সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা যায়। সিপাহী বিদ্রোহের কারণ কি? সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হল কেন ?

সিপাহী বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা যায়। সিপাহী বিদ্রোহের কারণ কি? সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থ হল কেন ? 

ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম

সিপাহী বিদ্রোহের কারণঃ- 

পঞ্জাবের শিখ-রাজ্যে ব্রিটিশ অধিকার স্থাপন করেছিলেন বড়লাট লর্ড ডালহৌসী। লর্ড ওয়েলেসলির মতাে তিনিও ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য প্রসারের জন্য বিশেষ চেষ্টা করেছিলেন। তিনি ব্রহ্মদেশের দক্ষিণাংশ জয় করে কোম্পানির সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। তিনি যে কেবল যুদ্ধ দ্বারা রাজ্য অধিকার করতেন তা নয়। অযােধ্যার নবাবের কশাসনের অজুহাতে তিনি তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়েছিলেন। 


হায়দরাবাদের নিজাম কোম্পানির প্রাপ্য টাকা দিতে না পারায় তিনি নিজাম রাজ্যের অন্তর্গত বেরার প্রদেশ দখল করেন। সাতারা, ঝাঁসি, নাগপুর প্রভৃতি রাজ্যের রাজারা অপুত্রক অবস্থায় মারা যান। তখন লর্ড ডালহৌসী ঐ সকল রাজ্য অধিকার করেন। রাজাদের পােষ্যপুত্রদের রাজ্য পাবার অধিকার তিনি অস্বীকার করেন। শেষ পেশােয়া বাজীরাওকে যুদ্ধে পরাজিত করে কোম্পানি তাঁর রাজ্য কেড়ে নিয়েছিল এবং তাঁকে ভরণপােষণের জন্য বৃত্তি দিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পােষ্যপুত্র নানা সাহেবকে লর্ড ডালহৌসী এই বৃত্তি দিলেন না।


এভাবে দেশীয় রাজাদের রাজ্য অধিকার করে লর্ড ডালহৌসী সমগ্র ভারতে আতঙ্কের সষ্টি করেছিলেন। যে সকল রাজার রাজ্য তখনও যায় নাই তাঁরাও রাজ্য হারাবার হয়ে ভীত হয়ে পড়লেন। যে সকল রাজ্য ইংরেজদের অধিকারভুক্ত হয়েছিল সেখানকার রাজকর্মচারী, সৈন্য-সামন্ত নানা প্রকারে ক্ষতিগ্রস্ত হলঅযােধ্যার ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রবল অসন্তােষের সৃষ্টি হল। নানা সাহেবের বৃওি লোপে মারাঠারা অসন্তুষ্ট হল। লর্ড ডালহৌসী দিল্লির মুঘল বাদশাহ্‌ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্‌কে দিল্লি থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। মুসলমানেরা এতে খুব অসন্তুষ্ট হয়েছিল।

সিপাহী বিদ্রোহ ব্যর্থতার কারনঃ-

সেকালে কোম্পানির সৈন্যদলে হিন্দু ও মুসলমান সিপাহির সংখ্যাই বেশী ছিল, ইংরেজের সংখ্যা ছিল কম। নানা কারণে সিপাহীদের মনে ধারণা জন্মেছিল যে ইংরেজরা হিন্দু ও মুসলমানের ধর্ম নষ্ট করে ভারতে খ্রিস্ট ধর্ম প্রবর্তন করবে। ধর্মনাশের ভয়ে কোম্পানির প্রতি সিপাহীদের ঘাের বিদ্বেষের সঞ্চার হল। এই সময় কোম্পানির সৈন্যদলের কর্তৃপক্ষ এক রকম নতুন বন্দুক ব্যবহারের হকুম জারি করলেন। এই বন্দুক ব্যবহারের সময় পশু-চর্বিতে প্রস্তুত টোটা দাঁতে কাটতে হত। সিপাহীরা মনে করল যে তাদের ধর্ম নষ্ট করার জন্যই এই নতুন ব্যবস্থা করা হয়েছে। তখন তারা প্রকাশ্যে কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হল।


এই বিদ্রোহের সূত্রপাত হয় কলকাতার নিকটবর্তী বারাকপুরে এবং বহরমপুরেপরে উত্তর ভারতে কানপুর, লক্ষেমৗ, মীরাট, দিল্লি, আম্বালা প্রভৃতি স্থানে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। কানপুরে নানা সাহেব নিজেকে পেশােয়া বলে প্রচার করেন এবং বিদ্রোহী সিপাহীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। দিল্লীতে সিপাহীরা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের বাদশাহ বলে ঘােষণা করেমধ্য ভারতে বিদ্রোহীদের নেতা ছিলেন মারাঠা বীর তাঁতিয়া তােপি এবং ঝাঁসির রানী লক্ষীবাঈ।


বিদ্রোহী সিপাহীরা যুদ্ধক্ষেত্রে সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ইংরেজের প্রবল শক্তির কাছে তারা পরাজিত হল। তাদের মধ্যে ঐক্যের অভাব ছিল। তাদের সংগঠন দুর্বল ছিল। ইংরেজদের মতাে কামান-বন্দুক তাদের ছিল না। বীর নারী লক্ষ্মীবাঈ যুদ্ধধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দিলেন। তাঁতিয়া তােপিকে বন্ধি করে ইংরেজেরা তাকে মৃত্যুদণ্ড দিল। নানা সাহেব নেপালের জঙ্গলে পলায়ন করেন। বাহাদুর শাহকে বন্দী করে ব্রহ্মদেশের অন্তর্গত রেঙ্গুনে প্রেরন করা হল। মুঘল বাদশাহির শেষ চিহ্ন বিলুপ্ত হল।


বিজয়ী ইংরেজরা এই ঘটনার নাম দিয়েছিল ‘সিপাহী’ বিদ্রোহ। প্রকৃতপক্ষে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে এই অভ্যুত্থানকে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম বলা যায়। সিপাহীদের সংগ্রাম যদি সফল হতে তবে ভারতে ইংরেজ-শাসনের অবসান ঘটত। উত্তর ভারতের কোন কোন অঞ্চলে সিপাহীদের সঙ্গে জনসাধারণও বিদ্রোহে যােগ দিয়েছিল।

সিপাহী বিদ্রোহের সময় ভারতের বড়লাট ছিলেন লর্ড ক্যানিং। তিনি কঠোরভাবে বিদ্রোহ দমন করেছিলেন, কিন্তু তিনি সিপাহীদের আচরণের জন্য নিরীহ জনসাধারণকে নির্বিচারে শাস্তি দিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এজন্য প্রতিহিংসাপরায়ণ ইংরেজরা তাঁকে ঠাট্টা করে দয়ালু ক্যানিং বলত।


সিপাহী বিদ্রোহের পর ভারতে কোম্পানির রাজত্বের অবসান হল, ইংলন্ডের রাণী ভিক্টোরিয়া স্বহস্তে শাসনভার গ্রহণ করলেন। ভারতের রাজগণের এবং জনসাধারণের মন থেকে অসন্তােষ দূর করবার জন্য তাঁর নামে একটি ঘােষণাপত্র প্রচার করা হল। এতে বলা হল যে অন্যায়ভাবে কোন দেশীয় রাজ্য অধিকার করা হবে না, হিন্দু ও মুসলমানের ধর্ম বিশবাসে আঘাত দেওয়া হবে না এবং যােগ্যতা থাকলে ভারতবাসীরা বড় বড় সরকারী  চাকরি পাবে।

               খিস্টাব্দ 

১৮৪৮-৫৬ লর্ড ডালহৌসীর শাসনকাল 

১৮৫৬-৬২ লর্ড ক্যানিং-এর শাসনকাল 

১৮৫৭ সিপাহী বিদ্রোহ’ 

১৮৫৮ ইংলন্ডের রানীর স্বহস্তে ভারতের শাসনভার গ্রহণ ও ঘােষণাপত্র প্রচার।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ