ভৌত রাশি বা প্রাকৃতিক রাশি
দৈনন্দিন জীবনে আমরা বিভিন্ন জিনিস, জিনিস পরিমাপ করি। উদাহরণস্বরূপ, ধরুন একজন লোক একটি মুদি দোকানে গিয়ে দোকানদার থেকে এক কিলো ডাল, এক লিটার তেল এবং 100 গ্রাম হলুদ চায়। এরপর তিনি বাড়ি ফিরে আসেন। বাজার থেকে বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন যে তাকে আসতে বিশ মিনিট লেগেছে।
এর মধ্যে দুটি উদাহরণ আমাদের কাছে স্পষ্ট।
আমরা ডালের ভর পরিমাপ করতে কিলোগ্রাম ব্যবহার করেছি, তেল পরিমাপ করতে লিটার এবং সময় পরিমাপের জন্য মিনিট।
অর্থাৎ, আমরা ভর, আয়তন এবং সময় পরিমাপ করতে পারি, তাই তারা হয় পরিমাণ বা ভৌত পরিমাণ।
গ্রাম কিলোগ্রাম, লিটার এবং মিনিট এরা একক। ।
রাশির সংজ্ঞাঃ-
প্রাকৃতিক বস্তু, ঘটনা ইত্যাদি সম্পর্কে যা পরিমাপ করা যায় তাকে ভৌত পরিমাণ বা প্রাকৃতিক পরিমাণ বলা হয়, অর্থাৎ যা পরিমাপ করা যায় তাকে পরিমাণ বলা যেতে পারে। দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, ভর, আয়তন, ঘনত্বের মতো সব পরিমাণ কারণ তারা পরিমাপ করা যায়।
দিকনির্দেশ অনুযায়ী মূলত দুই ধরনের রাশি আছে।
1. স্কেলার রাশি এবং 2. ভেক্টর রাশি ।
স্কেলার রাশি: - যেসব রাশির শুধুমাত্র মান আছে কিন্তু কোন অভিমুখ নেই তাদেরকে আমরা স্কেলার রাশি বা দিকহীন বলি ।
আমরা এমন স্কেল বলি যার শুধুমাত্র মান আছে কিন্তু দিকনির্দেশক, স্কেলার বা দিকনির্দেশক নয়। উদাহরণস্বরূপ, দৈর্ঘ্য, ভর, আয়তন, এলাকা, গতি, সময় ইত্যাদি, কারণ তাদের কেবল মান আছে কিন্তু কোন দিক নেই। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি পাইপের দৈর্ঘ্য 2 মিটার হয়, এর অর্থ কেবল পাইপের দৈর্ঘ্য।
ভেক্টর রাশি: - যে পরিমাণের মান এবং দিক উভয়ই আছে তাকে ভেক্টর রাশি বলে । যেমন- ওজন, বেগ, ত্বরণ, বল, স্থানচ্যুতি ইত্যাদি পরিমাণ ভেক্টর পরিমাণ। ধরুন একটি বাইক 40 কিমি / ঘন্টা গতিতে উত্তর দিকে যাচ্ছে। এখানে বেগের মান 40 কিমি / ঘন্টা এবং দিকটি উত্তর।
স্কেলার রাশি ও ভেক্টর রাশির পার্থক্য
স্কেলার রাশি ও ভেক্টর রাশির পার্থক্যগুলি নিচে উল্লেখ করা হল— -
স্কেলার রাশি ভেক্টর রাশি
স্কেলার রাশির শুধুমাত্র মান আছে কিন্তু কোনরকম ভেক্টর রাশির মান আছে এবং সাথে দিক বা অভিমুখ নির্দেশ করে থাকে।
দুটো স্কেলার রাশি গুণফল সর্বদা স্কেলার রাশি হয়। দুটি ভেক্টরের গুণ করলে গুণফল একটি ভেক্টর রাশি বা স্কেলার রাশিও হতে পারে।
দুটি স্কেলার রাশির মান শূন্য না হলে এদের গুণফল দুটি ভেক্টর রাশির মধ্যে একটির মান যদি কখনোই শূন্য হবে না। শূন্য হয় তাহলে এদের গুণফল ফল শূন্য হতে পারে।
স্কেলার রাশি সাধারণ গাণিতিক নিয়মে যোগ বিয়োগ ভেক্টর রাশি সাধারণ গাণিতিক নিয়মে যোগ গুন ভাগ করা যায় । বিয়োগ গুন ভাগ করা যায় না।
স্কেলার রাশি শুধুমাত্র মান পরিবর্তন করলে এর ভেক্টর রাশি পরিবর্তন করতে গেলে মান অথবা
মান পরিবর্তন হয়। দিক উভয়ের পরিবর্তন করতে হয়।
এই ছিল স্কেলার ও ভেক্টর রাশির মধ্যে পার্থক্য।
পরিমাপের একক এবং এককের প্রয়োজনীয়তা
আধুনিক বিজ্ঞান পরিমাপের উপর দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কোন রাশির আনুমানিক পরিমাপ করতে সক্ষম কিন্তু সঠিক এবং নির্ভুল পরিমাপ শুধু ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে করা সম্ভব না। একটি উদাহরণের সাথে বোঝা যাক—
আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রমেশের উচ্চতা সম্বন্ধে কেউ জিজ্ঞাসা করলে আমি বলতে পারি আনুমানিক ৫ ফুট কিন্তু স্কেল দিয়ে মাপলে দেখা গেল রমেশের উচ্চতা ৫ ফুট ২ ইঞ্চি। সুতরাং কোন রাশির সঠিক মাপ জানার জন্য নির্ভুল পরিমাপের প্রয়োজন। কোন ভৌত রাশির মান প্রকাশ করতে হলে দুটি বিষয়ের প্রয়োজন ১. রাশির একক এবং ২. এককের তুলনায় রাশিটি কত গুণ সেই সংখ্যা ।
পরিমাপের একক কাকে বলে বা কি ( সংজ্ঞা)
কোন একটির ভৌত রাশির একটি নির্দিষ্ট এবং সুবিধাজনক পরিমাণকে প্রমাণ রাশি ধরে, প্রদত্ত রাশিটির পরিমাণ, এই প্রমাণ মানের কতগুণ হয় হিসাব করে, ওই জাতীয় সব রাশির পরিমাপ করা হয়। এই নির্দিষ্ট প্রমাণ রাশিকে পরিমাপের একক বলে। ।
পরিমেপের একক কি (সংজ্ঞা)
একজনের দৈহিক পরিমাণের একটি নির্দিষ্ট এবং সুবিধাজনক পরিমাণকে প্রমাণ রাশি হিসাবে গ্রহণ করা হয়, প্রদত্ত পরিমাণটি এই সমস্ত পরিমাণ দ্বারা প্রমাণ মানকে গুণ করে গণনা করা হয়। এই বিশেষ প্রমাণকে পরিমাপের একক বলা হয়।
এককের প্রয়োজনীয়তা
কোনো ভৌত রাশিকে পরিমাপ করতে হলে নির্দিষ্ট এককের প্রয়োজনীয়তা আছে। কারন ভৌত রাশির পরিমাপের ক্ষেত্রে একক-বিহীন সংখ্যা অর্থহীন হতে পারে। যেমন – বাঁশটি বেশ লম্বা বললে বাঁশটির দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে এক একজনের মনে এক রকম ধারণা হবে। কিন্তু বাঁশটিকে ২০ ফুট লম্বা বললে বাঁশটি দৈর্ঘ্য সম্বন্ধে আমাদের সকলের মনের সঠিক ধারণা তৈরি হয়। এখানে দৈর্ঘ্য একটি ভৌত রাশি । এই পরিমাপের জন্য ফুটকে একটি একক রূপে ব্যবহার করা হয়েছে । ১ ফুট কতটা লম্বা জানা আছে সকলের। কাজেই বোঝা গেল বাঁশের দৈর্ঘ ১ ফুট দৈর্ঘ্যের কুড়ি গুন।
বাজার থেকে অনেক চাল কেনা হলো অথবা বাজার থেকে ১০০ চাল কেনা হলো একথা বললে চালের সঠিক পরিমাণ সম্বন্ধে কিছু ধারণা করা যায় না। কিন্তু যদি বলা হয় যে বাজার থেকে ১০০ কেজি চাল কেনা হয়েছে তাহলে এখানে চালের পরিমাণটি সঠিক বোঝা যায়। এখানে কিলোগ্রামকে ভরের একক হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
কলকাতা থেকে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি এলাম বললে কোলকাতা থেকে বাড়ি আসতে ঠিক কতটা সময় লাগলো তার সঠিক ধারণা করা সম্ভব হলো না। তবে যদি বলা হয় কলকাতা থেকে ফিরতে ১ ঘণ্টা সময় লেগেছে তাহলে স্বচ্ছ ধারনা হয়। এখানে ঘণ্টাকে সময়ের একক রূপে ব্যবহার করা হয়েছে।
সুতরাং দেখা গেলো প্রত্যেক ভৌত বা প্রাকৃতিক রাশি সঠিক পরিমাপের জন্য একটি এককের প্রয়োজন। এককহীন পরিমাপের কোন মানে হয় না। একক না থাকলে কোন রাশি পরিমাপ করা যায় না। ভৌত রাশি পরিমাপের দুটি অংশ প্রথমটি হলো সংখ্যা এবং দ্বিতীয়টি হলো একক।
বিভিন্ন ভৌতরাশির এককগুলি পরম্পর আলাদা হয়। কিন্তু এই অসংখ্য ভৌতরাশির এককণুলিকে মাত্র তিনটি রাশির এককের সাহায্যে প্রকাশ করা যায়। এই রাশি তিনটি হল দৈর্ঘ্য, ভর ও সময়।
মৌলিক একক কাকে বলে
পদার্থবিজ্ঞানে হাজার ভৌত রাশি আছে, যেখানে দেখা গেছে রাশির সংখ্যা অনেক হলেও মাত্র তিনটি রাশির একক এর সাহায্যে বাকি সকল রাশির একক গুলিকে সহজে প্রকাশ করা যায়। এই তিনটি রাশি হলো দৈর্ঘ্য, ভর, এবং সময়। এই তিনটি রাশির এককগুলি পরস্পরের উপর নির্ভরশীল নয় অর্থাৎ একটি অন্যটির উপর নির্ভর করে না। সেই জন্য দৈর্ঘ্য, ভর, এবং সময়ের একককে মূল একক বা মৌলিক একক বা প্রাথমিক একক বলা হয়।
আগে প্রধানত তিনটি পদ্ধতিতে প্রাথমিক এককগুলিকে প্রকাশ করা হত। বর্তমানে সারা পৃথিবীতে পরিমাপের আন্তর্জাতিক একক পদ্ধতি (Intenational System of Units) বা S.I. একের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে।
মূল এককের বিভিন্ন পদ্ধতি
মূল একককের প্রকাশ পদ্ধতি বর্তমানে প্রধানত তিনটি
সি জি এস পদ্ধতি বা মেট্রিক পদ্ধতিঃ-
সি জি এস পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একককে সেন্টিমিটার, ভরের একক গ্রাম এবং সময়ের একক সেকেন্ড দ্বারা প্রকাশ করা হয়। সেন্টিমিটার-গ্রাম-সেকেন্ড (C.G.S. Framework) পদ্ধতিতে দৈর্য্যের একক সেন্টিমিটার, ভরের একক গ্রাম, এবং সময়ের একক সেকেন্ড। C.G.S. পদ্ধতিতে C অক্ষরটি সেন্টিমিটার G অক্ষরটি গ্রাম এবং S অক্ষর সেকেন্ড বোঝায় । একে সংক্ষেপে সি-জি-এস (C.G.S.) বা মেট্রিক পদ্ধতি বলে। মেট্রিক পদ্ধতিতে দৈর্য্য এবং ভরের এককের ভগ্মাংশ এবং গুণিতাংশগুলাে একে অন্যের সঙ্গে দশ বা দশের বিভিন্ন ধাত (power) দ্বারা সম্বন্ধযুক্ত । এই কারণে পদ্ধতিটিকে দশমিক পদ্ধতি বলা হয়। এই পদ্ধতিতে এক একক থেকে অন্য এককে যেতে দশমিক বিন্দুকে ডান বা বামদিকে এক বা একাধিক ঘর সরাতে হয়। যেমন, 27.35 সেন্টিমিটার = 273.5 মিলিমিটার এবং 52.5 গ্রাম = 5.25 ডেকাগ্রাম । এই কারণে সি-জি-এস পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্য ও ভরের গণনা করা সহজ হয়।
FPS পদ্ধতি বা ব্রিটিশ পদ্ধতিঃ-
FPS পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একক কি ফুট ভরের একক পাউন্ড এবং সময়ের একক সেকেন্ড দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এখানে F অক্ষরটি ফূট P অক্ষরটি পাউন্ড এবং S অক্ষর টি সেকেন্ড বোঝায়। আগেকার দিনে ব্রিটিশ কমনওয়েলথ দেশগুলিতে এই পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। একে সংক্ষেপে এফ পি এস.পদ্ধতি বলা হত। বর্তমানে ব্রিটিশ পদ্ধতি এমনকি ব্রিটেনেও অপ্রচলিত হয়ে গেছে।
এম কে এস পদ্ধতি ঃ-
এই পদ্ধতিতে দৈর্ঘ্যের একক মিটার ভরের একক কিলোগ্রাম এবং সময়কে সেকেন্ড দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এখানে M অক্ষরটি মিটার K অক্ষরটি কিলোগ্রাম এবং S অক্ষর টি সেকেন্ড বোঝায়।
বর্তমানে সারা বিশ্বে এম কে এস পদ্ধতিকেই আন্তর্জাতিক একক এসআই ইউনিট পদ্ধতির স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু সিজিএস পদ্ধতি ও অনেক ক্ষেত্রে প্রচলিত আছে। 1964 সালে ওজন ও পরিমাপের আন্তর্জাতিক কমিটি এককের এই পদ্ধতিটি অনুমােদন করেন। বর্তমানে আমাদের দেশে এই পদ্ধতিটির ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে। এম-কে-এস পদ্ধতিতে প্রকৃতপক্ষে দৈর্ঘ্য, ভর ও সময়ের এককের আন্তর্জাতিক পদ্ধতি।
(International System of units) আন্তর্জাতিক একক বা এস-আই পদ্ধতিঃ-
একক নির্ধারণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা 1960 সালে এই পদ্ধতির প্রবর্তন করেন। এই পদ্ধতিতে এম.কে.এস. পদ্ধতির মৌলিক এককগুলির সঙ্গে আরও তিনটি রাশির একককে নেওয়া হয়েছে। এখানে দৈর্ঘ্য, ভর, সময়, তডিৎপ্রবাহ, উষ্ণতা ও আলােক দীপ্তির মৌলিক এককগুলি হল যথাক্রমে মিটার, কিলােগ্রাম, সেকেন্ড, অ্যাম্পিয়ার,ক্যান্ডেলা ও কেলভিন হলো এর উদাহরণ। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক কাজকর্মের জন্য পৃথিবীর সব দেশে এস-আই পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে।
0 মন্তব্যসমূহ