মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো। চন্দ্রগপ্ত মৌর্য (৩২৪ খ্রিঃ পূঃ—৩০০ খ্রিঃ পূঃ), ভারত-গ্রিক সম্প্রীতি, সেলুকাসের সঙ্গে যুদ্ধে জয়, সেলুকাসের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি, গ্রিকদের সঙ্গে যুদ্ধ, নবম শ্রেণী

মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা কর।


চন্দ্রগপ্ত মৌর্য (৩২৪ খ্রিঃ পূঃ—৩০০ খ্রিঃ পূঃ) :- 

মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতা হলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। ভারতে তিনি বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাও। 

মৌর্য ইতিহাসের উপাদানঃ-

এই সাম্রাজ্য সম্পর্কে জানতে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা’, বিশাখদত্তের মুদ্রা রাক্ষস’, ক্ষেমেন্দ্রের বৃহৎ কথামঞ্জরি’, সােমদেব ভট্টের কথাসরিৎসাগর কথামালা’, বৌদ্ধ ও জৈনগ্রন্থ, পুরাণ ও অশােকের লিপিসমূহ এবং অ্যারিয়ান, জাস্টিন, প্লিনি ও তামিল লেখক মামুলনার প্রমুখের বিবরণী বিশেষভাবে সাহায্য করে থাকে।


বংশপরিচয় :- 

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জন্ম এবং বংশপরিচয় নিয়ে নানা মত রয়েছে। ‘মৌর্য’ নামকরণটি কীভাবে হল সে বিষয়ে ঐতিহাসিকরা ভিন্ন মত পােষণ করেছেন। ব্রাত্মণসূত্র পুরাণ অনুসারে 'মুরা’ নামে এক শূদ্র রমণী নন্দ রাজাদের রাজসভায় দাসীর কাজ করত। তারই গর্ভজাত সন্তান হলেন চন্দ্রগুপ্ত। 

নানা অভিমতঃ-

তাই অনেকে বলেন চন্দ্রগুপ্তের মা মুরার নাম থেকে 'মৌর্য’ নামের উৎপত্তি। আবার কেউ বলেন, মৌর্য রাজারা ময়ূর পােষ মানাতে ভালােবাসতেন। তাই এইরুপ নামকরণ হয়েছে। রাজপুতানায় প্রাপ্ত ব্রাণনথিপত্রে মৌর্যদের সূর্যবংশীয় বলা হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণে তাদের 'অসুর’ বলা হয়েছে। আবার বৌদ্ধদের ‘পালি সাহিত্য থেকে জানা যায়, হিমালয়ের পাদদেশে নেপালের তরাই অঞ্চল থেকে উত্তরপ্রদেশের গােরক্ষপুর পর্যন্ত। বিস্তৃত অঞলকে পিপ্পলীবন বলে। এখানেই ‘মােরিয়’ নামে ক্ষত্রিয় রাজবংশ রাজত্ব করত। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সেই বংশের সন্তান। চাণক্য তার অর্থশাস্ত্রে’ চন্দ্রগুপ্তকে সম্ভ্রান্ত ক্ষত্রিয় বলে অ্যাখ্যায়িত করেছেন।

ধননন্দের পরাজয় :- 

চন্দ্রগুপ্ত মগধের তৎকালীন রাজা ধননন্দকে পরাস্ত করতে প্রথম উদ্যোগী হয়েছিলেন। অত্যাচারী ধননন্দের বিরুদ্ধে তাঁকে সাহায্য করেছিল মগধের কিছু মানুষ। 

কৌটিল্যের সাহায্য লাভঃ-

তাছাড়া চন্দ্রগুপ্ত বিন্ধ্য পর্বতের পার্শ্ববর্তী জনাকীর্ণ স্থান  থেকে প্রচুর সৈন্য সংগ্রহ করেন। পুরাণ থেকে জানা যায়, তক্ষশিলার কূটনীতিপরায়ণ এক ব্রাক্ষ্মণও ধননন্দের বিরুদ্ধে অভিযানে চন্দ্রগুপ্তকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য ও পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাই আনুমানিক ৩২২-৩২১ খ্রিঃ পূঃ তিনি নন্দবংশের শেষ রাজা ধননন্দকে পরাজিত ও হত্যা করে মগধের সিংহাসন লাভ করেন। তিনি মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐতিহাসিক আর. কে. মুখার্জি বলে এইভাবে তিনি প্রথম ঐতিহাসিক সার্বভৌম সম্রাটের মর্যাদা লাভ করেন।

গ্রিকদের সঙ্গে যুদ্ধ :-

প্লটার্ক ও জাস্টিনের বিবরণীতে আছে, একসময় চন্দ্রগ নন্দবংশের উচ্ছেদের জন্য আলেকজান্ডারের সঙ্গে দেখা করেন। কিন্তু এই আগন্তকে ঔদ্ধত্য দেখে আলেকজান্ডার তাঁকে হত্যার নির্দেশ দেন। সেইসময় পালিয়ে গিয়ে কোনােরকমে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রাণে বেঁচেছিলেন।

সেলুকাসের সঙ্গে  যুদ্ধে জয়ঃ-

তারপর ৩২৩ খ্রিঃ পূঃ জুন মাসে ব্যাবিল শহরে আলেকজান্ডারের আকস্মিক মৃত্যুর খবর পেয়ে চন্দ্রগঞ্জ। গ্রিকদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন (৩২১ খ্রিঃ পূঃ) এবং উত্তর-পশ্চিম-সীমান্তের সিন্ধু, পাঞ্জাব গ্রিকদের কাছ থেকে দখল করেন। গ্রিক ঐতিহাসিক জাস্টিনের ‘এপিটোম’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে, “আলেকজান্ডারের মৃত্যর পর। ভারতীয়রা গ্রিক শাসকদের হত্যা করে, নিজেরা দাসত্বমুক্ত হয়। এই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান নেতা হলেন চন্দ্রগুপ্ত (স্যান্ডােকোট্টাস)।” চন্দ্রগুপ্তের ভয়ে গ্রিক সেনাপতি ইউডেমাস ৩১৭ খ্রিঃ পূঃ পাঞ্জাব থেকে পালিয়ে যান। ঐতিহাসিক টমাস চন্দ্রগুপ্তের এই কাজকে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

সেলুকাসের সঙ্গে যুদ্ধ ও সন্ধি :-

অবশেষে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গতিরােধ করতে। সিরিয়া থেকে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের অধিপতি ও আলেকজান্ডারের প্রধান সেনাপতি। সেলুকাস ভারত আক্রমণ করেন। জাস্টিনের মতে, চন্দ্রগুপ্ত ৬,০০,০০০ সৈন্য নিয়ে। সেলুকার্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। চন্দ্রগুপ্ত এই যুদ্ধে জয়লাভ করেন। 

ভারত-গ্রিক সম্প্রীতিঃ-

৩০৫ খ্রিঃ পূঃ  সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মধ্যে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই সন্ধির শর্ত অনুসারে  চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসের কাছ থেকে কাবুল, কান্দাহার, হিরাট, বেলুচিস্তানের মাকরান পর্যন্ত অঞ্চল লাভ করেন। সেলুকাস নিজ কন্যা হেলেনকেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে বিবাহ দিয়ে দু-দেশের মধ্যে মৈত্রীসম্পর্ক আরও দৃঢ় করেছিলেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সেলুকাসকে ৫০০ হাতি, কিছু মণিমুক্তা ও দাসদাসী উপহার দিয়েছিলেন। সেলুকাসের রাজপ্রাসাদ সিরিয়া থেকে তার দূত মেগাথিনিস রাজধানী পাটলিপুত্রে এসেছিলেন। তিনি বেশ কিছুকাল এখানে থাকার পর (৩০৫ খ্রিঃ পূঃ—৩০০ খ্রিঃ পূঃ) ইন্ডিকা’ নামে গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন।

অন্যান্য রাজ্যজয়ঃ-

শকক্ষত্ৰপ রুদ্রদামনের ‘জুনাগড় লিপি’ থেকে জানা যায়, মালব, সৌরাষ্ট্র, কোঙ্কন বা মহারাষ্ট্র চন্দ্রগুপ্ত নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। গুজরাটের বিখ্যাত সদর্শন সরােবর হদের বাঁধ নির্মাণ চন্দ্রগুপ্তের অধীনস্থ শাসক পুষ্যগুপ্তের একটি বিরাট কৃতিত্ব।

রাজ্যবিস্তারঃ-

দক্ষিণে গােদাবরীর তীর ধরে কর্ণাটকের চিতলঢুগ, তামিলনাড়ুর তিনেভেলি পর্যন্ত অঞল চন্দ্রগুপ্ত জয় করেছিলেন। তবে দক্ষিণে তার প্রাধান্যের প্রশ্নে নানা মুনি নানা মত পােষণ করে থাকেন। ঐতিহাসিক নীলকণ্ঠ শাস্ত্রী হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি বলেন, নন্দরাজাদের কাছ থেকে চন্দ্রগুপ্ত দক্ষিণের রাজ্যগুলি লাভ করেছিলেন। মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত ব্রাত্মীলিপি হিউয়েন সাঙের বিবরণী থেকে জানা যায়, বঙ্গদেশের প্রাসী বা প্রাচ্য এবং গঙ্গাহুদি বা গঙ্গারিডি চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। এইভাবে সুদূর কাবুল থেকে দক্ষিণে তিনেভেলি পর্যন্ত অঞ্চল মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। ঐতিহাসিক হেমচন্দ্র রায়চৌধুরি তাই চন্দ্রগুপ্তকে “ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সার্বভৌম সম্রাট” বলে অ্যাখ্যা দিয়েছেন।


মন্তব্যঃ-

এইভাবে একজন সুদক্ষ সেনানায়ক হিসাবে আফগানিস্তানের কাবুল থেকে দক্ষিণে তিনেভেলি এবং পূর্বে বঙ্গদেশ থেকে পশ্চিমে গুজরাটের সৌরাষ্ট্র পর্যন্ত এক বিশাল সাম্রাজ্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গড়ে তুলেছিলেন  তিনিই প্রথম প্রাচীন ভারতের রাজা হিসাবে রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি স্থাপনের বিরল নজির রেখেছিলেন। দীর্ঘ ২৪ বছর নিরবচ্ছিন্ন সাফল্যের পর ৩০০ খ্রিঃ পূঃ (মতান্তরে ২৯৮ খ্রিঃ পূঃ) জৈনধর্মের অনশনব্রত গ্রহণ করে মহিশূরের শ্রাবণবেলগােলায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ