেন। প্রথমে তীর্থকর’(১৫৬৩) ও পরে। ১৫৬৪ খ্রিঃ তিনি হিন্দুদের উপর থেকে “জিজিয়া কর’ তুলে দেন। 

 দীন-ই-ইলাহিঃ-

আগ্রার কাছে ফতেপুর সিক্রিতে ১৫৭৫-৭৬ খ্রিঃ ইবাদৎখানা (উপাসনাগৃহ) গঠনের পর তাঁর ধর্মীয় ভাবান্তর ঘটে। তাই ১৫৭৮ খ্রিঃ অক্টোবর ইবাদৎখানাতে হিন্দুপণ্ডিত পুরুষােত্তম, জৈনগুরু বিজয়সেন সূরী, হরিবিজয় সূরী, জেসুইটপন্থী ফাদার মনসারেট, অ্যাকোয়া ভাইভা, জরাথুস্ট্রপঙ্খী, বৌদ্ধ, নাস্তিক, শিয়া ও সন্নিপন্থী মুসলমান প্রভৃতি সব ধর্মের পণ্ডিত ও শাস্ত্রজ্ঞদের আমন্ত্রণ জানান। ১৫৭৮ খ্রিঃ তিনি মাংস খাদ্যতালিকা থেকে বাদ দেন। ১৫৭৯ খ্রিঃ ২ সেপ্টেম্বর এক ‘মাহজার’ (Mahzar) নামায় আকবর নিজেকে কোরানের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকার বলে ঘােষণা করেন। ১৫৮২ খ্রিঃ আকবর। ৯৪ ইলাহি বা সর্বধর্মের সারবস্তু বা পবিত্র ধর্মমত প্রচার করেন। তিনি রাজপুতদের। আগে যুদ্ধনীতি এড়িয়ে বৈবাহিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলেন। আকবর নিজেই। বিয়ে করেন বিহারীমলের কন্যা যােধাবাই ও পুত্র সেলিমকে ভগবানদাসের কন্যা মানবাইএর সাথে বিয়ে দেন। মানসিংকে ১০,০০০ মনসব দিয়েছিলেন।

জাহাঙ্গির (১৬০৫-১৬২৭ খ্রিঃ):-


জাহাঙ্গিরের রাজত্বকালে বাংলার সিপাহসালার ইসলাম খাঁ প্রথমে আফগান নেতা আলিকুলি বেগকে হত্যা

করে তার স্ত্রী মেহেরউন্নিসাকে জাহাঙ্গিরের (আসল নাম সেলিম) হাতে তুলে দেন ।

পাদশা বেগমঃ-


১৬১১-১৬২৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মাদকাসক্ত জাহাঙ্গিরের সমস্ত কাজকর্ম নুরজাহানের নির্দেশে চালিত হয়েছিল। এইসময়: নুর মহল বা নুরজাহান (মেহেরউন্নিসা) তাঁর পিতা মির্জা গিয়াস বেগ (উপাধি—ইতিমাদ উদ-দৌলা’) ও দুই ভাতা আসফ খাঁন ও ইমদ খাঁনকে উচ্চপদে নিয়ােগ করেছিলেন। জাহাঙ্গিরের দুর্বলতার জন্য শাসনব্যবস্থায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল বুদ্ধিমতী নুরজাহানের সুদক্ষ পরিচালনার ফলে সেই শূন্যতা লীন হয়। তিনি নিজগুণেই ‘পাদশা বেগম’ হয়েছিলেন। 

শাহজাহান (১৬২৮-১৬৫৮ খ্রিঃ):- 


সাংস্কৃতিক অগ্রগতি যদি সুবর্ণযুগের শর্ত হয়ে থাকে, তবে জাহাঙ্গিরের তৃতীয় পুত্র শাহজাহান (খুররম্‌) সেই সুবর্ণযুগের রূপকার । আপন সৃজনীপ্রতিভা ও সহজাত কাব্যিক অনুভূতি কাজে লাগিয়ে তিনি সংস্কৃতির সংরক্ষণ, সংস্কার ও সম্প্রসারণে সফল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। জাহাঙ্গিরের মৃত্যুর (১৬২৭, ২৮ অক্টোবর) চার মাস পর তাঁর পুত্র শাহজাহান বা ‘বিশ্ববিজেতা’ (১৬২৮ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে) সম্রাট হন। তাঁর দীর্ঘ ৩০ বছর রাজত্বে রাজনৈতিক শান্তি, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সাহিত্য ও শিল্প- স্থাপত্যের চরম উন্নতি ঘটে। এই সময়কে মােগল ইতিহাসের ‘সুবর্ণযুগ’ বলে) কিন্তু প্রশাসন ও সামরিক ক্ষেত্রে অবক্ষয়ের ছাপ দেখা গিয়েছিল। এদিক থেকে বাবর যদি মােগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং আকবর যদি প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা হন, তবে শাহজাহান সেই সাম্রাজ্যকে সৌন্দর্যে ভরিয়ে তুলেছিলেন। অবশ্য পূর্বসূরিদের । সামগ্রিক উন্নতির পথ ধরে শাহজাহান সুবর্ণযুগের স্রষ্টা হয়ে। উঠেছিলেন সাংস্কৃতিক অগ্রগতি যদি সুবর্ণযুগের শর্ত হয়ে থাকে, তবে শাহজাহান সেই সুবর্ণযুগের রূপকার রাজনৈতিক ঐক্য শাহজাহানের সময় সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য থেকে শাহজাহানের সময় প্রতি বছর আয় হত ২২৮ কোটি টাকা। শাহজাহানের। রাজত্বকাল ছিল কৃষির ক্ষেত্রে চরম শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ। 





শাহজাহানের সভাকবি আবু তালিব কালিম ফারসি ও হিন্দি ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন আবদুল হামিদ লাহােরির ‘পাদশাহনামা', এনায়েত আলি খাঁর ‘শাহজাহাননামা’, কাফি খাঁর ‘মুন্তাখাব-উল-লুবার’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য রচনা। তাঁর সময়কার উল্লেখযােগ্য স্থাপত্য নিদর্শনগুলির মধ্যে ‘মােতি মসজিদ’, ‘জুম্মা মসজিদ’, ‘খাসমহল’, ‘শিশমহল’, ‘জামই- মসজিদ’, ‘তাজমহল’, ‘দেওয়ান-ই-খাস’, লালকেল্লা ইত্যাদি সুবর্ণ যুগের স্বাক্ষর বহন করছে।

ঔরঙ্গজেব (১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিঃ):-


শাহজাহানের রাজত্বকালে ঔরঙ্গজেব (উপাধি ‘আলমগির’)  দাক্ষিণাত্যের সুবাদার নিযুক্ত হয়েছিলেন তাঁর ১৬৫৮ খ্রিঃ সিংহাসনে আরােহণের পর দাক্ষিণাত্যের দিকেই। সর্বদা নজর রেখেছিলেন। তার পঞ্চাশ বছর রাজত্বের শেষ পচিশ। বছর অর্থাৎ ১৬৮২-১৭০৭ খ্রিঃ পর্যন্ত তিনি দাক্ষিণাত্যে অতিবাহিত করেছিলেন। এই দীর্ঘ সময় তিনি দাক্ষিণাত্যে অতিবাহিত করেছিলেন। মূলত দুটি উদ্দেশ্যে 

(১) বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা নামক শিয়া রাজ্যদুটিকে পদানত করা এবং 

(২) শক্তিশালী মারাঠা জাতিকে ধ্বংস করা। শিবাজিকে তিনি দমন করতে ব্যর্থ হন। 

দাক্ষিণাত্যের  বিজাপুর জয়ঃ-

১৬৬৫, ১৬৮০ এবং ১৬৮২ খ্রিঃ সেনাপতি জয়সিংহ, দিলির খাঁ ও শাহজাদা আজমের।নেতৃত্বে ঔরঙ্গজেব একাদিক্রমে তিনটি অভিযান পাঠালেও প্রতিক্ষেত্রে।  মােগল বাহিনী ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসে। অবশেষে ঔরঙ্গজেব নিজেই| সৈন্যবাহিনী নিয়ে বিজাপুর রাজ্য অবরােধ করলে সেখানকার শাহি বংশীয় তরুণ শাসক সিকন্দর কুর্নিশ জানিয়ে বশ্যতা স্বীকার করেন।

দাক্ষিণাত্যের গোলকুণ্ডা জয়ঃ-


১৬৮৭ খ্রিঃ ৭ ফেব্রুয়ারি মােগল বাহিনী আবদুল্লা পানি নামক এক বিশ্বাসঘাতকের সাহায্যে গােলকুণ্ড সম্পূর্ণরুপে দখলে আনে। ঔরঙ্গজেব যখন সর্বশক্তি প্রয়ােগ করে মারাঠাদের উপর আক্রমণ শুরু করেছেন, তখন শম্ভুজি রত্নগিরির উত্তর-পূর্বে ২০ মাইল দূরে সােমেশ্বরে রং-তামাশায় মেতে ছিলেন। ১৬৮৯ খ্রিঃ ১ ফেব্রুয়ারি মােগল বাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করতে শম্ভুজির প্রধানমন্ত্রী কবি কালাশ ব্যর্থ হলে শম্ভুজি ও তাঁর ২৫ জন সঙ্গী বন্দি হন। ২১ দিন ধরে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে ১৬৮৯ খ্রিঃ ১১ মার্চ শম্ভুজি ও অন্যান্য ধৃতদের হত্যা করা হয়। ইতিমধ্যে রায়গড়ের সিংহাসনে শম্ভুজির কনিষ্ঠ ভাই রাজারাম বসেন (৮ ফেব্রুয়ারি)। ১৯ অক্টোবর মােগল বাহিনী রাজধানী রায়গড় আক্রমণ করলে রাজারাম জিঞ্জি দুর্গে পালিয়ে যান। কিন্তু শম্ভুজির সাত বছর বয়স্ক পুত্র শাহ্ ও রাজপরিবারের অনেকে বন্দি হন। প্রায় আট বছর (১৬৯০-৯৮ খ্রিঃ) অবরােধের পর জিঞ্জি মােগল অধিকারে আসে। ১৬৯৭ খ্রিঃ তাঞ্জোর ও ত্রিচিনাপল্লি নামক হিন্দু রাজ্যদুটি মােগল অধিকারে আসে।


     ১৬৭৯ খ্রিঃ হিন্দুদের উপর “জিজিয়া কর’ পুনঃপ্রবর্তনের পর থেকে তিনি ধর্মবিদ্বেষী হয়ে উঠেছিলেন। ঔরঙ্গজেব ১৬৮২-১৭০৭ খ্রিঃ দাক্ষিণাত্যে অবস্থান করেছিলেন। ড. স্মিথের মতে, দাক্ষিণাত্যেই ঔরঙ্গজেব ও মােগল সাম্রাজ্যের সমাধি রচিত হয়েছিল। ড. যদুনাথ সরকার বলেন, নেপােলিয়নের ‘স্পেনের ক্ষতের’

মতাে ঔরঙ্গজেবের ‘দাক্ষিণাত্যের ক্ষতই’ তাঁকে ধ্বংস করেছে। দাক্ষিণাত্যে অবিরাম যুদ্ধে সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ