প্রাচীন ভারতের সাহিত্যের অগ্রগতি সম্পর্কে আলোচনা করো। নবম শ্রেণী
সাহিত্য :-
মৌর্য ও মাের্যোত্তর সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানঃ-
ভারতের প্রায় সব ভাষাতেই প্রাচীন সাহিত্যের চর্চা হয়েছিল। মৌর্যদের ইতিহাস জানতে কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’ এবং মেগাস্থিনিসের ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থদ্বয় অন্যতম প্রধান হলেও বিশাখাদত্তের ‘মুদ্রারাক্ষস’, বৌদ্ধগ্রন্থ, জৈনগ্রন্থ, জাস্টিনের এপিটোম’, অ্যারিয়ানের আনাবসিস’, প্লুটার্ক-এর বিবরণী বিশেষভাবে সাহায্য করে। কুষাণযুগে। সংস্কৃত ভাষায় সাহিত্য রচনা এক নতুন দিগন্ত উন্মােচিত করেছিল। বিখ্যাত দার্শনিক, শাস্ত্রজ্ঞ, সংগীতজ্ঞ ও কবি অশ্বঘােষ রচিত ‘বুদ্ধরচিত’, বজ্ৰসূচি’, সূত্রালংকার’, সারিপুত্রপ্রকরণ’, ‘সৌন্দরানন্দ কাব্য’ গুণমানে উৎকর্ষ লাভ করেছিল। নাগসেনের ‘মিলিন্দপঞহাে’, বসুমিত্রের ‘মহাবিভাষা’, কাত্যায়ণের ‘বিভাষা’, পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য, বৌদ্ধ দর্শনের বিশ্বকোশ ধনাচ্যের ‘বৃহৎকথা’, আর্যশূরের ‘চর্যাপিটক’ প্রভৃতি উল্লেখ্য। বিখ্যাত সাহিত্যিক, দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক পণ্ডিত নাগার্জুনের ‘সুহরিললেখ’, শত-সহস্রিকা-প্রজ্ঞাপারমিতা’, ‘মাধ্যমিকাসুত্র’ উল্লেখযােগ্য রচনা।
এই মাধ্যমিকাসুত্র’কে বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের ‘আপেক্ষিকতার তত্ত্বে’র (Theory of Relativity') সঙ্গে তুলনা করা হয়। হিউয়েন সাঙ তাই নাগার্জুনকে “পৃথিবীর চারটি আলাের অন্যতম” (One of the four lights of the world) বলেছিলেন। অশ্বঘােষকে অনেকে কবি মিলটন, গ্যেটে ও ভলতেয়ারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই যুগের চিকিৎসাশাস্ত্রের ক্ষেত্রে চরকের ‘চরক সংহিতা’, শল্যবিদ সুশ্রতের ‘সশ্রত সংহিতা’ উল্লেখযােগ্য রচনা। শল্যবিদ আত্রেয়র শিষ্য অগ্নিবেশ মহর্ষি । চরকের গুর ছিলেন। বিম্বিসারের চিকিৎসক জীবক ও কুমারভট্টের আমলে তক্ষশিলা । ছিল আয়ুর্বেদ শিক্ষার প্রধান কেন্দ্রস্থল। মহাযান বৌদ্ধধর্ম সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করতে অনেক ‘অবদান’ শাস্ত্র, যথা ‘দিব্যবদান’ ও ‘মহাবস্তু’ এবং সংকলক গ্রন্থের মধ্যে ‘রামায়ণ’, ’মহাভারত’, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র, বাৎসায়নের ;’কামসূত্র’ প্রভৃতি এই যুগের সাহিত্যভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে। মহাকবি ভাসের নাটকসমূহ বিজ্ঞতার বিচারে কালজয়ী।
ধ্রুপদি সাহিত্যে উন্নতিঃ-
গুপ্তযুগ ছিল সংস্কৃত সাহিত্যের এক চরম উৎকর্ষের কাল। ড. আর. এস. ত্রিপাঠী গুপ্তযুগের সাহিত্যের অগ্রগতিকে প্রাচীন গ্রিসের পেরিক্লিসের যুগের সঙ্গে, ইংল্যান্ডের এলিজাবেথের যুগের সঙ্গে তুলনা করেছেন। পুস্তযুগের সংস্কৃত সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যকে অনেকটাই সমৃদ্ধ করেছে।
স্মৃতি ও দর্শনশাস্ত্রঃ-
সমুদ্রগুপ্ত নিজে ‘কৃষ্ণচরিতম’ নামে এক কাব্যগ্রন্থ রচনা করে ‘কবিরাজ’ উপাধি পান। তাঁর সভাকবি হরিষেণের ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’ দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী বীরসেনের ‘এরাণ শিলালিপি’ এক অনবদ্য রচনা। ইন্ডিয়ান শেকসপিয়ার নামে পরিচিত মহাকবি কালিদাসের ‘মেঘদূত’ রঘুবংশ’, কুমারসম্ভব’, ‘ঋতুসংহার', অভিজ্ঞান শকুন্তলম' ইত্যাদি কালের বিচারে অনবদ্য রচনা। শুদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক ‘(চারুদত্ত ও বসন্তসেনার প্রেমকাহিনি), ভারবীর। কিরাতাজুনীয়ম’ (কিরাতের ছদ্মবেশে শিবের সঙ্গে অর্জুনের যুদ্ধের কাহিনি), অমর সিংহের কৃষি সংক্রান্ত আকর গ্রন্থ ‘অমরকোশ’ (শব্দাভিধান) বিষ্ণুশর্মার ‘পঞ্চতন্ত্র’ (গল্প সংকলন, এখন বিশ্বের বহু ভাষায় অনুদিত), ভট্টির ‘ভট্টিকাব্য’, দণ্ডীর ‘দশকমার চরিত’ প্রভৃতি উল্লেখ্য। এছাড়া রাষ্ট্রকূট নৃপতি আমােষবর্ষের ‘রত্নমালিকা’ একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। তামিল সাহিত্য তিরুবল্লভ-এর কুরুল’ কাব্য এবং কানাডি সাহিত্যের ‘ত্রিরত্ন’ নামে পরিচিত পন্না, রন্না ও পম্পার কাব্যগ্রন্থ উল্লেখ্য।
পালযুগের সাহিত্যঃ-
পাল ও সেন যুগে সংস্কৃত ও বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণযুগের সূচনা হয়েছিল। বৌদ্ধ সহজিয়া (বাউল) দের রচিত চর্যাপদ হল বাংলা সাহিত্যের প্রথম ও প্রধান সম্পদ। এই চর্যাপদ রচনা করেন লুইপাদ, কাইপাদ,ভুসুকুপাদ প্রমুখ। পণ্ডিত চতুর্ভুজের লেখা ‘হরিচরিত’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বরেন্দ্রভূমির ব্রাত্মণরাপুরাণ ও ব্যাকরণে যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন। এই যুগের অন্য পণ্ডিতদের গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল—ভবদেব ভট্টের ‘হােরাশাস্ত্র’, সন্ধ্যাকর নন্দীর ‘রামচরিত’ (শ্লেষকাব্য), জীমূতবাহনের ‘দায়ভাগ’ (হিন্দু আইন গ্রন্থ), অভিনন্দের ‘কাদম্বরী কথাসাগর’, শ্ৰধর ভট্টের ‘ন্যায়কন্দলী’, বিশাখদত্তের‘মুদ্রারাক্ষস’ (৮০০ খ্রিঃ), সপ্তম শতকে ভট্টির ‘রাবণবধ’ (ভট্টিকাব্য), একাদশ শতকে পদ্মগুপ্তের ‘নরসাহসাঙ্কচরিত’ (মালব রাজার জীবনী), দ্বাদশ শতকের শ্রীহর্ষের ‘নৈকর্ষচরিত'। এছাড়া ভর্তৃহরির কবিতাগ্রন্থ, ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ ও ‘মালতিমাধব’, দশম শতকে রাজশেখরের ও ‘বাল রামায়ণ’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য। ধােয়ীর পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে লক্ষ্মণসেন তাঁকে কবিরাজ চক্রবর্তী’ উপাধি দেন।পাল যুগেরপণ্ডিতদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন মৈত্রেয় রক্ষিত, জিনেন্দ্রবুদ্ধি, সেনযুগের সাহিত্য সর্বানন্দ প্রমুখ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য তান্ত্রিক’ গ্রন্থের লেখ প্রজ্ঞাবর্মন ও ‘বজ্রযান সাধক’ গ্রন্থের লেখক অতীশ দীপঙ্করের নাম উল্লেখ্য। অতীশ দীপঙ্কর তেরাে বছর তিব্বতে থেকে ২০০টি বৌদ্ধ গ্রন্থ লিখেছিলেন।
সেনযুগের সাহিত্যিঃ-
সেনযুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে হলায়ধের ‘মীমাংসাসর্বস্ব’ও ব্রাত্মাণসর্বস্ব’গ্রন্থ’ উল্লেখ্য। বল্লালসেনের ‘ব্রতসাগর’, ‘প্রতিষ্ঠাসাগর’ ও ‘আচার্যসাগর’, ‘দানসাগর’ ও ‘অদ্ভুতসাগর’, অনিরুদ্ধ ভট্টের ‘হরিলতা’ ও ‘পিতৃদয়িতা, ধােয়ীর ‘পবনদুত’, উমাপতি ধরের ‘চন্দ্রচূড়চরিত’, জয়দেবের গীতগােবিন্দ’ কাব্যের শেষ। লাইনটি স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লেখা বলে প্রচলিত থাকলেও তার প্রমাণ নেই।
0 মন্তব্যসমূহ