শের শাহের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা কৃতিত্ব। শেরশাহের সংস্কারগুলি আলোচনা করো।

 শের শাহ

বাবরের মত্যর পর দিল্লির বাদশাহী সিংহাসনে বসলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুএ হুমায়ুন । কিন্তু তিনি কয়েক বৎসরের মধ্যেই রাজ্য হারিয়ে পারস্য দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন হুমায়ুন পিতার ন্যায় সাহসী হলেও উদ্যমশীল ও সুচতুর ছিলেন না। তাঁর তিন ভাই তাঁর সঙ্গে  বারবার শত্রুতাচরণ করেন। মত্যুর পরে বাবর তাঁর নতুন রাজ্য সুশাসনের পাকাপাকি ব্যবস্থা করবার সময় পান নাই। হুমায়ুনের দুর্বলতার সুযােগে পাঠান বীর শেরশাহ দিল্লির সিংহাসন অধিকার করলেন।


শের শাহের ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা। শেরশাহের সংস্কার গুলি আলোচনা করো।

শের শাহের জীবন-কাহিনী উপকথার মতাে বিচিত্র। বাল্যকালে  তাঁর নাম ছিল ফরিদ খাঁ। নিজের হাতে একটি বহৎ ‘শের’ বা ব্যাঘ্র হত্যা করে তিনি বিহারের সুলতানের অনগ্রহে ‘শের খাঁ’ উপাধি লাভ করেন। তিনি শূরবংশীয় আফগান বা পাঠান ছিলেন। তাঁর পিতা হাসান খাঁ বিহারের অন্তর্গত সাসারামের জায়গিরদার ছিলেন। বিমান চক্রান্তে ফরিদকে বাল্যে ও কৈশােরে নানারকম কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। তিনি অল্পবয়সে সাসারাম থেকে উত্তর প্রদেশের অন্তর্গত জৌনপুরে চলে যান এবং সেখানে আরবী ও ফারসী ভাষা ও সাহিত্যে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।


জৌনপুরে শিক্ষা শেষ হলে ফরিদ সাসারামে ফিরে এসে কিছুদিন পিতার জায়গিরের তত্ত্বাবধান করেন, কিন্তু বিমাতার ষড়যন্ত্রে তাঁকে অল্পদিন পরে বিহার পরিত্যাগ করতে হয়। তিনি আগ্রায় গিয়ে লােদী সুলতানের দরবারে চাকরি গ্রহণ করেন। কিছুদিন পরে তাঁর পিতার মৃত্যু হল এবং তিনি সাসারামে ফিরে এসে পৈতৃক জায়গির দখল করলেন; কিন্তু জ্ঞাতিদের ষড়যন্ত্রে তিনি বেশীদিন এই সম্পত্তি ভােগ করতে পারলেন না। 


অল্পদিনের মধ্যেই শের খাঁ বাবরের দরবার থেকে কমচ্যুত হয়ে বিহারে প্রত্যাবর্তন করলেন। ইতিমধ্যে তাঁর ছাত্র জালাল খাঁ সুলতান হয়েছিলেন। শের খাঁ এই নাবালক সুলতানের অভিভাবকের পদ লাভ করলেন কিন্তু এখানেও তাঁর শত্রুর অভাব হল না ; বিহারে বড় বড় ওমরাহেরা সুলতানের দরবারে শের খাঁর প্রভাব সহ্য করতে পারলেন না। তাঁরা নাবালক সুলতানকে হস্তগত করে বাংলার হুমায়ুন সুলতান গিয়াসউদ্দীন মামুদ শাহের সঙ্গে মিলিত হলেন। দুই সুলতানের সৈন্যদল শের খাঁকে আক্রমণ করল। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ ও বিহা সীমান্তে সুরজগড় নামক স্থানে যুদ্ধ হল। শের খাঁ এই যুদ্ধে জয়লাভ করে বিহারে রাজত্ব করবার অধিকার পেলেন। সাসারামের জায়গিরদার বাহুবলে ও বুদ্ধিকৌশলে হলেন বিহারের অধিপতি। কিন্তু শের খাঁর উচ্চাভিলাষ এখানেই শেষ হল না, তিনি রাজ্যবিস্তারের সঙ্কল্প  নিয়ে বাংলা দেশ আক্রমণ করলেন।


যখন পূর্ব ভারতে শের খাঁ বাহুবলে পাঠান-রাজত্ব স্থাপন করেন তখন পশ্চিম ভারতে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন গুজরাটের সুলতান বাহাদুর শাহের সঙ্গে যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন। শের খাঁর আকস্মিক ক্ষমতাবৃদ্ধিতে ভীত হয়ে হুমায়ুন তাঁকে দমন করবার জন্য গুজরাট থেকে পর্ব দিকে অগ্রসর হলেন। মুঘল সৈন্যদল বিহারে ও বাংলা দেশে উপস্থিত হল, কিন্তু কৌশলী শের খাঁ সম্রাটের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে প্রবৃত্ত হয়ে শক্তিক্ষয় করলেন না। তিনি মঘল সৈন্যদলের পাশ কাটিয়ে বিহারের পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত দুর্ভেদ্য রােটাস দুর্গ এবং বারাণসী অধিকার করলেন। এই সংবাদ পেয়ে হুমায়ুন বাংলা দেশ থেকে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হলেন। শের খাঁ আর সম্মুখ যুদ্ধে এড়াবার চেষ্ট করলেন না। ক্রমান্বয়ে দুইটি যুদ্ধে-বর্তমান উত্তর প্রদেশে অবস্থিত চৌসা ও কনৌজে—তিনি হুমায়ুনকে পরাজিত করলেন। কিছুদিন


পরে মঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী দিল্লিও শের খাঁর হস্তগত হল। পরাজিত হুমায়ুন ভারতবর্ষ পরিত্যাগ করে পারস্যে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। বিজয়ী শের খাঁ ‘শাহ’ উপাধি ধারণ করে স্বাধীনভাবে রাজত্ব আরম্ভ করলেন। মুঘল বাদশাহি পাঠান বাদশাহিতে পরিণত হল।


শের শাহ মাত্র পাঁচ বৎসর কাল রাজত্ব করেছিলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে তিনি পঞ্জাব ও মালব অধিকার করেন এবং বাংলায় বিদ্রোহ দমন করেন। মারবাডের শক্তিশালী রাজপুত রাজা মালদেব তাঁর কাছে পরাজিত হন। মধ্যভারতে কালিঞ্জর দুর্গ অবরােধ কালে আহত হয়ে শের শাহ, অকালে প্রাণত্যাগ করেন।


শের শাহ শুধু  যে সুদক্ষ যােদ্ধা ছিলেন তা নয় ; শাসনকার্যের বিভিন্ন বিভাগে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁর বিশাল সাম্রাজ্য কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত ছিল। আবার প্রত্যেক প্রদেশ কয়েকটি সরকারে এবং প্রত্যেক সরকার কয়েকটি পরগনায় বিভক্ত ছিল। কতকগুলি গ্রাম নিয়ে একটি পরগনা গঠিত হত। শের শাহের নির্দেশে সমগ্র সাম্রাজ্য জরিপ করা হয় এবং প্রত্যক প্রজার  জমির সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় । উৎপন্ন শস্যের এক-তৃতীয়াংশ রাজকর রপে ধার্যকরা হয়। শের শাহ জমিদার ও প্রজার আধিকার ও  দায়িত্ব সুম্পষ্টভাবে নির্দেশ করে দিয়েছিলেন। তিনি ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করেন, দুষ্ট রাজকর্ম চারীদের আত্যাচার দমন করেন এবং শান্তি রক্ষার জন্য পুলিস  বিভাগে কঠোর শৃঙখলা প্রবর্তন করেন। 


শের শাহের আমলে বহু সদশ্য রৌপ্যমুদ্রা প্রচলিত হয়েছিল। ঐ সকল মদ্রায় ফারসী ও হিন্দী অক্ষরে তাঁর নাম খােদিত ছিল। বাণিজ্যের প্রসার এবং যাতায়াতের সুবিধার জন্য শের শাহ, রাস্তাঘাটের যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। বাংলা দেশ থেকে পঞ্জাব পর্যন্ত যে প্রশস্ত রাজপথ তিনি নির্মাণ করেছিলেন সেটি এখন ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রােড' নামে পরিচিত। পথিকদের সুবিধার জন্য এই সুদীর্ঘ রাজপথের স্থানে স্থানে পান্থশালা নির্মিত হয়েছিল। ধর্ম সম্বন্ধে শের শাহের মত ছিল উদার। তিনি হিন্দু-মুসলমান উভয় শ্রেণীর প্রজাকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। ব্রহ্মজিৎ গৌড় নামক তাঁর একজন বিশ্ব হিন্দ সেনাপতি ছিলেন।


শের শাহের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ইসলাম শাহ্‌ কয়েক বৎসর রাজত্ব করেন। ইসলাম শাহের মৃত্যুর পর শের শাহের আত্মীয়গণের মধ্যে সিংহাসন নিয়ে বিরােধ আরম্ভ হয়। সেই সুযােগে হিমু নামক একজন হিন্দু সেনাপতি খুব ক্ষমতাশালী হন। পাঠানদের মধ্যে যখন সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়ি চলছিল তখন হুমায়ুন  ভারতবর্ষে প্রত্যাবর্তন করে দিল্লি ও আগ্রা অধিকার করেন। আবার দিল্লিতে পাঠানশাসনের অবসান ঘটল, মুঘল বাদশাহি পুনরায় স্থাপিত হল।

খিস্টাব্দ

১৫২৬ - পাণিপথের প্রথম যুদ্ধ

১৫২৬-৩০- বাবরের রাজত্বকাল। 

১৫৩০-৪০ - হুমায়ুনের রাজত্বকাল। 

১৫৩৯ - চৌসার যুদ্ধ। 

১৫৪০- কনৌজের যুদ্ধ। 

১৫৪০-৪৫-শের শাহের রাজত্বকাল

১৫৪৫-৫৩ -ইসলাম শাহের রাজত্বকাল ।

১৫৫৫ -হুমায়ুনের দিল্লি ও আগ্রা অধিকার ।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ