বিশ্ব ইতিহাসের অশোকের স্থান বা কৃতিত্ব নির্ণয় করো।
অশোক (২৭৩ খ্রিঃ পূঃ—২৩২ খ্রিঃ পূঃ)—ধম্মবিজয় :-
ভারত ইতিহাসে অশােক এক স্মরণীয় নাম। তাঁর খ্যাতি তাঁকে আন্তর্জাতিক মর্যাদা দান করেছে। তিনি ২৭৩ খ্রিঃ পূঃ মগধের সিংহাসনে আরােহণ করেন। তক্ষশীলার শাসক ও কলিঙ্গ যুদ্ধ বিজেতারুপে অশােক যেমন অসামান্য সামরিক প্রতিভার পরিচয় দেন, তেমনি সুশাসক ও শান্তির দূত হিসাবে আজও সুবিদিত। ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরির মতে “অশােকের মধ্যে ছিল চন্দ্রগুপ্তের উদ্যম, সমুদ্রগুপ্তের বহুমুখী প্রতিভা এবং আকবরের ঔদার্য।” সব মিলিয়ে প্রাচীন ভারতের এক অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি।
ধৰ্ম্মবিজয় নীতির প্রেক্ষাপট:-
সিংহাসনে বসে প্রথম ১৩ বছর অশােক পিতামহ চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য বিস্তার নীতি অনুসরণ করেছিলেন। সিংহাসনে বসার (২৭৩ খ্রিঃ পূঃ) চার বছর (২৬৯ খ্রিঃ পূঃ) পর ২৫ বছর বয়সে তার রাজ্যাভিষেক হয়। রাজ্যাভিষেকের আট বছর পর (অর্থাৎ ২৬১ খ্রিঃ পূর্বাব্দে) তিনি কলিঙ্গ (ওডিশা ও অন্ধ্রপ্রদেশের অংশবিশেষ) জয় করেন। ড. এইচ সি. রায়চৌধুরি বলেন, বিম্বিসারের অঙ্গরাজ্য জয় থেকে যে সাম্রাজ্য বিস্তারের সূচনা হয়েছিল অশােকের কলিঙ্গ জয়ে তার সমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে অশােক নিজেই বলেছেন, “দেড় লক্ষ লোেক এই যুদ্ধে নির্বাসিত হয়, এক লক্ষ লােক মুত্যুমুখে পতিত হয়। এই সংখ্যার অনেক গুণ লােক নানাভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। কলিঙ্গ যুদ্ধের এই মর্মান্তিক দৃশ্য অশােকের মনে গভীর পরিবর্তন এনেছিল। এই যুদ্ধের পর তিনি উপগুপ্ত নামে এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর কাছে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হন এবং যুদ্ধজয়ের নীতি ত্যাগ করে ধর্মজয়ের নীতি গ্রহণ করেন‘ভেরিঘোষ’ নীতি ধর্মঘঘাষ’ বা ধর্মপ্রচারের নীতিতে পরিণত হয়। ‘কলিঙ্গ লিপি’ থেকে এসব তথ্য জানা যায়। কথিত আছে কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক চারবাকী বা কারুবাকা নামে এক রমণীর প্রেমে পড়লে তার মনে এই পরিবর্তন এসেছিল। ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি লিখেছেন, মগধের ইতিহাসে কলিঙ্গ যুদ্ধ এক যুগান্তকারী ঘটনা ছিল।
ধম্মবিজয় নীতির আদর্শ :-
অশােকের দীর্ঘ ৩৭ বছরের শাসনকাল ভারত ইতিহাসে ‘বিরল ও আলােকিত যুগ’ (Rare and lightning epoch') রূপে চিহ্নিত হয়ে আছে । ‘কলিজা লিপি’তে উল্লেখ আছে “সবে মুনিষে পজা মমা।”—যা জনগণের প্রতি তার ভালােবাসার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রজাদের কল্যাণের জন্য তিনি কুপ খনন, বৃক্ষরােপণ, দাতব্য চিকিৎসালয় ও পশুচিকিৎসালয় গঠন, পান্থশালা নির্মাণ প্রভৃতি করেন। তিনি ত্রয়ােদশ শিলালিপিতে ইহজগৎ ও পরজগৎ-এর কল্যাণ কামনা করেছেন। প্রজাদের সন্তানস্নেহে প্রতিপালনের এমন মহান রাজকর্তব্যের আদর্শ বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। অশােক জনকল্যাণ আদর্শকে রাজকার্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। চতুর্থ সংখ্যক স্তম্ভলিপিতে এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, “উপযুক্ত ধাত্রীর উপর সন্তানের দায়িত্ব অর্পণ করে পিতা-মাতা যেরূপ নিশ্চিন্ত হন, আমিও সেইরূপ জনসাধারণের সুখবিধানের জন্য রাজুকদের নিযুক্ত করেছি।” তিনি অন্য যেসব রাজকর্মচারী নিয়ােগ করেছিলেন, তাদের মধ্যে প্রাদেশিক, ধর্মমহামাত্র (ধর্মীয় বিষয়ের তদারক), স্ত্রী-মহামাত্র, নগর ব্যাবহারিক, প্রতিবেদক, ব্রজভূমিক প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। একজন সুদক্ষ রাষ্ট্র পরিচালক ও সফল সংস্কারকরূপে রাষ্ট্রনীতিকে তিনি অহিংসা ও মানবিকতার পথে চালিত করেছিলেন।
ধম্মবিজয়ের অঙ্গ—বৌদ্ধধর্মের প্রচার :-
‘কলিঙ্গ লিপি’ ও ‘ধৌলি লিপি’ থেকে, জানা গেছে, কলিঙ্গযুদ্ধের পর অশােক ‘ভেরিঘােষের’ পরিবর্তে ‘ধর্মঘাষ’ বা ‘ধর্ম বিজয়ের নীতি’ গ্রহণ করেছিলেন। অশােক বৌদ্ধধর্মের গােলমাল দূর করতে রাজধানী পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি’র আহ্বান করেছিলেন। বৌদ্ধধর্মের অহিংসা ও ভাতৃত্বের আদর্শ ও মহিমা ভারত ও ভারতের বাইরে প্রচার করার জন্য তিনি বিভিন্ন দেশে দুত পাঠিয়েছিলেন। কাশ্মীর ও গান্ধারে মধ্যান্তিক, মহাকচ্ছায়নকে অবন্তী রাজ্যে, নেপালে মঝঝিম, দক্ষিণ ভারতে মহাদেবরক্ষিত ও ধর্মরক্ষিত, মহারাষ্ট্রে মহাধর্মরক্ষিত, ব্ৰত্মদেশ ও সুবর্ণভূমিতে শােণ ও উত্তর, সিংহলে (তাম্রপর্ণী) মহেন্দ্র ও সংঘমিত্রা এবং পাঁচটি গ্রিকশাসিত রাজ্যে মহারক্ষিত ও মধ্য এশিয়ায় কুণাল বৌদ্ধধর্ম প্রচারে গিয়েছিলেন। ঐতিহাসিক সান্ডার্স বলেন, অশোকের এই ধর্মপ্রচারকরা এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের মনে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছিলেন। তাই ড. ভি. এ. স্মিথ অশোককে ‘মানবজাতির প্রথম গুরু’ বলেছেন। অশােক বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী হলেও অন্যান্য ধর্মের প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল। তিনি প্রজাদের নিজধর্ম শ্রেষ্ঠ ও পরধর্ম নিকৃষ্ট জ্ঞান না করার পরামর্শ দেন। ব্রাহ্রণ, শ্ৰমণ, জৈন, আজীবক সকলকেই সমানভাবে তিনি সম্মান করতেন। পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন বলেই তাকে ‘দেবনাম প্রিয় প্রিয়দর্শ’ বা ‘দেবতাদের প্রিয়’ বলা হত । প্রতিবেশী ও বৈদেশিক রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে অশোকের সুসম্পর্ক ছিল। সুদুর দক্ষিণে কেরলপুত্র, সত্যপুত্র, চোল, চের ও পাণ্ড রাজ্যের সঙ্গে তার মৈত্রী স্থাপিত হয়েছিল। এছাড়া সিংহল, নেপাল, ব্রহ্লাদেশ, তিব্বত, মধ্য এশিয়ার উপর অশােকের অহিংসা ধর্মের প্রভাব পড়েছিল। তার ত্রয়ােদশ শিলালিপিতে উল্লেখ আছে, পাঁচটি গ্রিকশাসিত রাষ্ট্রে রাজারা অশােকের প্রভাবে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। এঁরা হলেন--
(ক) দ্বিতীয় টলেমি ফেলাডেলপাস (মিশরের রাজা) (২৮৫-২৪৭ খ্রিঃপূঃ),
(খ) এন্টিয়োকোস থিয়োস (সিরিয়ার রাজা) (২৬১-২৪৬ খ্রিঃ পূঃ),
(গ) এন্টিুধনাস গোনেটাস (ম্যাসিডনের রাজা) (২৭৩-২৩৯ খ্রিঃ পূঃ),
(৪) আলেকজান্ডার (এপিরাসের রাজা) (২৭২-২৫৫ খ্রিঃপূঃ) ও
(৫) ম্যাগাস (সাইরিনের রাজা) (৩০০-২৫০ খ্রিঃ পঃ)।
অশােকের ধম্ম :-
'ব্যক্তি'অশােকের ধর্ম বৌদ্ধধর্ম হলেও, শাসক অশােকের ধম্ম (Dhamma) অনেক ব্যাপক ও উদার ছিল। রােমিলা থাপার বলেন, অশােক সামাজিক দায়িত্ববােধের মনােভাব নিয়ে ধম্মকে দেখেছিলেন। এই ‘ধম্ম’ কোনাে বিশেষ গােষ্ঠীর সংকীর্ণ ধর্মবিশ্বাস নয়। অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, অশােকের মায়ের নাম ‘ধম্ম’ থেকেই এই ধারণা এসেছে। ড. ভাণ্ডারকর (Ashoka' গ্রন্থে) এই ধর্মকে ‘লৌকিক বৌদ্ধধর্ম’ বলেছেন। অহিংসা, দয়া, মায়া, পবিত্রতা, সত্যবাদিতা প্রভৃতি মানবিক মূল্যবােধের উপর অশােকের ধম্ম প্রতিষ্ঠিত ছিল ঐতিহাসিকরা এই ধর্মমতকে ‘অশােকবাদ’ (Ashokism) বলেছেন। গবেষক রিজ ডেভিস (Rhis Davis) বলেন, প্রকৃত জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের যা করা উচিত, অশােক এখানে সেই কথাই বলেছেন। ঐতিহাসিক ফ্লিট (Fleet) বলেন, ধৰ্ম্ম আসলে অশােকের রাজধর্ম, যা রাজনৈতিক ও নৈতিক সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। ড. রােমিলা থাপার লিখেছেন, “এটি মানুষের মর্যাদা ও সমাজে তার কৃতকর্মের স্বীকৃতিদানের অজুহাতে প্রবর্তিত হয়েছিল। কোশাম্বী ধম্মনীতিকে ‘extended religion' বলেছেন।
বিশ্ব ইতিহাসে অশােক :-
যুগের বিচারে অশােককে অপরাজেয় বলা হয়।। কনস্টানটাইন, শার্লেম্যান, আলফ্রেড, আলেকজান্ডার, জুলিয়াস সিজার, আকবর ও নেপােলিয়ানের সঙ্গে তুলনা করে অশােককে শ্রেষ্ঠ বলা চলে। ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন, “বিশ্ব-ইতিহাসে অশােক অতুলনীয় এবং অশােকের আবির্ভাব ভারতকে মহিমান্বিত করেছে। রাধাকুমুদ মুখার্জি লিখেছেন, মানুষ ও শাসক হিসাবে অশােকের রাজতন্ত্র এক বিরল ঘটনা।*
মন্তব্যঃ-
অশােক পৃথিবীতে অহিংসার আদর্শ প্রচার করেছিলেন। তাঁর শান্তি, মৈত্রী, জাতীয়তাবােধ ও ভ্রাতৃত্ববােধের আদর্শ তাঁকে মানবতাবােধ ও আন্তর্জাতিকতাবােধের মূর্ত প্রতীক করে তুলেছে। কেউ কেউ এই অহিংসার আদর্শে মগধের পতনের কারণ বলে মনে করলেও ড. ডি. ডি. কোশাম্বী ও রােমিলা থাপার মনে করেন, অশােকের অহিংসা নীতি ও প্রজাকল্যাণমূলক কাজ সরকারের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে সাহায্য করেছিল। তাই “ভলগা থেকে জাপান পর্যন্ত তিনি আজও সম্মানিত হচ্ছেন।” ‘United Nations organisation' বিশ্বশান্তি স্থাপনের জন্য অশােকের অহিংসা ও শান্তির নীতির উপর গুরুত্ব দিয়েছে। পরিশেষে এইচ. জি. ওয়েলস-এর ভাষায় আমরা বলতে পারি : ’ইতিহাসের পাতায় হাজার হাজার নৃপতির নাম ভিড় করে আছে, তাঁদের রাজকীয় মর্যাদা, মহিমা ও আড়ম্বরের মধ্যে সম্রাট অশােকের নাম এক উজ্জ্বল তারকার ন্যায় চিরভাস্বর হয়ে আছে।”*২ থুকিডিডিস বলেন “মানবীয় গৌরব ধ্বংস হয়, কিন্তু মহত্ত্বের স্মৃতি অক্ষয় থাকে।”
0 মন্তব্যসমূহ