প্রতাপাদিত্য রানা প্রতাপসিংহের বীরত্বের কীর্তি কাহিনী

প্রতাপাদিত্য  রানা প্রতাপসিংহ

প্রতাপাদিত্য  রানা প্রতাপসিংহের বীরত্বের কীর্তি কাহিনী



      চিতােরের প্রতাপাদিত্য রানা সংগ্ৰামসিংহ বাবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে খানুয়ায় পরাজিত হয়েছিলেন। আকবর যখন দিল্লীর বাদশাহ, তখন চিতােরের রানা ছিলেন সংগ্রামসিংহের পুত্র উদয়সিংহ। অম্বর যােধপুর (মারবাড়) প্রভৃতি রাজ্যের রাজপুত রাজগণ বিনা যুদ্ধে আকবরের অধীনতা স্বীকার করেছিলেন এবং কেউ কেউ মুঘল রাজ-পরিবারে কন্যা দান করে সম্রাটের সঙ্গে আত্মীয়তা সূত্রে আবদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু উদয়সিংহ আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেন নাই। বন্ধুভাবে  তাঁকে বশীভূত করতে না পেরে আকবর তাঁকে শাস্তি দেবার সঙ্কল্প করলেন। তিনি নিজেই বহ সৈন্যসামন্ত নিয়ে চিতোর আক্রমণ করলেন।


       খাড়া, উঁচু পাহাড়ের উপরে চিতাের দুর্গ । একটি মাত্র পথ। সেই পথে উপরে উঠে দুর্গ দখল করা সহজ কথা নয়। উদয়সিংহ : চিতাের ছেড়ে আরাবল্লী পর্বতের দগম অঞ্চলে চলে গেলেন। দুর্গ রক্ষার ভার থাকল জয়মল ও পত্তা নামক দুই বীরের উপর। কয়েকদিন যুদ্ধের পর হঠাৎ আকবরের গুলিতে জয়মল প্রাণ হারালেন। তখন রাজপুতরা আর দুর্গ রক্ষা করতে পারল না। বহু সহস্র রাজপুত বীরের প্রাণ গেল, বহু রাজপুত নারী আত্মসম্মান রক্ষার জন্য জতরব্রত পালন করলেন। কিন্তু চিতাের অধিকার করেও আকবর উদয়

সিংহকে বশে আনতে পারলেন না। উদয়পুর নামে এক নতুন রাজধানী নির্মাণ করে উদয়সিংহ মেবারের পার্বত্য অঞ্চলে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে লাগলেন।


      উদয়সিংহের মত্যুর পর তাঁর বীর পুত্র প্রতাপাদিত্য রানা প্রতাপসিংহ মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে লাগলেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে কিছুতেই তিনি দিল্লীর সম্রাটের অধীনতা স্বীকার করবেন না এবং বাদশাহী বংশে নিজের পরিবারের মেয়েদের বিয়ে দেবেন না। তিনি আরও প্রতিজ্ঞা করলেন যে যতদিন তিনি চিতাের উদ্ধার করতে না পারবেন ততদিন তিনি দাড়ি কামাবেন না, সােনার থালার বদলে গাছের পাতায় রুটি খাবেন এবং তৃণশয্যায় শয়ন করবেন। দীর্ঘকাল যুদ্ধ করেও তি৷নি চিতাের উদ্ধার করতে পারেন নাই, তাই তিনি আজীবন এই প্রতিজ্ঞা পালন করেছিলেন। তাঁর দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে তাঁর বংশধর উদয়পুরের রানারা ইংরেজ আমলেও দাড়ি কামাতেন না, ভোজন-পাএের নিচে গাছের পাতা এবং বিছানার নিচে তৃণ রাখতেন। 


      স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রতাপসিংহ নানারকম কষ্ট সহ্য করেছেন। অল্পসংখ্যক অনুচর নিয়ে তিনি বিশাল মুঘল-বাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘকাল যুদ্ধ করেছেন। বহুদিন তাঁকে বনে-জঙ্গলে বাস করতে হয়েছিল, দীঘকাল তিনি সপরিবারে খাদ্যাভাবে কষ্ট পেয়েছিলেন, কিন্তু তাতেও বীরের হৃদয় বিচলিত হয় নাই। শেষে মুঘলদের হাত থেকে তিনি মেবার রাজ্যের অধিকাংশই উদ্ধার করেছিলেন, কেবলমাত্র রাজধানী চিতাের তাঁর মৃত্যুকালেও বাদশাহী অধিকারে ছিল।


      রাজপুতনায় দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক লােকের একেবারে অভাব ছিল না, আবার প্রভুভক্ত স্বার্থত্যাগী বীরও সেখানে কম জন্মগ্রহণ করেন নাই। প্রতাপাদিত্য রানা প্রতাপসিংহের ছােট ভাই শক্তসিংহ আকবরের পক্ষে যােগ দিয়েছিলেন। শেষে তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে প্রতাপের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেন, মহানুভব রানা সস্নেহে ভাইকে বুকে টেনে নেন। একবার অর্থাভাবে যুদ্ধ চালাতে না পেরে প্রতাপসিংহ ঠিক করলেন যে রাজপুতানা ছেড়ে অন্য কোন দেশে চলে যাবেন, রাজপুতানায় থেকে মুঘলের অধীনতা স্বীকার করবেন না। 


দেশত্যাগ করতে হলেও তিনি স্বাধীনতা ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন না। যাত্রার আয়ােজন যখন সম্পূর্ণ হয়েছে তখন তাঁর এক মন্ত্রী এসে নিবেদন করলেন, “মহারানা, আপনি দেশত্যাগ করবেন না। আমার পূর্বপুরুষেরা বহুদিন এই রাজ্যের মন্ত্রিত্ব করে যে অর্থ সঞ্চয় করেছেন তা আমি দেশের মঙ্গলের জন্য দান করব। আপনি সেই অর্থ নিয়ে নতুন সৈন্য সংগ্রহ করে মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন।” মন্ত্রীর এই স্বার্থত্যাগ ও প্রভুভক্তি দেখে প্রতাপ বিস্মিত হলেন। তিনি দেশত্যাগের সঙ্কল্প ত্যাগ করে আবার আকবরের সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করলেন।


      হলদীঘাট নামক স্থানে মুঘল সৈন্যের সঙ্গে প্রতাপসিংহের ঘোর যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে বাদশাহী বাহিনীর প্রধান নায়ক ছিলেন এক রাজপুত বীরঅম্বরের মানসিংহ। মেবারের রাজপুতদের বীরত্বের তুলনা ছিল না, কিন্তু সংখ্যায় তারা ছিল মুঘলদের চেয়ে অনেক কম, তাই তারা পরাজিত হল। প্রতাপ নিজে যুদ্ধে আহত হন। বাদশাহ সৈন্যের আক্রমণে একবার তাঁর প্রাণ বিপন্ন হয়েছিল। তখন তাঁর অধীন এক সর্দার নিজের প্রাণ দিয়ে তাঁর প্রাণ রক্ষা করেন।


      পথিবীর ইতিহাসে অনেক বীরের কাহিনী আছে, কিন্তু স্বাধীনতার জন্য সর্বস্ব ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত প্রতাপের জীবনে দেখা যায়। তার তুলনা পাওয়া কঠিন।


     প্রতাপাদিত্য রানা প্রতাপসিংহের পুত্র অমরসিংহও দীর্ঘকাল মুঘলদের বিরদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। তখন দিল্লির বাদশাহ ছিলেন আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীর। পিতার ন্যায় সাহস ও মনের বল অমরসিংহের ছিল না। দীর্ঘকাল যুদ্ধ করে মেবারের সরদারেরাও ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই অমরসিংহ অবশেষে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে সন্ধি করলেন। মেবারের স্বাধীনতা গেল। কিন্তু স্বাধীনতার পূজারী রানা প্রতাপের কীর্তি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকল।


                   খিস্টাব্দ


১৫৬৮ আকবর কতৃক চিতাের অধিকার ।

১৫৭২-৯৭ প্রতাপসিংহের রাজত্বকাল ।

১৫৭৬ হলদীঘাটের যুদ্ধ। 

১৬১৫ অমরসিংহ কতৃক জাহাঙ্গীরের বশ্যতা স্বীকার।




একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ