বাবরের জীবনের কৃতিত্ব সম্পর্কে আলোচনা করো


বাবর


দিল্লি সুলতানি আমলের সংক্ষিপ্ত কাহিনী তোমার চতুর্থ শ্রেণীতে পড়েছ.। রাজপুত বীর পৃথ্বীরাজ কে পরাজিত করে মোহাম্মদ ঘড়ি দিল্লিতে মুসলমান রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। দিল্লির তুর্কি ও আফগান (বা পাঠান) রাজধানীর উপাধি ছিল সুলতান। তিন শত বছরের অধিককাল দিল্লিতে তাঁদের রাজত্ব ছিল। এক সময়ে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষের দিল্লীর সুলতানের অধীনে হয়েছিল। পরে নানা কারণে এই বিশাল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে।

   

    তুর্কি সাম্রাজ্যের পতনের সূত্রপাত হয়েছিল খেয়ালী সুলতান মুহাম্মদ বিন্‌ তুঘলকের আমলে। আমার মৃত্যুর কিছুকাল পরে মধ্য এশিয়ার অন্তর্গত সমরকন্দের অধিপতি তৈমুর লং ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন। তৈমুরের একটি পাওয়া ছিল খোঁড়া, তাই তাঁকে ‘লঙ্গ’( অর্থাৎ খোঁড়া) বলা হত। তিনি বাহুবলে এক বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। তাঁর সৈন্যদল দিল্লি অধিকার করে বহু লোক হত্যা করেছিল। 


ভারতবর্ষে স্থায়ী সাম্রাজ্যঃ স্থাপনের ইচ্ছা তৈমুরের ছিল না ; প্রচুর ধনরত্ন  লুণ্ঠন করে তিনি দেশে ফিরে গেলেন । দিল্লির সুলতানদের ক্ষমতা ক্ষুন্ন হলো, তাঁদের সাম্রাজ্য উত্তর ভারতের একটি ছোট রাজ্যে পরিণত হয়। তৈমুর আক্রমণ শতাধিক  বর্ষ পরে  তার বংশধর বাবর সুলতানি আমলের অবসান ঘটিয়ে দিল্লিতে মুঘল বাদশাহ স্থাপন করলেন।


    প্রায় সাড়ে-চারশত বৎসর পূর্বে মধ্য এশিয়ায় হিন্দুকুশ পর্বতের উত্তরে ফর্‌ঘনা নামে একটি ছোট রাজ্য ছিল। এই রাজ্যে তৈমুরের বংশধরগণ রাজত্ব করতেন। ফর্‌ঘনা সুলতান ওমর শেখ মির্জার পুত্র বাবর।  বাবরের মা ছিলেন প্রসিদ্ধ মোঙ্গল বীর দিগ্বিজয়ী চেঙ্গিস খাঁর বংশের কন্যা। সুতরাং বাবা ও মায়ের দিক থেকে বাবর ছিলেন সেকালের দুই  শ্রেষ্ঠ  বীরের বংশধর।  তুর্কি ভাষায় ‘বাবর’ শব্দের অর্থ ‘সিংহ’ বা ‘ব্যাঘ্র’। বাবর নানা যুদ্ধক্ষেত্রে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়ে এই নাম সার্থক করেছিলেন।  তাঁর প্রকৃত নাম ছিল জহিরউদ্দিন মোহাম্মদ।


     রাজার ঘরে জন্মগ্রহণ করেও বাবর প্রথম জীবনের নানা রকম দুঃখ কষ্ট ভোগ করেছিলেন।  তাঁর বয়স যখন এগারো তখন তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তিন বৎসর ফর্‌ঘনায় রাজত্ব করার পর ১৪ বছর বয়সে বাবর তৈমুরলং এর রাজধানী মধ্য এশিয়ায় ফর্‌ঘনা প্রসিদ্ধ নগর সমরকন্দ অধিকার করেন। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই দুর্দান্ত উজবেকদের আক্রমণে ফর্‌ঘনা ও সমরকন্দ থেকে তিনি বিতাড়িত হন; এইচডি পদে রাজ্যহারা বাবর নিজের উপর বিশ্বাস হারালেন নয়। কয়েক বছর পরেই তিনি অসামান্য সাহস ও বুদ্ধির বলে কাবুল অধিকার করলেন। তারপর তিনি দখল করলেন গজনী ও কান্দাহার । উত্তর ও দক্ষিণ আফগানিস্তানের বাবর এর নতুন রাজ্য প্রতিষ্ঠা হল।


      আফগানিস্তান ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষের সিংহাসনে বসে ভারতবর্ষে ভারতবর্ষে খুঁজতে লাগলেন। তিনি মনে করতে যে,  তৈমুরের বংশধর হিসেবে দিল্লির সিংহাসনের উপর তাঁর দাবি আছে, কারণ তৈমুর দিল্লি দখল করেছিলেন।  এই সময়ের দিল্লির পাঠান সুলতান ছিলেন ইব্রাহিম লোদী। তিনি বড়ই অহংকারী ছিলেন,  তাঁর  ব্যবহারে রাজ্যের  বড় বড় আমীর-ওমরাহেরা তাঁর উপর অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছিলেন। জাবের শাসনকর্তা দৌলত খাঁ লোদী সুলতান ইব্রাহিমকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাবরকে ভারতবর্ষ আক্রমণের জন্য অনুরোধ করলেন। লোদী সুলতানের দুর্বলতায় উৎসাহিত হয়ে বাবর পরপর চার বার পাঞ্জাব আক্রমণ করেন।


পানিপথের প্রথম যুদ্ধ


      শেষবার দিল্লির নিকট পানিপথ নামক স্থানে বাবরের সঙ্গে ইব্রাহিম লোদীর ঘোর যুদ্ধ হয়। শেষ সময়ে ভারতবর্ষে যুদ্ধ বিগ্রহের কামানের ব্যবহার প্রচলিত ছিল না, কিন্তু বাবরের সঙ্গে কয়েকটা কামান ছিল। ইব্রাহিম লোদীর সৈন্য বাবরের সৈন্যর সংখ্যায় অনেক বেশি ছিল, প্রধানত কামান এর সাহায্যে বাবই জয়লাভ করলেন। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ ভারতবর্ষের ইতিহাস একটি প্রসিদ্ধ ঘটনা। যুদ্ধক্ষেত্রে ইব্রাহিম লোদীর মৃত্যু হল, লোদী বংশের এবং সুলতানি রাজ্যের পতন ঘটল এবং ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হলো।

  

       বাবর পূর্বপুরুষ তৈমুরের মত লুণ্ঠনকারী ছিলেন না, ভারতে স্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপনই তাঁর উদ্যোগ ছিল। পানিপথের জয়লাভের পর তিনি দিল্লি এবং আগ্রা অধিকার করলেন। উত্তর ভারতের অধিকাংশ তখন বিভিন্ন  পাঠান দলপতি হিন্দু রাজগণের অধীন ছিল। বাবর যখন নিজের রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা আরম্ভ করলেন তখন এই সকল খন্ড রাজ্যের অধিপতিগণের মধ্যে কয়েকজন তাঁকে বাঁধা দিলেন।


       এই সময় উত্তর ভারতে হিন্দু রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন চিতরের রানা সংগ্রাম সিংহ। তাঁর সাহস ও বীরত্বের তুলনা ছিল না।  তিনি বারবার অন্যান্য রাজপুত রাজাদের সঙ্গে এবং প্রতিবেশী মালব্য গুজরাটের মাতাল দের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। নানা যুদ্ধে তাঁর শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিল। তার দেহে আশিটা আঘাতের চিহ্ন ছিল বলে প্রবাদ আছে। মেবার ছিল তাঁর পৈতৃক রাজ্য।  মেবারের বাইরে রাজপুতানার অন্য কয়েকটি রাজ্যও তাঁর অধীনতা স্বীকার করেছিল।  তাঁর আশা ছিল যে পাঠান রাজত্ব ধ্বংস হলে তিনি উত্তর ভারতে আবার হিন্দু-প্রভুত্ব স্থাপন করবেন। 


বাবর লোদী বংশ ধ্বংস করে ধনরত্ন নিয়ে তৈমুরলং এর মত স্বদেশে ফিরে গেলে সংগ্রাম-সিংয়ের স্বপ্ন হয়তো সফল হতো। কিন্তু বাবুর দিল্লিও আগ্রায় নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে চারিদিকে রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা করতে লাগলেন। তখন সংগ্রাম সিংহ বুঝলেন যে বাবর ভারতে সাম্রাজ্যঃ স্থাপন করলে হিন্দু-রাজ্যপুনরুদ্ধারের আর কোন আশা থাকবে না।  তাই তিনি নিজের সমস্ত সৈন্য-সামন্ত নিয়ে বাবরকে ভারতবর্ষ থেকে তাড়াবার আয়োজন করলেন। 


রাজপুতানার কয়েকজন রাজা এবং উত্তর ভারতের কয়েকজন পাঠান দলপতির তাঁর সঙ্গে যোগ দিলেন। আগ্রার কাছে হানুয়া নামক স্থানে বাবর ও সংগ্রাম সিংহের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হলো। সংগ্রাম সিংহের নেতৃত্বে রাজপুত্ররা খুব বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করল বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয়ী হলেন বাবর। পরাজয়ের গ্লানি সংগ্রামের পক্ষে অসহ্য হলো, খানুয়ার যুদ্ধের অল্পদিন পরেই তিনি অকালে প্রাণ ত্যাগ করলেন।


      সংগ্রাম সিংহের পরাজয়ের পর বাবরের সঙ্গে বিহারের পাঠান  দলপতিগনের সংঘর্ষ হলো। আবার বাবর জয় লাভ করলেন, তাঁর নতুন সাম্রাজ্যের ভিত্তি সুদৃঢ় হলো। কিন্তু ভারতবর্ষে মাত্র চার বছর রাজত্ব করার পর অকালে তাঁর মৃত্যু হল। 



      ভারতবর্ষের সুদীর্ঘ ইতিহাসে বাবরের ন্যায় সাহসী ও গুনবান রাজার কাহিনী বেশি পাওয়া যায় না। অসামান্য বীরত্ব,সাহস, ধৈর্য ও অধ্যাবসায়ের বলে তিনি সুদূর মধ্য এশিয়া থেকে এসে ভারতবর্ষে একটি বিশাল সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন করেছিলেন। তিনি যে কেবল যোদ্ধা ছিলেন তা নয়, তিনি বেশ লেখাপড়া জানতেন  এবং ফরাসি ভাষায় সুন্দর কবিতা রচনা করতেন। তিনি নিজের মাতৃভাষা তুর্কিতে নিজের জীবন-চরিত্র লিখেছিলেন। এই বইতে বাবন নিজের জীবনের সকল কথায় সরল অস্পষ্টভাবে বলেছেন, নিজের দোষ ও ব্যর্থতার কথা গ্রহণ করেন নাই।


বাবার মৃত্যুর পর তাঁর নির্দেশ অনুসারে তাঁর মৃতদেহ কাবুলের প্রেরিত হয়।  সেখানে তাঁর কবরের উপরে শতাধিক বছর পরে সম্রাট শাহজাহান একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।


 খ্রিষ্টাব্দ


১১৯২ পৃথ্বীরাজের পরাজয়ঃ সুলতানি সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন।

১৩৫১ মোহম্মদ বিন্‌ তুঘলুকের মৃত্যু।

১৩৯৮ তৈমুরলং এর ভারত আক্রমণ।

১৪৮৩ বাবরের জন্ম ।

১৪৯৪ বাবরের পিতা বিয়োগ ও রাজস্ব লাভ।

১৫০৪ বাব্রের কাবুল আধিকার। 

১৫২৬ পানিপথের প্রথম যুদ্ধঃ সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন ।

১৫২৭ খানুয়ায় যুদ্ধ। 

১৫৩০ বাব্রের মৃত্যু।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ