গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রসার সম্পর্কে আলোচনা করো।
গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠা:গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রসার (Foundation of Gupta Royal Dynasty : Spread of Gupta Empire):
গুপ্তবংশের প্রতিষ্ঠা:-
ভারতে কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পর যে রাজনৈতিক শূন্যতা ও অচলাবস্থা দেখা দেয় তার অবসান ঘটাতে গুপ্ত রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা হয়। শ্রীগুপ্ত গুপ্তবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পুত্র ঘটোৎকচ গুপ্ত শক্তিশালী রাজা ছিলেন। তবে ঘটোৎকচের পুত্র প্রথম চন্দ্রগুপ্ত প্রথম স্বাধীন সার্বভৌম রাজা ছিলেন। তিনি ‘গুপ্তাব্দের প্রবর্তন করেন এবং বাংলা, বিহার ও অযােধ্যার উপর নিজের আধিপত্য স্থাপন করেন।
সমুদ্রগুপ্ত (৩৩০-৩৮০ খ্রিঃ):-
ভারতের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্তের কৃতি সন্তান ও কুমারদেবীর গর্ভজাত * সমুদ্রগুপ্ত।
সিংহাসনারােহণ:-
আনুমানিক ৩৩০ খ্রিঃ থেকে ৩৮০ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্বকালের মধ্যে তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যকে মহিমান্বিত করেছিলেন। ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার তাই লিখেছেন, “ভারতে যেসব উল্লেখযােগ্য রাজা ছিলেন সমদ্রগঞ্জ তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর সামরিক প্রতিভা, সুশাসন, সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষকতা ভারতের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
উত্তর ভারত জয়ঃ-
এলাহাবাদ প্রশস্তি’র ত্রয়ােদশ ছত্রে আছে সমুদ্রগুপ্ত উত্তর ভারতে (বা আর্যাবর্তের) নয় রাজ্য জয় করেছিলেন। এই ক্ষেত্রে তিনি দিগ্বিজয়ের নীতি’ (বা আক্রমণাতক নীতি) গ্রহণ করেছিলেন। এই নয়টি বিজিত রাজ্যের রাজারা হলেন-- চন্দ্রবর্মন, নাগদত্ত, গণপতিনাগ, বলবর্মন, মতিল, নাগসেন, নন্দীন, রুদ্রদেব ও অচ্যুত।
দক্ষিণ ভারত জয়ঃ-
সমুদ্রগুপ্ত দক্ষিণ ভারতের মােট বারােটি রাজ্যের রাজাকে পরাস্ত করেছিলেন। এক্ষেতে তিনি ধর্মবিজয় নীতি’ (বা গ্রহণ পরিমােক্ষ’) প্রবর্তন করেন। এই নীতির তিনটি ভাগ হল—
(১) ‘গ্রহণ’ (বা রাজ্যজয়),
(২) ‘মােক্ষ’ (বা পরাজিত রাজাকে মুক্তিদান) এবং
(৩) ‘অনুগ্রহ’ (বা বশ্যতা স্বীকারের বিনিময়ে রাজ্য ফিরিয়ে দেওয়া)। এক্ষেত্রে তিনি তার রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
দক্ষিণের যে বারােটি রাজ্যের রাজা তার বশ্যতা স্বীকার করেছিলেন তারা হলেন-- কাঞ্চির বিষ্ণুগােপ, বেঙ্গির হস্তীবর্মন, অবমক্তার নীলরাজ, পলারে উগ্রসেন, কুস্থলপরের ধনঞ্জয়, দেবরাষ্ট্রের কুবের, কোট্টরের স্বামীদত্ত, এরন্ডপল্লের দমন, পিষ্ঠপুরমের মহেন্দ্রগিরি কোশলের মহেন্দ্র, মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ ও কৌরলের মন্তরাজ।
সীমান্তরাজ্য জয়ঃ-
সীমান্তের পাঁচটি রাজ্য সমুদ্রগুপ্ত জয় করেছিলেন। এগুলি হল—নেপাল, কর্তৃপুর (পাঞ্জাবের জলন্ধর জেলা), সমতট (পূর্ববঙ্গের একাংশ), দাভক (আসামের নওগাঁ জেলা) ও কামরূপ (উত্তর আসাম)।
* সমুদ্রগুপ্তের কাছে নয়টি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজারা আত্মসমর্পণ করেছিলেন। এই রাজ্যগুলি হল—সােনাকানিক, খারপারিক, আভীর, কাকা, মদ্রক, যৌধেয়, প্রার্জুন, অর্জনায়ণ ও মালব। এছাড়া শিবি, কুলিন্দ, লিচ্ছবি, ঔদুম্বর প্রভৃতি প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যও জয় করেছিলেন। বর্তমান গাজিপুর থেকে জলপুর পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল অরণ্যসংকুল ‘আটাবিক রাজ্যগুলিও তার হস্তগত হয়েছিল। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট আর্থার স্মিথ (V. A. Smith) সাম্রাজ্য স্থাপনের কৃতিত্বের জন্য তাঁকে ‘ভারতের নেপােলিয়ন’ আখ্যা দেন।
প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যঃ-
তিনি রাজ্যজয় শেষে ‘অশ্বমেধ যজ্ঞ’ করেন এবং সার্বভৌম শক্তির প্রতীকরূপে ‘পরাক্রমাঙ্ক’, ‘একরাট', ‘সর্বরাজোচ্ছেত্তা’ ও ‘অপ্রতিরথ’ উপাধি নেন। তাঁর মুদ্রা থেকে জানা যায়, তিনি বীণা বাজাতেও পারতেন। কাব্যচর্চার জন্য তিনি কবিরাজ উপাধি পেয়েছিলেন। রাধাকুমুদ মুখার্জির মতে, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে নর্মদা, পর্বে পুত্র পর্যন্ত তিনি রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৭৫-৪১৫ খ্রিঃ):-
রাজ্যজয়, বৈবাহিক নীতিঃ-
অনেকে মনে করেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আগে রামগুপ্ত সিংহাসনে বসেছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ‘বিক্রমাদিত্য’ ও ‘পরম ভগবত’ উপাধি নেন। নতুন নতুন রাজ্য বিশেষ জয় না করলেও পিতার বিজিত রাজ্যগুলি উপর নিজের কর্তৃত্ব অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। তবে সাম্রাজ্যকে শক্তিশাল করতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নিজেই মধ্যভারতের নাগরাজকন্যা কুবেরনাগাকে বিবাহ করেন। এই কুবেরনাগার গর্ভজাত কন্যা প্রভাবতী গুপ্তকে তিনি বাকাটক রাজা দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে বিয়ে দেন। এছাড়া কর্ণাটকের কদম্ববংশীয় কাকুথ বর্মনের কন্যার সঙ্গে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত নিজ পুএকে বিয়ে দেন। ‘কদম্বলিপি’ থেকে এ কথা জানা যায়। ড. স্মিথের মতে, শকদের সঙগ যুদ্ধ করতে নাগ ও বাকাটকদের সাহায্য দরকার ছিল। ড. এইচ. সি. রায়চৌধুরি তাই দলেন দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিবাহনীতিকে তার ক্ষমতা সম্প্রসারণের স্বার্থে ব্যবহার করেছিলেন।
রাজ্যজয়; শক যুদ্ধঃ-
গুজরাট ও সৌরাষ্ট্রের শকক্ষপ তৃতীয় রুদ্রসেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রয়ােজনে পূর্ব মালবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত একটি সামরিক শিবির গঠন করেন এবং কদম্ব রাজাদের সহযােগিতা নেন। কয়েক বছর ধরে যুদ্ধ চলার পর শেষে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পশ্চিম ভারতের সর্বশেষ শক রাজা তৃতীয় রুদ্রসেনকে পরাজিত ও নিহত করেন। শকদের উচ্ছেদ করার ফলে আরব সাগরের তীর পর্যন্ত গুপ্ত সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয়। এইভাবে পশ্চিমের সঙ্গে বাণিজ্যসম্পর্ক আরও সম্প্রসারিত হওয়ার ফলে আর্থিক উন্নতির পথ প্রশস্ত হয় শকদের উচ্ছেদের পর দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকারি’ উপাধি নেন এবং মধ্যপ্রদেশের উজ্জয়িনীতে গুপ্তদের দ্বিতীয় রাজধানী গড়ে তােলেন।
বঙ্গ ও বহুীক বিজয়ঃ-
দিল্লির কুতবমিনারের সন্নিকটে মেহরৌলি গ্রামে এক মরিচাবিহীন ৭৩ ফুট উচ্চ লৌহস্তম্ভের গায়ে ‘চন্দ্র’ রাজার বিজয়কাহিনি খােদিত আছে। এই চন্দ্ররাজ বঙ্গদেশের রাজাদের পরাস্ত করে সপ্তসিন্ধুর পরপারে বহলীকদেশ জয় করেছিলেন।
প্রথম কুমারগুপ্ত (৪১৫-৪৫৫ খ্রিঃ) :-
দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম কমারগ ৪১৫ খ্রিঃ সিংহাসনে আরােহণ করেন। তার দীর্ঘ শাসনকালকে ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ’ বলা হয়। তিনি কোনাে নতুন রাজ্য জয় করেননি বটে তবে তাঁর রাজত্বের একেবারে শেষপর্বে নর্মদা উপত্যকার এক দুর্ধর্ষ উপজাতির নেতা পুষ্যমিত্রের প্রচণ্ড আক্রমণকে ব্যর্থ করে তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অখণ্ডতা রক্ষা করেছিলেন। পিতার ন্যায় প্রথম কুমারগুপ্ত ধর্মনিরপেক্ষ নীতি মেনে চলতেন। আবার প্রপিতামহের (সমুদ্রগুপ্ত) পরাক্রম ও সার্বভৌমত্বের দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে প্রথম কুমারগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞ শেষ করে ‘মহেন্দ্রাদিত্য’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই কুমারগুপ্তই ইতিহাসবিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়টি নির্মাণ করেছিলেন। ঐতিহাসিকরা তাঁকে ‘সাধুসুলভ রাজা’ বলেছেন।
স্কন্দগুপ্ত (৪৫৫-৪৬৭ খ্রিঃ):-
প্রথম কুমারগুপ্তের পুত্র স্কন্দগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত বংশের শেষশক্তিশালী রাজা। পিতার মৃত্যুর পর ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি নিয়ে ৪৫৫ খ্রিঃ তিনি পাটলিপুত্রের সিংহাসনে বসেন। মাত্র ১২ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন। ‘ভিতরি-স্তম্ভলিপি’ থেকে জানা যায়, অল্পকালের জন্য শাসন করলেও স্কন্দগুপ্ত দুর্ধর্ষ হন জাতির আক্রমণ থেকে গুপ্ত সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেছিলেন। হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে হুনরা গান্ধার রাজ্যে ঢুকে ' পড়লেও আর এগােতে পারেনি। বলা বাহুল্য স্কন্দগুপ্তের ভয়ে পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে ভারতে হন জাতি আক্রমণের সাহস পায়নি। তাঁর এই কৃতিত্বের জন্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার স্কন্দগুপ্তকে ‘ভারতের রক্ষাকারী’ ('Savior of India') বলেছেন। বৌদ্ধ গ্রন্থ ‘আর্যমশ্ৰীমূলকল্প’ থেকে জানা যায়, স্কন্দগুপ্ত ‘ধর্মপরায়ণ’ ও ‘জ্ঞানী রাজা'। তিনি বিষ্ণুর উপাসক হলেও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। হন আক্রমণ প্রতিহত করা ছাড়া তিনি গুজরাটের বিখ্যাত সুদর্শন সরােবর হদের বাঁধটি পুনর্গঠনের জন্য বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ