আকবর
হুমায়ুন যখন শের শাহের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পারস্য দেশের দিকে যাত্রা করেন তখন পথে সিন্ধু দেশের অন্তর্গত অমরকোট নামক স্থানে তাঁর প্রথম পুত্র আকবরের জন্ম হয়। এমন আনন্দের সময় আনুচরদিগকে কিছু উপহার দেবার ক্ষমতা রাজ্যচ্যুত বাদশাহের ছিল না, তিনি তখন একেবারে নিঃস্ব। তাঁহার সঙ্গে একটু কস্তুরী ছিল তিনি অনুচরদের মধ্যে কস্তুরীটকু বিতরণ করে বলেছিলেন, “এই কস্তুরীর সুগন্ধের মতাে আমার পুত্রের সুখ্যাতি যেন চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।” হুমায়নের আশা পূর্ণ হয়েছিল—ভারতবর্ষের মুসলমান রাজগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আকবরের যশ সত্যই চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল।
বাল্যকালে আকবর অনেক দুঃখকষ্ট ভােগ করেছিলেন। হুমায়ুনের ভাইয়েরা নানারকমে তাঁর ক্ষতি করতেন, কিন্তু রাজ্যহারা হুমায়ুন তাঁদের কাছেই নাবালক আকবরকে রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন। সর্বদা যুদ্ধবিগ্রহে ও রাজনৈতিক গােলযােগে বিব্রত থাকায় হুমায়ুন পুত্রের
শিক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেননি। কিন্তু সর্বদা বিপদ্ ও কষ্টের মধ্যে থাকায় আকবর অল্প বয়সেই সাহস, সহিষ্ণতা, শ্রমশীলতা প্রভৃতি গুণ অর্জন করেছিলেন। পুথিঁপত্রের শিক্ষায় বঞ্চিত থেকেও তিনি কর্মক্ষেত্রে অসামান্য যােগ্যতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।
শের শাহের বনশধ্রগনের হাত থেকে দিল্লি ও আগ্রা উদ্ধার করবার ছয় মাস ছয় মাস পরেই হমায়নের মত্যু হয়। তখন আকবরের বয়স চৌদ্দ বৎসর মাত্র। রাজকার্যে অনভিজ্ঞ এই বালকের উপর রাজ্যরক্ষার ভার পড়ল। হুমায়ুনের বিশ্বস্ত বন্ধু, বৈরাম খাঁ ছিলেন তাঁর অভিভাবক।
শের শাহের আত্মীয় পাঠান বংশীয় মােহাম্মদ আদিল শাহ, ছিলেন দিল্লির সিংহাসনের দাবিদার। হিমু নামক তাঁর একজন সুদক্ষ হিন্দু সেনাপতি ছিলেন। নাবালক আকবরকে ভারতবর্ষ থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য হিমু সসৈন্যে তাঁর বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। দিল্লির মুঘল শাসন কর্তাকে পরাজিত করে হিমু উপস্থিত হলেন পাণিপথে। সেখানে বৈরাম খাঁ তাঁকে পরাজিত করলেন। দিল্লিতে পাঠান-রাজত্ব পুনরায় স্থাপন করার সম্ভাবনা একেবারে বিনষ্ট হল। আকবরের সিংহাসন নিরাপদ হল।
হুমায়ুন কেবলমাত্র দিল্লি ও আগ্রা মুঘল অধিকারে এনেছিলেন। পাণিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধের পর বৈরাম খাঁ আকবরের পক্ষে রাজ্যবিস্তারে প্রবত্ত হলেন। রাজপুতানার অন্তর্গত আজমীর, মধ্যভারতে গােয়ালিয়র এবং বর্তমান উত্তরপ্রদেশে অবস্থিত জৌনপুর অধিকার করলেন।
আকবরের বয়স কম বলে বৈরাম খাঁ তাঁর নামে নিজেই রাজ্যশাসন করতেন। ১৮ বৎসর বয়সে আকবর স্বহস্তে রাজ্যশাসনের ভার গ্রহণ - করবার উদ্দেশ্যে বৈরাম খাঁকে পদচ্যুত করলেন। বৈরাম খাঁ এই ব্যবস্থা মেনে না নিয়ে বিদ্রোহী হলেন। আকবর তাঁকে পরাজিত করলেন, কিন্তু তাঁর অপরাধ ক্ষমা করা হল। বৈরাম খাঁ মুঘল রাজবংশের যে উপকার করেছিলেন তা স্মরণ করে আকবর তাঁকে শাস্তি দিলেন না। বৈরাম খাঁ মক্কা যাত্রা করলেন। পথে একজন পাঠান ব্যক্তিগত আক্রোশ বশত তাঁকে হত্যা করল।
আকবর প্রায় পঞ্চাশ বৎসর রাজত্ব করেছিলেন। এই সুদীর্ঘ রাজত্বকালের অধিকাংশ সময়ই তিনি যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত ছিলেন। বাহু,বলে সমগ্র উওর ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের এক অংশ তিনি অধিকার করেছিলেন। বিজয়ী আকবরের নাম ইতিহাস মনে রেখেছে, কিন্তু যারা স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁর বিরদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁদের কীর্তি-কাহিনীও বেঁচে রয়েছে।
মেবারের রানা প্রতাপসিংহের সঙেগ আকবরের তোর কথা পরে বলা হবে। আকবর কেবল যে এই রাজপুত বীরের কাছেই বাধা পেয়েছিলেন তা নয়; সেকালের দুই বীরাঙ্গনা- রানী দুর্গাবতী ওদুর্গাবতী ও চাঁদ সুলতানা- তাঁকে খুবই ব্যতিব্যস্ত করে তুলেছিলেন। স্বাধীনতা রক্ষ্যার জন্য কেবল পুরুষেরা নয়, মেয়েরাও সেকালে তরবারি গ্রহন করতেন।
বর্তমান মধ্যভারতের উত্তর ভাগে তখন গড়মণ্ডল নামে এক হিন্দু-রাজ্য ছিল। আকবরের সময়ে রানী দুর্গাবতী তাঁর নাবালক পুত্রের নামে ঐ রাজ্য শাসন করতেন। স্ত্রীলােক হলেও বুদ্ধিতে ও বীরত্বে তিনি কোন পুরুষের চেয়ে কম ছিলেন না। গড়মণ্ডল রাজ্যের চিরদিনই স্বাধীন ছিল, কখনও দিল্লির বাদশাহের অধীনতা স্বীকার করে নাই। আকবর অনেক সৈন্যসামন্তসহ এক সেনাপতিকে রানী দুর্গাবতীর রাজ্য অধিকার করতে পাঠালেন। বিশাল মুঘল বাহিনীকে বাধা দেবার শক্তি রানী দুর্গাবতীর ছিল না। তাঁর ক্ষুদ্র সৈন্যদল বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করল ; তিনি নিজে আহত হলেন। অবশেষে জয়লাভের আর উপায় নাই দেখে রানী যুদ্ধ্যক্ষত্রে প্রাণ বিসর্জন দিলেন।
গড়মণ্ডল রাজ্য আকবরের অধীন হল বটে, কিন্তু রানী দুর্গাবতীর নাম ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করল।
আকবরের রাজত্বকালের শেষভাগে আর এক বীরাঙ্গনা তাঁর সৈন্যদলের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তাঁর নাম চাঁদ সুলতানা ।
আকবরের সময় দাক্ষিণাত্যে চারটি প্রধান মুসলমান-রাজ্য ছিল--খান্দেশ, আহম্মদনগর, বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা। প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত অধিকার করে তিনি দাক্ষিণাত্য জয়ে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন। খান্দেশের সুলতান বিনা যুদ্ধে তাঁর অধীনতা স্বীকার করলেন। তখন আকবরের সৈন্যদল আহম্মদনগর রাজ্য আক্রমণ করল। এই রাজ্যের সুলতান ছিলেন নাবালক, তাঁর অভিভাবিকা ছিলেন তাঁর পিসি—বিজাপুরের রাজকুলবধু চাঁদ সুলতানা। চাঁদ সুলতানা সাহসে ও বুদ্ধিতে রানী দুর্গাবতীর মতাে ছিলেন। মুঘল বাহিনী তাঁর কাছে প্রচণ্ড বাধা পেল।
তিনি নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত থেকে মুঘলদের আক্রমণ ব্যর্থ করলেন।
কিছু দিন পরে আহম্মদনগর রাজ্যের অন্তর্গত বেরাহ প্রদেশ আকবরের হস্তগত হল। তখন আহম্মদনগরে নানা রকম গােলমাল শুরু হল। কয়েকজন প্রধান ওমরাহ, নিজেদের স্বার্থসিদিধর জন্য চাঁদ সুলতানাকে হত্যা করলেন। সুযোগ বুঝে আকবর আবার আহম্মদনগর নগরের বিরদ্ধে সৈন্য পাঠালেন। এবার আহম্মদনগর শহর মুঘল বাহিনীর হস্তগত হল। কিছুদিন পরে খান্দেশ রাজ্যে আকবরের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আকবরের রাজত্বকালে গুজরাট, বাংলা দেশ এবং উড়িষ্যা মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। গুজরাটে প্রচুর সম্পদ ছিল, কিন্তু সুশাসনের অভাবে রাজ্যটি শক্তিহীন হয়ে পড়েছিল। রাজ্যের বড় বড় লােকদের মধ্যে দলাদলি ছিল। এই দুর্বলতার সুযােগ গ্রহণ করে আকবর গুজরাট আক্রমণ করলেন। দু'বার আক্রমণের ফলে গুজরাটে তাঁর আধিপত্য স্থাপিত হল।
গুজরাট জয়ের পর মুঘল সৈন্যদল বাংলা দেশ আক্রমণ করল। তখন বাংলার স্বাধীন অধিপতি ছিলেন পাঠানবংশীয় দায়ুদ খাঁ। মুঘলদের আক্রমণে তাঁর পরাজয় ও মৃত্যু হল। বাংলা দেশ মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত হল। কিন্তু বাংলার বিভিন্ন অংশে কিছুকাল ক্ষমতাশীল হিন্দু ও মুসলমান জমিদারদের ক্ষমতা প্রবল ছিল। এই জমিদারদের মধ্যে যাঁরা প্রধান ছিলেন তাঁরা ইতিহাসে ‘বার ভুইঞা’ নামে পরিচিত।
বঙ্গবিজয়ের দীর্ঘকাল পরে আকবর উড়িষ্যা দখল করেন। উত্তর-পশ্চিমে কাশ্মীর, সিন্ধু, বেলুচিস্তান এবং আফগানিস্তানের অন্তর্গত কাবুল ও কান্দাহার আকবরের অধীনতা স্বীকার করেছিল।
আকবরই ভারতে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। শের শাহের বংশের পতনের পর হুমায়ুন কেবলমাত্র পঞ্জাব, দিল্লি ও আগ্রা ছাড়া ভারতের অন্য কোন অঞ্চল অধিকার করবার সময় পাননি। আকবর বাহুবলে ও বুদ্ধিকৌশলে এই ক্ষুদ্র রাজ্যকে বাড়িয়ে এক বিশাল সাম্রাজ্যে পরিণত করেন। নেপাল, সিকিম, ভুটান ও আসাম আকবরের সাম্রাজ্যের বাইরে ছিল। সমগ্র উত্তর ভারত, দাক্ষিণাত্যের কিয়দংশ, বেলুচিস্তান এবং আফগানিস্তানের অধিকাংশই তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। শের শাহের সাম্রাজ্য আকবরের সাম্রাজ্যের তুলনায় আকারে অনেক ছােট ছিল। দীর্ঘকাল পরে আকবর ভারতবর্ষে রাজনৈতিক ঐক্য পুনঃস্থাপন করেছিলেন।
আকবর জানতেন যে কেবলমাত্র যুদ্ধ দ্বারা থায়ী সাম্রাজ্য গঠন করা যায় না; সাম্রাজ্য স্থায়ী ও শক্তিশালী করতে হলে সুশাসন-প্রবর্তন করে প্রজাদের সন্তুষ্ট রাখতে হয়। প্রজাদের মঙ্গলের প্রতি আকবরের বিশেষ দৃষ্টি ছিল। তিনি তাঁর বিশাল সাম্রাজ্যের সশাসনের বন্দোবস্ত করেছিলেন।
মুঘল আমলে সম্রাটের ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনুসারে শাসনকার্য পরিচালিত হত। সম্রাটের ইচ্ছায় বাধা দিবার অধিকার মন্ত্রীদের বা প্রজাদের ছিল না। একালের গণতন্ত্র সেকালের ভারতবর্ষে অজানা ছিল। কিন্তু আকবরের মতাে প্রজাপালক সম্রাটের আমলে জনসাধারণের উপর অত্যাচার হত না।
আকবর শাসনকার্য পরিচালনায় কয়েকজন মন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ। করতেন। বহু উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী তাঁকে রাজকার্যে সাহায্য করতেন। এরা ‘মনসবদার’ নামে পরিচিত ছিলেন। মনসবদারগণ অনেকগুলি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। নিজ নিজ মর্যাদা ও দায়িত্ব অনুসারে তারা রাজকোষ থেকে নগদ বেতন পেতেন। তাঁরা সসৈন্যে সমাটের সৈন্যদলে যােগদান করতেন।
শাসনকার্যের সুবিধার জন্য আকবরের বৃহৎ সাম্রাজ্যকে পনেরটি ‘সুবা’ বা প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিল। এই পনেরটি সুবার নাম- কাবুল, লাহোর, মুলতান, দিল্লি,আগ্রা, অযােধ্যা, এলাহাবাদ, আজমীর, গুজরাট, মালব, বিহার, বাংলা ও উড়িষ্যা, খান্দেশ, বেরার, আহম্মদনগর। প্রত্যেক সুবায় ‘সিপাহসালার’ বা ‘নাজিম' নামে একজন শাসনকর্তা ছিলেন ; তাঁকে ‘সুবাদার'ও বলা হত। আবার প্রত্যেক সুবায় রাজস্ব আদায় ও হিসাব-নিকাশের জন্য একজন ‘দেওয়ান' থাকতেন। প্রত্যেক সুবা কয়েকটি সরকার বা জেলায় বিভক্ত ছিল। জেলার প্রধান শান্তিরক্ষক ছিলেন ‘ফৌজদার'। মামলা-মকদ্দমার বিচার করতেন ‘কাজী’ ও ‘মুফ্তি'। বড় বড় শহরে কোতােয়াল’ শান্তিরক্ষা করতেন।
আকবর রাজস্ব বিভাগের অনেক উন্নতি সাধন করেছিলেন। এই বিষয়ে তাঁর প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন রাজা তােডরমল। শের শাহের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে আকবর জমি জরিপের ব্যবস্থা করেন।উর্বরতা অনুসারে কৃষিকার্যের উপযুক্ত জমি কয়েকটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছিল। উৎপন্ন শস্যের এক-তৃতীয়াংশ রাজকর রুপে নেওয়া হত। প্রজারা ইচ্ছামতাে নগদ টাকা বা শস্য দ্বারা রাজকর দিতে পারত। আকবর অনেক রকম করে ও শুল্ক তুলে দিয়ে প্রজাদের হিতসাধন করেছিলেন।
আকবর সাম্রাজ্য শাসনে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে প্রভেদ স্বীকার করতেন না। তিনি জানতেন যে হিন্দুর সাহায্য ছাড়া সাম্রাজ্য রক্ষা করা যাবে না, হিন্দুকে মুঘল-শাসনের অনুরাগী না করলে সাম্রাজ্য শক্তিশালী হবে না। তিনি নিজেকে হিন্দু মুসলমান সকল প্রজার শাসক ও পােষক বলে মনে করতেন।
সকল বিষয়ে হিন্দদিগকে মুসলমানদের সমান অধিকার দিয়ে তিনি তাঁদের শ্রদ্ধা ও সহযােগিতা লাভ করেছিলেন। তিনি গুণবান, হিন্দুদিগকে উচ্চ রাজপদে নিযুক্ত করতেন। রাজা তােডরমল আকবরের সেনাপতি ও রাজস্ব-সচিব ছিলেন। রাজপুতানার অন্তর্গত অম্বরের রাজা মানসিংহ তাঁর একজন প্রধান সেনাপতি ছিলেন। হলদীঘাটের যুদ্ধে মানসিংহ চিতােরের রানা প্রতাপসিংহকে পরাজিত করেছিলেন । রাজপুত রাজাদের সঙ্গে বৈবাহিক স্থাপন করে আকবর তাঁদের আনুগত্য লাভ করেছিলেন।
তিনি অদ্বয় ও যােধপুরের দুই রাজকন্যাকে বিবাহ করেন। অশ্বরের এক রাজকন্যার সঙ্গে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র যুবরাজ সলীমের বিয়ে হয়েছিল। সাধারণ হিন্দুরাও আকবরের উদার শাসনে নানা প্রকারে উপকৃত হয়েছিল। মুসলমান আমলে হিন্দুদের ‘জিজিয়া' নামে একটি কর দিতে হত। হিন্দু, তীর্থযাত্রীদের কাছ থেকে আলাদা কর নেওয়া হত। আকবর এই দুটি কর তুলে দেন। তিনি আদেশ দেন যে হিন্দুরা বিনা বাধায় তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী সকল রকম ধর্মকার্য করতে পারবে। আকবর, হিন্দুদিগকে উদারতার দ্বারা বশ করেছিলেন বলেই মুঘল সাম্রাজ্য তাঁর মৃত্যুর পরেও একশত বৎসরের অধিক কাল সগৌরবে বর্তমান ছিল।
ধর্ম সম্বন্ধে আকবরের কোনরকম গোঁড়ামি ছিল না। সকল ধর্মেই যথার্থ সত্য আছে—এই মূল সত্যটি তিনি স্বীকার করতেন। তিনি হিন্দু,পণ্ডিত, জৈন সন্ন্যাসী, মুসলমান মৌলবী এবং খিস্টান পাদ্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের বিষয়ে আলােচনা করতেন। সকলেই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ ধর্মের মত ব্যাখ্যা করতেন, আকবর সকলের কথাই মনােযােগ দিয়ে শুনতেন। আগ্রার নিকটবতী ফতেপুর সিক্লীতে আকবর এক নতুন রাজধানী নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে ‘ইবাদৎখানা’ নামক প্রাসাদে ধর্মালােচনায় আকবর এক নতুন মতবাদ প্রবর্তন করেন। এর নাম ‘দীন ইলাহী'। এতে সকল ধর্মের সারমর্ম সংগহীত হয়েছিল। অনেক বড় বড় লােক ‘দীন ইলাহী’ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বেচ্ছায় কেউ একে গ্রহণ না করলে আকবর কখনও বলপ্রয়ােগ করতেন না। তাঁর মৃত্যুর পর ‘দীন ইলাহী' বিলুপ্ত হয়ে যায়।
বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার মতাে আকবরের দরবারে বহু গুণী ব্যক্তি আয়লাভ করেছিলেন। আকবরের বন্ধু আবুল ফজল অসাধারণ বিদ্বান্ ও বুদ্ধিমান্ ছিলেন। তিনি ‘আকবর-নামা’ এবং ‘আইন-ই-আকবরী' নামক দু'খানি মূল্যবান্ গ্রন্থ রচনা করেন। ফারসী ভাষায় লেখা এই বই দু'খানি পড়লে আকবরের রাজত্বকালের ইতিহাস এবং তাঁর শাসন-পদ্ধতি সম্বন্ধে বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়।
আবুল ফজলের বড় ভাই ফৈজী বিখ্যাত পণ্ডিত ও কবি ছিলেন। তিনি সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে হিন্দুদের প্রাচীন দর্শন ও সাহিত্যের আলােচনা করেছিলেন। আকবরের আদেশে অথববেদ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি সংস্কৃত ভাষায় লিখিত গ্রন্থের ফারসী অনুবাদ করা হয়। আকবরের সভাসদ্ রাজা বীরবল,সুরসিক ও সুকবি ছিলেন। তিনি চমৎকার হিন্দী কবিতা লিখতেন। তানসেন ছিলেন বিখ্যাত গায়ক।
আবুল ফজল লিখেছেন যে তানসেনের মতাে সঙ্গীতজ্ঞ তিনি এত বড় সাম্রাজ্য গঠন করতে এবং তার সুশাসনের ব্যবস্থা করতে সফল হয়েছিলেন। তাঁর গুণমুধ হিন্দু প্রজারা ‘দিল্লীশ্বরাে বা জগদীশ্বরাে বা' (অর্থাৎ দিল্লীর সম্রাট্ বা পথিবীর ঈশ্বর) বলে শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁর নাম উল্লেখ করত।
ভারতবষ হিন্দু-মুসলমানের দেশ, মৈত্রী ও শান্তির দেশ—ইহাই আকবরের বাণী। এই বাণী অনুসরণ করবার প্রয়ােজন তাঁর মৃত্যুর সাড়ে তিন শত বৎসর পরেও অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
১৫২৬ পাণিপথের প্রথম যুদ্ধ : মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত্তিস্থাপন।
১৫৫৫ হমায়নের দিল্লি ও আগ্রা অধিকার খিস্টাব্দ।
১৫৫৬ হমায়ুনের মৃত্যু : আকবরের রাজ্যলাভ পাণিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ।
১৬০৫ আকবরের মৃত্যু।
0 মন্তব্যসমূহ