প্রাচীন ভারতের ধর্মীয় অবস্থা বর্ণনা করো। নবম শ্রেণী
ধর্ম :-
প্রাচীন ভারতের ধর্ম বৈদিক যুগের পরবর্তীকালে অনেকটাই রূপান্তরিত হয়। ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মের গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বৌদ্ধ, জৈন, আজীবক প্রভৃতি প্রায় ৬৩টি নতুন ধর্মমতের আবির্ভাব ঘটে। তবে রাজানুকুল্য লাভের জন্য বৌদ্ধধর্ম বহুকাল। জনপ্রিয় থাকে। এছাড়া প্রাচীন হিন্দুধর্ম, শৈবধর্ম ইত্যাদির প্রাধান্য ছিল। হিন্দুধর্মের প্রধান। পাঁচটি ধারা হল—বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, সৌর ও গাণপত্য। একত্রে এদেরকে বলে ‘পাপাসনা’। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে ইহা নতুন বৈশিষ্ট্য প্রাপ্ত হয়েছিল।
বৌদ্ধ ধর্মঃ-
অনেক ইতিহাসবিদ বলেন অশােকের মায়ের নাম ‘ধম্ম’ থেকেই এই ধারণা এসেছে। ড. ভাণ্ডারকর (Asoka' গ্রন্থে) এই ধর্মকে ‘লৌকিক বৌদ্ধধর্ম’ বলেছেন। অহিংসা, দয়া, মায়া, পবিত্রতা, সত্যবাদিতা প্রভৃতি মানবিক মূল্যবােধের উপর অশােকের ধম্ম প্রতিষ্ঠিত ছিল। ঐতিহাসিকরা এই ধর্মমতকে ‘অশােকবাদ’ (Ashokism) বলেছেন।
ব্রাত্মণ্যধর্মঃ-
গুপ্ত রাজারা ব্রাত্মণ্যধর্মের অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য ধর্মের প্রতি তাঁরা শ্রদ্ধা হারাননি। বৈষ্ণব, বৌদ্ধ, শৈব প্রভৃতি ধর্মের মানুষ এইসময় গুপ্তসাম্রাজ্যে বাস করত। সমুদ্রগুপ্তের প্রধান সেনাপতি আম্রকানদেব (Amrakandeva) এবং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী বীরসেন (Virasena) বুদ্ধের উপাসক ছিলেন। কিন্তু রাজারা বিয়ুর উপাসক। বিভিন্ন ধর্মের এই পারস্পরিক সমন্বয় অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করেছিল। ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে চালিত করেছে।
হিন্দু ধর্মঃ-
প্রায় ৯০০ বছর পর গুপ্তযুগে ব্রাত্মণ্যধর্ম আবার প্রবল হয়ে ওঠে। তবে বৈদিক ধর্মের। বিবর্তন এক মানবতাবাদ ও সমন্বয়বাদের মধ্য দিয়ে গুপ্তযুগে নবকলেবর ধারণ করে। এই যুগে দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ, কার্তিক, শিব, বিষু প্রভৃতির উপাসনা ও পূজাপাঠ শুরু হয়। জটিল যাগযজ্ঞের পরিবর্তে ভক্তিবাদের বিকাশ ঘটে। ড. রাধাকুমুদ মুখার্জি গুপ্তযুগের হিন্দুধর্মকে “পুরানাে ও নতুন ধর্মীয় আদর্শের সমন্বয়যুক্ত এক মােজাইক” বলে উল্লেখ করেছেন। এই কারণে পণ্ডিত ম্যাক্সমুলার গুপ্তযুগকে “হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের যুগ”বলতে চান। কারণ বৈষ্ণব, শৈব, শাক্ত, সৌর ও গাণপত্য— হিন্দুধর্মের এই পাঁচটি ধারার সমন্বয় ঘটে। শংকরাচার্য ও রামানুজকে পরবর্তীকালে হিন্দুধর্মের যথার্থ প্রবর্তক বলা হয়েছিল। যদিও সিন্ধুযুগেও এই ধর্মের অস্তিত্ব ছিল।
পাল রাজাদের ধর্মঃ-
পাল রাজারা ছিলেন বুদ্ধের উপাসক এবং সেন রাজারা ছিলেন ব্রাত্মণ্যধর্মের উপাসক। খ্রিস্টীয় অষ্টম ও নবম শতকে বৌদ্ধধর্মে পরিবর্তন আসে। এইসময় ধর্মে তন্ত্রমন্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটায় বজ্রযান, সহজযান, এখন, কালচক্রযান প্রভৃতি মতবাদের উদ্ভব ঘটে। আবার বৌদ্ধধর্ম ও ব্রাত্মণ্যধর্মের মিলনে অবধূতমার্গ’ ও ‘বাউলমার্গের উদ্ভব ঘটে। তাই বৌদ্ধ বাউল বা সহজিয়া সম্প্রদায়ের প্রভাব বাড়ে।
দক্ষিণী ধর্মঃ-
পল্লব রাজাদের উদ্যোগে বৌদ্ধ ও জৈনধর্মের বিরুদ্ধে ভক্তি আন্দোলন গড়ে ওঠে। ড. রােমিলা থাপারের অভিমত হল, “তামিল ভক্তিধর্ম ছিল আর্য ব্রাত্মণ্যধর্মের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া।” জটিল যাগযজ্ঞের বিরদ্ধে পল্লবদের ভক্তিধর্ম সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিল। পল্লব রাজারা শৈব (নায়নার) ও বৈষ্ণব (আলবার)পন্থী ছিলেন। অদ্বৈতবাদী জগৎগুরু শংকরাচার্য আবার ধর্মপ্রচারের জন্য দক্ষিণে মহিশুরে শুঙ্গেরি মঠ, উত্তরে বদরিকাশ্রমে যােশী মঠ, পশ্চিম উপকূলের দ্বারকায় সারদা মঠ ও পূর্ব উপকলের পরীতে গােবর্ধন মঠ স্থাপন করেছিলেন। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ তাঁর বৈষ্ণব অনুগামীদের নিয়ে কাঞ্চিতে ‘শ্রী সম্প্রদায়’ গড়ে তুলেছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ