বৈদিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্যসমূহ (Features of the Vedic Civilisation) :
আর্য কারা ?
সংস্কৃত শব্দ ‘আর্য’ (Arya) ও পারসি শব্দ ‘আরীয়’ (Ariya) একই; যার অর্থ হল ‘বিশ্বস্তজন’, ‘অভিজাত’ বা ‘এক পবিত্র জাতিভুক্ত মানুষ’ (a noble man) কিন্তু জার্মান পণ্ডিত ফ্রেডরিক ম্যাক্সমুলার (১৮২৩-১৯০৯) বলেন আর্য কোনাে জাতি নয়; এটি একটি ভাষা।
আর্যদের আদি নিবাস নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মূলত দ্বিমত সৃষ্টি হয়েছে। একদল মনে করেন, ইউরােপ, আর অন্যদল তা মনে করেন না, তাদের মতে ভারতই আর্যদের আদি নিবাস এ. সি. দাস ও কাল্লার মতে, কাশ্মীর ও গান্ধারে আর্যরা বাস করতেন। ব্রান্ডেনস্টাইনের মতে, উরাল পর্বতের দক্ষিণে বিস্তীর্ণ কিরঘিজ স্তেপ তৃণভূমি অঞলই। আর্যদের আদি নিবাস। ড. রামশরণ শর্মার মতে ফ্রান্সের আল্পস পাহাড়ের পূর্বে,কারও কারও ধারণা আর্যরা মধ্য এশিয়ার কাস্পিয়ান সাগর অঞ্চলে আদি বাসস্থান বাস করতেন। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, রাশিয়ার দক্ষিণের বিশাল তৃণভূমি আর্যদের আদি বাসভূমি। অর্ধ যাযাবর আর্যরা কয়েকটি গােষ্ঠী বা দলে বিভক্ত হয়ে গ্রিস, রােম, ইরান, ইরাক (পারস্য) ও ভারতে হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে প্রবেশ করে আনুমানিক ১৫০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে। প্রথমে তারা ‘সপ্তসিন্ধু’ অঞ্চলে (ব্ৰত্মাবর্ত), পরে গাঙ্গেয় উপত্যকা ও অন্যান্য অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল।
সামাজিক জীবনের বৈশিষ্ট্যসমূহ :-
(১) একান্নবর্তী পরিবার :-
পরিবার’ বা ‘কুল’ হল আর্য সমাজের মূল ভিত্তি। তবে ঋগ্বেদে (১৫০০-১০০০ খ্রিঃ পূঃ মধ্য লেখা) ‘কুল’ অপেক্ষা ‘গৃহ’ কথাটির বেশি ব্যবহার রয়েছে। ‘পিতৃতান্ত্রিক’ (Patriarchal) আর্য পরিবারে পুরুষের প্রাধান্য বেশি ছিল। পরিবারের বয়ােজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে বলা হত 'কর্তা’ বা ‘কুলপতি’ বা ‘গৃহকর্তা’। একান্নবর্তী পরিবারে কর্তার আদেশকে আইন মনে করে সবাই তা মেনে চলত।
(২) চতুঃবর্ণ প্রথা :-
ঋগ্বৈদিক আর্যদের সমাজের চারটি বর্ণ হল—
(১) ব্রাহ্মণ(পুরােহিত),
(২) ক্ষত্রিয় (যােদ্ধা বা দেশরক্ষী),
(৩) বৈশ্য (বণিক ও কৃষক) এবং
(4) শূদ্র (পশুপালক)।
এইসময় ‘জাতি’ ও ‘বর্ণ’ শব্দদুটির আলাদা অর্থ ছিল। অস্পৃশ্যতা ও জাতিভেদ প্রথার কোনাে অস্তিত্বই ছিল না। ঋগ্বৈদিক যুগের একেবারে শেষের দিকে আর্য-সমাজে চতুরাশ্রম প্রথা গড়ে ওঠে। এই প্রথা অনুসার একমাত্র শূদ্র ছাড়া ব্রাত্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যদের সমগ্র জীবন চারটি আশ্রম বা পর্বে বিভক্ত ছিল। এগুলি হল ব্ৰত্মচর্য, গার্হস্থ্য, ব্রণপ্রস্থ ও সন্ন্যাস আশ্রম।
(৩) নারীদের মর্যাদাঃ-
ঋবৈদিক আর্য-সমাজ পুরুষ শাসিত হলেও নারীদের যথেষ্ট সম্মান, স্বাধীনতা ও সামাজিক মর্যাদা ছিল। এই যুগে নারীদের উপনয়ন বা পৈতা হত।। সমাজে বিষপলা ও মুদ্গলানীর মতাে রণকুশলী নারী যেমন ছিল, তেমনি বিদুষী রমণীদের মধ্যে গার্গী, মৈত্রেয়ী, মমতা, অপালা, ঘােষা, বিশ্ববারা ও বিশাখার নাম বিশেষ স্মরণীয়।
অর্থনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্য :-
(১) কৃষিকাজঃ-
ঋগ্বেদের যুগে কৃষি পশুপালনের মতাে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। পরবর্তী বৈদিক যুগে এই কৃষিই পশুপালনের স্থান গ্রহণ করে গুরত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ব্যাশামের মতেতখন জমির ব্যক্তিমালিকানা ছিল না। জমির মালিকানা থাকত এক-একজন ‘গ্রামণী’ বা 'গ্রাম' প্রধানের হাতে। কিন্তু এইচ. সি.রায়চৌধুরির মতে, চারণভূমি সর্বসাধারণের সম্পত্তি হলেও বাস্তু ও আবাদি জমির ব্যক্তিমালিকানা ছিল।
(২) পশুপালনঃ-
কৃষির মতাে পশুপালন ছিল আর একটি প্রধান জীবিকা। গৃহপালিত প্রধান পশু গােরুকে ‘গােধন’, ‘গাবৃিস্টি’ (যাকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ হত) ও ‘অগ্ন’ (যা হত্যা করা নিষেধ) বলা হয়েছে। গােরু ছিল সম্পদ ও সম্পত্তির মাপকাঠি।(৩) বিনিময় প্রথাঃ-
ঋগবৈদিক যুগে বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে দু-ধরনের স্বর্ণখণ্ড ‘মনা’ও ‘নিষ্ক’-এর প্রচলন থাকলেও উন্নত মুদ্রাব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। তাই ব্যাবসাবাণিজ্যের জন্য পণ্য ‘বিনিময় প্রথা’ (barter system) গড়ে ওঠে। তবে গােরু ছিল এই বিনিময়ের প্রধান মাধ্যম।
(4) শিল্পঃ-
বাণিজ্যের পাশাপাশি কিছু ছােটোখাটো শিল্পের কথা ঋগ্বেদ থেকে জানা যায়। তবে বড়ো শিল্পের পরিবর্তে ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পই ছিল বেশি। এইসব শিল্পের মধ্যে লৌহশিল্প, স্বর্ণশিল্প, সুতিবস্ত্র শিল্প, পশম শিল্প, রজ্জ্বনির্মাণ শিল্প, চর্মশিল্প, মৃৎশিল্প, নৌকা ও রথ নির্মাণ শিল্প প্রধান।
রাজনৈতিক জীবনের বৈশিষ্ট্যসমূহঃ-
(১) রাজনঃ-
কতকগুলি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠত অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন ‘বিশ’ বা ‘জন’, যার প্রধান শাসনকর্তাকে বলা হত ‘বিশপতি’ বা ‘রাজন’ বা ‘রাজা'। এইভাবে রাজপদের উত্থানের মধ্যেই রাষ্ট্রের উৎপত্তির ধারণা বিকশিত হয়। সার্বভৌম শক্তির প্রতীকরূপে রাজা ‘অশ্বমেধ’, ‘বাজপেয়', ‘রাজসূয়’ প্রভৃতি যজ্ঞশেষে ‘সম্রাট’, ‘একরাট’, ‘বিরাট’, রাজচক্রবর্তী, রাজাধিরাজ’ প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করতেন।
(২) সভা ও সমিতিঃ-
রাজার স্বেচ্ছাচারকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং সুশাসন প্রণয়ন করে প্রজাকল্যাণের পথে চালিত করতে, অবাধ্য-অত্যাচারী রাজাকে বিতাড়িত করতে সভা ও সমিতির মতাে দুটি জনপ্রতিনিধিমূলক সংস্থার উন্মেষ ঘটে। আর. সি. মজুমদারএকে ‘Popular assembly' বলে উল্লেখ করেছেন। লুডউইগের মতে,উপজাতির বয়ােজ্যেষ্ঠ প্রধানদের নিয়ে নির্বাচিত হত সভা বা পরিষদ। আর সমিতি হল, সর্বসাধারণের পরিষদ। সভার চেয়ে সমিতি অনেক বেশি শক্তিশালী ছিল। কারণ সমিতি রাজার কর্তব্য নির্ধারণ করে তাকে প্রজাতন্ত্রের দিকে চালিত করতে পারত রাজা সভা-সমিতির সাথে সদ্ভাব রক্ষা করে চলত।
ধর্মীয় জীবনের বৈশিষ্ট্যঃ-
আর্যরা বিভিন্ন প্রকার প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করত। তাই বহু দেবদেবীর উপাসনা আর্যদের ধর্মজীবনের প্রধান অঙ্গ হয়ে ওঠে। জার্মান পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার সেইজন্য বৈদিক যুগের ধর্মে ‘বহু ঈশ্বরবাদের’ অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। আগুনের দেবতা ‘অগ্নিীর উদ্দেশ্যে ২০০টি স্তোত্র রচিত হয়েছে। এছাড়া বাতাসের দেবতা ‘মরুত’, জলের দেবতা ‘বরুণ’, মৃত্যুর দেবতা ‘যমরাজ’ প্রভৃতির উল্লেখ ঋগ্বেদে আছে। তবে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার নাম ঋগ্বেদে না উল্লেখ থাকলেও প্রজাপতি বিধাতৃ ও হিরণ্যগর্ভের নাম আছে।এই যুগের বিভিন্ন দেবীর মধ্যে ‘ঊষা’, ‘অদিতি',’অরুন্ধতী’, ‘সরস্বতী’, ‘সাবিত্রী’ ইত্যাদি প্রধান।
0 মন্তব্যসমূহ