গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি বর্ণনা করাে। অথবা, গুপ্ত বংশের পতনের কারণরুপে দুর্বল উত্তরাধিকার ও বৈদেশিক আক্রমণ সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখাে।গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের কারণ,হুনদের আক্রমণের গুরুত্ব,ভারতে হূন আক্রমণ,গপ্ত রাজশক্তির অবক্ষয় (Decadence of Gupta Royal Power), নবম শ্রেণী (ix)

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি বর্ণনা করাে। অথবা, গুপ্ত বংশের পতনের কারণরুপে দুর্বল উত্তরাধিকার ও বৈদেশিক আক্রমণ সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখাে।



গপ্ত রাজশক্তির অবক্ষয় (Decadence of Gupta Royal Power):-


স্কন্ধগুপ্তের মৃত্যুর পর গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয়। বৈনগুপ্ত ও ভানুগুপ্ত ৫১১ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করলেও অবক্ষয় রােধ করতে পারেননি। বিষ্ণুগুপ্ত ছিলেন গুপ্তবংশের শেষ রাজা। গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের যুগে যেসব আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটে তারা হল মগধের ক্ষীয়মাণ। ‘গুপ্তবংশ’, মালবের ‘ঔলিকর বংশের’ যশােবর্মন কনৌজের ‘মৌখরি বংশের’ ঈশানবর্মন, সর্ববর্মন, অবন্তীবৰ্মন ও গ্রহবর্মন, গুজরাটের বলভির ‘মৈত্রক বংশের’ ধ্রুবসেন বা ধ্রুবভট্ট (হর্ষবর্ধনের জামাতা) থানেশ্বরের ‘পূষ্যভূতি বংশের’ প্রভাকরবর্ধন,রাজ্যবর্ধন ও  হর্ষবর্ধন, গৌড়ের শশাঙ্ক, মালবের দেবগুপ্ত, কামরুপের ভাস্করবর্মন প্রমুখ। 



 

গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন:-


ভারতে হূন আক্রমণ:-

গুপ্তোত্তর যুগে কেন্দ্রীয় রাজশক্তির দুর্বলতার সুযােগে ভারতে বহু আঞ্চলিক রাজ্যের উদ্ভব ও হুন আক্রমণের ফলে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটেছিল।

হুনদের পরিচয়:- 

হুনদের যে শাখাটি ইউরােপে ঢুকে প্রথমে ডন নদীর তীরে আসে এবং তারপর তুরস্ক, পূর্ব ইউরােপ ও রােম সাম্রাজ্য ধ্বংস করে, তারা কৃষ্ণুহুন’ (Black Hun) নামে পরিচিত। এই শাখার নেতা হলেন এটিলা। অন্য যে শাখাটি মধ্য-এশিয়ার কাস্পিয়ান সাগরের নিকট অক্ষুনদী উপত্যকা অঞল ত্যাগ করে ভারত আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়, তারা শ্বেতহুন (White Hun) নামে পরিচিত। এই শাখার নেতা হলেন তােরমান। ভিতরি স্তম্ভলিপি থেকে জানা যায়, প্রথমবার হুনদের ভারত আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেন গুপ্ত সম্রাট স্কন্দগুপ্ত। কিন্তু স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর (৪৬৭ খ্রিঃ) হুনরা আবার ভারত আক্রমণ শুরু করে। 

তােরমান:-


বিখ্যাত শ্বেতহুনদের নেতা তােরমান গান্ধার, পাঞ্জাব ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের কিছু  অংশ দখল করেন। উত্তরপ্রদেশ পাঞ্জাব, রাজপুতানা, মালব ও কাশ্মীরে প্রাপ্ত “তােরমানশাহি’ মুদ্রা থেকে প্রমাণ হয় এইসব স্থান নিয়ে তােরমান নিজ সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। অষ্টম শতকে লেখা জৈন গ্রন্থ কুবলয়মালা’ থেকে জানা যায় যে, সিন্ধুর চেনাব বা ঝিলাম নদীর তীরে তােরমানরা বসবাস শুরু করেছিলেন।গ্রিক পর্যটক কোসমস, চিনা দূত সুং ইয়ুন, কহণের ‘রাজতরঙ্গিণী’ ও হিউয়েন সাঙের রচনা থেকে জানা যায়, রক্তপিপাসু ও নিষ্ঠুর হননেতা তােরমান। বহু মন্দির ও বৌদ্ধমঠ ধ্বংস করে সিন্ধু নদীর পশ্চিমে রাজত্ব শুরু করেন। তার রাজধানী ছিল শিয়ালকোটে। ৫১০ খ্রিঃ মালবের গুপ্ত শাসক ভানুগুপ্ত ও তাঁর সামন্তপ্রধান গােপরাজ তােরমানকে পরাস্ত করেন।


মিহিরকুলঃ-

তােরমানের মৃত্যর পর তাঁর পুত্র মিহিরকুল (বা মিহিরকুল) রাজধানী শিয়ালকোটে সিংহাসনে বসেন ৫১৫ খ্রিঃ। তিনিও পিতার ন্যায় বহু মঠ ও মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। কাশ্মীরি গ্রন্থ ‘রাজতরঙ্গিণী’ থেকে জানা যায়, গান্ধার, কাশ্মীর, দক্ষিণ ভারত ও সিংহল মিহিরগুল নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। মধ্য ভারতে যশােবর্ধন ৫৩১ খ্রিঃ মিহিরকুলকে পরাস্ত করেন। হিউয়েন সাঙের মতে, ৫৩৩ খ্রিঃ  মিহিরকুল আবার গুপ্ত সম্রাট নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্যের কাছে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হন এবং গুপ্তদের করদ রাজা পরিণত হন। এরপর তিনি কাশ্মীরে চলে আসেন এবং ৫৪২ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। মিহিরকুলকে ‘ইন্ডিয়ান এটিলা’ বলে।

হুনদের আক্রমণের গুরুত্ব :- 


ভারতে হন আক্রমণের গুরুত্ব প্রধানত দুটি - 

(ক) রাজনৈতিক অর্থাৎ হন আক্রমণে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং 

(খ) সামাজিক অর্থাৎ হুনরা ভারতীয় সমাজে মিশে যায়। তাদের সঙ্গে আরও অনেক বিদেশি ভারতীয় সমাজে মিলিত হয়। যার ফলে রাজপুত জাতির উৎপত্তি ঘটে বলে স্মিথ মনে করেন। তার মতে, রাজনীতি ও সমাজে গভীর পরিবর্তন এসেছিল এইভাবে। 

রাজপুত জাতির উৎপত্তি :- 


রাজপুত্র’ কথাটির অপভ্রংশ রুপ হল রাজপুত। কবি  বাণভট্টের মতে উচ্চ বংশের ক্ষত্রিয়দের বলে রাজপুত। হর্ষের মৃত্যুর পর থেকে মুসলিম। আক্রমণের আগে অর্থাৎ ৬৪৭-১১৯২ খ্রিঃ পর্যন্ত সময়কে বলে রাজপুত যুগ’ কিংবদন্তি অনুসারে রাজপুতরা চন্দ্র সূর্যবংশীয় ছিলেন। ব্রাত্মণ কবি চাঁদ বরদৈ-এর ‘পৃথ্বীরাজ রাসাে’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, মাউন্ট আবু পাহাড়ে বশিষ্ঠ মুনি চোদ্দো দিন ধরে যজ্ঞ করার সময় যে বীরের প্রার্থনা করেছিলেন, তার ফলে ওই যজ্ঞের অগ্নিকুণ্ড থেকে প্রতিহার, পরমার, চৌহান, চৌলুক্য, কলচুরি, শােলাঙ্কি প্রভৃতি রাজপুত বীরের। জন্ম হয়। রাজপুতদের এই জন্মতত্ত্বকে অগ্নিকুল মতবাদ’ বলা হয়। ড. গৌরীশংকর হিরাচাদ ওঝা (History of Rajputana' গ্রন্থে) অগ্নিকুল তত্ত্বকে মেনে নিয়েছেন।


      কিন্তু বৈদেশিক জাতির থেকে রাজপুত জাতির উৎপত্তি বলে যাঁরা মনে করেন তাদের মধ্যে ড. ভাণ্ডারকর, উইলিয়াম ক্রুক ও কর্নেল টড উল্লেখ্য। রাজস্থানের ঐতিহাসিক কর্নেল টড (Annals and Antiquities of Rajashtan' গ্রন্থে) বলেছেন, শক, হন, । কুষাণ ও গুর্জর জাতির মানুষ উদ্দিষ্ট স্থানে বসবাসের সময় ভারতীয় রমণীদের বিবাহ। করতে শুরু করে। কালক্রমে ওইসব বিদেশিদের বংশধররা শৌর্যে বীর্যে বলীয়ান হয়ে , ওঠে। ড ভি এ স্মিথও এই কারণে রাজপুতদের ‘মিশ্রজাতি’ বলেছেন।

গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের কারণ :-


দীর্ঘদিন উজ্জ্বল অস্তিত্বের পর অভ্যন্তরীণ কলহপ্রাদেশিক স্বাধীনতা, বিদেশি আক্রমণ, আর্থিক সংকট ইত্যাদি কারণে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেরে পড়ে—


(১) দুর্বল উত্তরাধিকার হল গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের প্রত্যক্ষ কারণ। সমুদ্রগুপ্ত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, স্কন্দগুপ্ত প্রমুখ শক্তিশালী রাজার অভাবে গুপ্ত সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে । পরবর্তী রাজারা সবাই অযােগ্য ও দুর্বলচেতা ছিলেন। 


(২) সাম্রাজ্যের বিশালতা গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি প্রধান কারণ। শেষের দিকে এই বিশাল সাম্রাজ্যের রাষ্ট্র ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা অযােগ্য রাজাদের পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছিল। 


(৩) প্রাদেশি শাসকদের স্বাধীনতা ঘােষণার ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব ক্রমশ লুপ্ত হতে শুরু করে।  মালবের যশোেধর্মন, কনৌজের মৌখরি, বলভীর মৈত্রক প্রভৃতি সামন্ত বা প্রাদেশিক শাসকরা দীয় শক্তির প্রতি আনুগত্য দেখানাে বন্ধ করে। ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সংহতি বিপন্ন হয়েছে। ড. মজুমদার বলেন, মান্দাশােরের যশােধর্মনের স্বাধীনতা ঘােষণা পতনের সূত্র তৈরি ভবেছিল। 


(৪) রাজদরবারে কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতা রাজপরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিবাদ ক্রমশ বেড়ে চলেছিল। এটি পতনের একটি কারণ ছিল। 


(৫) পরবর্তী গুপ্ত রাজাদের যুদ্ধবিমখতা ও ধর্মপ্রবণ স্বভাব গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি কারণ। শেষ গুপ্ত সম্রাটদে মধ্যে তথাগতগুপ্ত, বুধগুপ্ত, ও নরসিংহগুপ্ত বালাদিত্য বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করায় যুদ্ধনীতি পরিহার করেছিলেন। বুধগুপ্ত এই বংশের রাজা ছিলেন। হিউয়েন সাঙ জানিয়েছেন, হন নেতা। মিহিরকুল একসময় বালাদিত্যের কাছে পরাস্ত ও বন্দি হলেও, মন্ত্রীদের অনুরােধে শেষে। তাকে মুক্তি দেন। এই ধরনের নীতি গুপ্ত সাম্রাজ্যের বিপদ বাড়িয়ে তুলেছিল। 


(৬) আর্থিক সংকট গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের আর একটি কারণ। খ্রিস্টীয় চতুর্থ ও পঞ্চম শতকে বর্বর হুন আক্রমণে রােম ছন্নছাড়া হলে ভারত-রােম রেশমবাণিজ্য বন্ধ হয়। ভূমি ও অন্যান্য। রাজস্বের হারও কমেছিল। 


(৭) বিভিন্ন আক্রমণ, যেমন পুষ্যমিত্র, বাকাটক ও হন আক্রমণের। ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন, আর্থিক দুর্বলতা ও সীমান্তশাসকদের বিদ্রোহ গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনে বেশি সাহায্য করেছিল।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ