প্রাচীন ভারতের মগধের উত্থানের কারণ সম্পর্কে আলোচনা কর।মগধের উত্থান (Rise of Magadha) মগধের উত্থানের কারণ, হর্ষঙ্ক বংশ ও বিম্বিসার (৫৪৪ খ্রিঃ পূঃ—৪৯৩ খ্রিঃ পূঃ), অজাত শত্রু (৪৯৩ খ্রিঃ পূঃ—৪৬২ খ্রিঃ পূঃ), নন্দবংশ (৩৬২ খ্রিঃ পূঃ—৩২১ খ্রিঃ পূঃ), মগধের উত্থানের কারণ, নবম শ্রেণী

প্রাচীন ভারতের মগধের উত্থানের কারণ সম্পর্কে আলোচনা কর।

মগধের উত্থান (Rise of Magadha) মগধের উত্থানের কারণ :-

মগধের উত্থানের পিছনে শুধুমাত্র বিম্বিসার, অজাতশত্র, শিশুনাগ ও মহাপদ্মনন্দের কৃতিত্ব ছিল। তা নয় এক অনুকুল ভৌগােলিক অবস্থানই মগধের উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিল।

মগধ একটি ছােটো রাজ্য থেকে বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত হওয়ার পিছনে দুটি প্রধান। কারণ ছিল—

() শক্তিশালী রাজবংশ যেমন হর্ষঙ্ক, শৈশুনাগ, নন্দ ও মৌর্য বংশের ভূমিকা এবং


() অনুকূল ভৌগােলিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক অবস্থা। তাই অনুকূল বাস্তব অবস্থা ও ব্যক্তির ভূমিকা মগধ সাম্রাজ্যকে সাফল্যের তুঙ্গে তুলে দিয়েছিল।


হর্ষঙ্ক বংশ : বিম্বিসার (৫৪৪ খ্রিঃ পূঃ—৪৯৩ খ্রিঃ পূঃ):-

তিনি হর্ষঙ্ক বংশের প্রতিষ্ঠাতা ও বুদ্ধের সমসাময়িক ছিলেন। তিনি ইতিহাসে ‘শ্রেণিক’ নামে পরিচিত। তাঁর পিতার নাম ভট্টীয়। ১৫ বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পর তিনি মগধের সিংহাসনে। আরােহণ করেন। তিনি একমাত্র অঙ্গরাজ্যের রাজা ব্রহ্লাদত্তকে ষােলাে বছর ধরে এক। যুদ্ধে পরাস্ত করা ছাড়া আর কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি। কোশলরাজ প্রসেনজিতের কন্যা কোশলদেবীকে বিয়ে করে তিনি কাশী গ্রাম যৌতুক পান, যার বার্ষিক রাজস্ব ছিল আশি হাজার টাকার মতাে। তাঁর দ্বিতীয় পত্নী ছিলেন লিচ্ছবি দলপতি চেতকের কন্যা চেল্লনা, তৃতীয় পত্নী বিদেহ রাজকন্যা বাসবীদেবী ও চতুর্থ পত্মীর নাম মদ্ররাজকন্যা। ক্ষেমাদেবী। এর ফলে মগধের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল সুরক্ষিত হয়েছিল। ড. রােমিলা। থাপারের মতে, “বিম্বিসার প্রথম ভারতে সুদক্ষ শাসনকাঠামাের কথা বুঝেছিলেন।” 

অজাত শত্রু (৪৯৩ খ্রিঃ পূঃ—৪৬২ খ্রিঃ পূঃ):-

চেল্লনার গর্ভজাত সন্তান অজাতশত্রু  পিতা বিম্বিসারকে হত্যা করে (৪৯৩ খ্রিঃ পূঃ) মগধের সিংহাসনে বসেন। এইসময় কুণিক’ উপাধি নেন। অজাতশত্রুর বিরুদ্ধে পূর্ব ভারতে ৩৬টি গণরাজ্যকে নিয়ে বৈশালীর। লিচ্ছবিরাজ চেতকের “মিত্রসংঘ’-কে ষােলাে বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে শেষপর্যন্ত মিত্রসংঘের । সব শক্তিকে পরাস্ত করেছিলেন। ৪৬২ খ্রিঃ পূঃ অজাতশত্রুর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র উদয়ী বা উদয়ভদ্র মগধের। সিংহাসনে বসেই গঙ্গা ও শােন নদীর সঙ্গমস্থলে পাটলিপুত্র নগরীর পত্তন করেন। রাজগৃহ থেকে এখানেই তিনি রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিলেন। অবন্তীর রাজাকে এক খযােগ্য ঘটনা হল— এক, বৈশালীতে দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীতির আহ্বান। দুই, পুনরায় পাটলিপুত্রে রাজধানী স্থানান্তর।

 নন্দবংশ (৩৬২ খ্রিঃ পূঃ—৩২১ খ্রিঃ পূঃ):-

নন্দবংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহাপদ্মনন্দ। তিনি অশেষ শক্তির অধিকারী ছিলেন। বৌদ্ধ ও জৈনগ্রন্থ এবং পুরাণে তাকে নীচু বংশজাত বা শূদ্র শ্রেণিভুক্ত বলে উল্লেখ আছে। পুরাণ অনুসারে তিনি দ্বিতীয় পরশুরাম’, সর্বক্ষত্রান্তক’, ‘একরাট’ প্রভৃতি উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। ক্ষত্রিয়দের উপর  মহাপদ্মনন্দ বিশেষ ক্রুদ্ধ ছিলেন। তাঁর এই অভূতপূর্ব সাফল্যের স্বীকৃতি দিয়ে ড. রাধাকুমুদ। মুখার্জি বলেন, “মহাপদ্মনন্দ হলেন উত্তর ভারতের প্রথম মহান ঐতিহাসিক সম্রাট।” ("Mahapadma was the first great historical emperor of Northern India.") ড. নীলকণ্ঠ শাস্ত্রীর মতে, “শূদ্র মহাপদ্ম ব্রাক্ষ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের চোখে নীচু হলেও, তাঁর। যােগ্যতা ইতিহাসে স্বীকৃতি লাভ করেছে।” মহাপদ্মনন্দের মৃত্যুর পর তাঁর আটজন পুত্র পরপর মগধের সিংহাসনে বসেন। তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র ধননন্দ ছিলেন নন্দবংশের শেষ রাজা। তিনি ছিলেন খুবই পরাক্রমশালী ও অত্যাচারী রাজা। ধননন্দের রাজত্বকালে গ্রিক বীর আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিলেন (৩২৭ খ্রিঃ পূঃ)। গ্রিক পণ্ডিতরা তাঁকে ‘আগ্রামেস’ বলেছেন। কারণ তিনি সামরিক ক্ষেত্রে শক্তিশালী ছিলেন। ধননন্দের সেনাবাহিনীতে ছিল ২,০০,০০০ পদাতিক, ২০,০০০ অশ্বারােহী, ৩,০০০ রণহস্তী ও ২,০০০ রথ। মেগাস্থিনিসের মতে, ‘গগাহুদি অর্থাৎ গাঙ্গেয় বদ্বীপের মানুষ এবং প্রাসি’ অর্থাৎ প্রাচ্যের কাশী, কোশল, বিদেহ, পাঞ্জাল ও শরসেনের অধিবাসীদের উপর ধননন্দের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল। তবে জনগণের উপর। অত্যাচার করে উচ্চ হারে কর আদায় করতেন, ফলে মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। এইসময় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য চাণক্যের সহযােগিতায় ধননন্দকে হত্যা করে মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হন।

মগধের উত্থানের কারণঃ- 

ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি বলেন, “খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের ইতিহাস মানেই মগধের ইতিহাস।” এর উত্থানের কারণ --

প্রথমত, অনুকুল ভৌগােলিক অবস্থানই মগধের উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছিল। এখানে নদীবিধৌত উর্বর সমভূমি ও লােহার ব্যাপক ব্যবহারে কৃষির চরম উন্নতি ঘটেছিল। 


দ্বিতীয়ত, সহজলভ্য। নদীপথ ও নদীবন্দরগুলি আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্যের দ্বার উন্মুক্ত করেছিল। তাছাড়া এই অঞলের খনিজ, বনজ, প্রাণীজ সম্পদ আর্থিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সমদ্ধি ঘটিয়েছিল। ডি. ডি. কোশাম্বীর মতে বাণিজ্য অপেক্ষা খনির প্রাচুর্য মগধের উত্থানে সহায়ক হয়েছিল।


ততীয়ত, মগধের প্রধান দুটি রাজধানী প্রাকৃতিকভাবে সুরক্ষিত। পাঁচটি পাহাড়ের মাঝখানে ছিল রাজধানী রাজগৃহ। রাজধানী পাটলিপুত্র গঙ্গা, শােন ও গণ্ডক নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত। 


চতুর্থত, ঐতিহাসিক রামশরণ শর্মা এইসব প্রাকৃতিক আনুকূল্যকে মগধের সাফল্যের একমাত্র কারণ বলে মনে করলেও ড. এ. এল. ব্যাশাম, ড. রােমিলা থাপার প্রমুখ মনে করেন, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারণে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় মগধের খুব দ্রুত শক্তিবৃদ্ধি ঘটে এবং রাজনৈতিক সাফল্যের জন্য সর্বভারতীয় সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।

পঞ্চমত, প্রকৃতি ছাড়া পুরুষের ভূমিকা, যেমন—বিম্বিসার, অজাতশত্র, চন্দ্রগুপ্ত, মহাপদ্মনন্দ প্রমুখ। 


ষষ্ঠত, পূর্ব ভারতে আর্যদের অভিপ্রয়াণের ফলে উদ্ভত মিশ্র সংস্কতি মগধের উত্থানে সহায়ক হয়েছিল।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ