ঈসাঁ খাঁ মানসিংহের যুদ্ধ নীতির কৃতিত্ব ব্যাখ্যা করো

 

ঈসাঁ খাঁ মানসিংহের যুদ্ধ নীতির কৃতিত্ব ব্যাখ্যা করো
ঈসাঁ খাঁ মানসিংহের যুদ্ধ

বাংলার বীর


সাড়ে-সাতশত বৎসর পূর্বে বাংলা দেশে মুসলমান রাজতে গােড়াপত্তন করেছিলেন বখতিয়ার খলজি। প্রায় দেড়শত বৎসর বাংলা ছিল দিল্লির সুলতানী সাম্রাজ্যের অন্তর্গত একটি প্রদেশ। সেকালে বাংলার মুসলমান শাসনকতারা দিল্লিতে কর পাঠাতেন, কিন্তু শাসন, কার্য সম্বন্ধে দিল্লির হকুম গ্রাহ্য না করে তাঁরা নিজেদের ইচ্ছামতাে চলতেন। মােহম্মদ বিন তুঘলকের সময়েই দিল্লির সুলতানী সাম্রাজা ভেঙে পড়ে এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশে কতকগুলি স্বাধীন রাজ্যের উৎপত্তি হয়। বাংলা দেশও তখন স্বাধীন হয়েছিল। স্বাধীন বাংলার শ্রেষ্ঠ সুলতান হুসেন শাহের কথা তােমরা পড়েছ। 


   হুসেন শাহের পরবতী বাংলার এক স্বাধীন সুলতানকে পরাজিত করে পাঠান বীর শের শাহ, বাংলা দেশ অধিকার করেছিলেন, এবং দেশ সুশাসনের বন্দোবস্ত করেছিলেন। কিন্তু তাঁর অযােগ্য বংশধরগণের আমলে বাংলা আবার দিল্লির অধীনতা থেকে মুক্ত হল। বাংলার শেষ স্বাধীন সুলতান দায়ুদ খাঁকে পরাজিত করে আকবর এই প্রদেশটিকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করলেন।

   কিন্তু দায়ুদ খাঁর পরাজয় ও মত্যুর পরেও সমগ্র বাংলা দেশ সহজে বা অল্প সময়ের মধ্যে দিগবিজয়ী মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করে নাই। দিল্লি থেকে বহু দুরে এই বাংলা দেশ। সেকালে রেল, স্টিমার, এরােপ্লেন, টেলিগ্রাফ ছিল না। তাই দিল্লি থেকে সদর বাংলায় কতৃত্ব করা সহজ হত না। তারপর বাংলা নদ-নদীর দেশ, স্থলযুদ্ধে অভ্যস্ত মুঘল বাহিনী এখানে সহজে চলাফেরা করতে পারত না। সেকালে 

বাঙালী হিন্দু-মুসলমানের দেহে শক্তি ও মনে সাহস ছিল। তারা বাদশাহী হুকুম তামিল করার চেয়ে নিজেদের ইচ্ছামতাে কাজ করা পছন্দ করত। এই সকল কারণে প্রবল পরাক্রান্ত সম্রাট আকবরকে বাংলা দেশ বশে আনতে খুব বেগ পেতে হয়েছিল। প্রকৃতপক্ষে আকবর এবং তাঁর সক জাহাঙ্গীরের আমলে দীর্ঘকাল যুদ্ধের পর সমগ্র বাংলা দেশ দিল্লির অধীনতা স্বীকার করে। 


মুঘল বাদশাহির বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল যুদ্ধ করে যাঁরা বাঙালীর সাহস ও রণকৌশলের পরিচয় দিয়েছিলেন তাঁরা ইতিহাসে ‘বার ভুইঞা’ নামে সুপরিচিত। ভুইঞা’ শব্দের সাধারণ অর্থ জমিদার। সেকালে বাংলায় যে মাত্র বারজন জমিদার ছিলেন তা নয়। জমিদারদের মধ্যে যাঁরা বাহুবলে ও বুদ্ধিকৌশলে বিস্তৃত ভূখণ্ড দখল করে মুঘল বাদশাহি প্রতিষ্ঠায় বাধা দিয়েছিলেন তাঁরাই সাধারণভাবে ‘বার ভুইঞা’ নামে খ্যাতিলাভ করেন। আকবরের আমলে রাজপুতানার অন্তর্গত অম্বরের রাজা মানসিংহ দীর্ঘকাল বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন। ভুইঞাদের দমনের ভার আকবর তাঁকেই দিয়েছিলেন।


বর্তমানে বাংলা দেশের অন্তর্গত যশােহর জেলায় ভূষণার  জমিদার বা ভূইঞা ছিলেন কেদার রায়। তাঁর বীর পুত্র চাঁদ রায় মুঘল বিরােধী আফগানদের সঙ্গে যুদ্ধে নিহত হন। পরে ভূষণা দুর্গ মুঘলদের অধিকারে আসে এবং যুদ্ধে আহত হয়ে কেদার রায় পূর্ব দিকে পলায়ন করেন। সেখানে ঈশা খাঁ নামক একজন ভুইঞার সঙ্গে তাঁর মিত্রতা স্থাপিত হয় এবং তিনি বাহুবলে ঢাকা জেলার দক্ষিণ অংশে নিজের অধিকার স্থাপন করেন। 


শ্রীপুরে তিনি নতন রাজধানী স্থাপন করেন। ঈশা খাঁর মত্যুর পর আরাকানী মগ জলদস্যুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে কেদার রায় মানসিংহের বিরদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করেন। রণক্ষেত্রে আহত হয়ে তিনি বন্দী হন। বন্দী অবস্থায় মানসিংহের সম্মুখে আনবার সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মত্যু হয়। কেদার রায়ের মত্যুর ফলে ঢাকা অঞ্চলে মুঘল-প্রভুত্ব  স্থাপনের প্রধান বাধা দূর হল।


বার ভুইঞার মধ্যে যশােহরের প্রতাপাদিত্যের নামই সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। কবি ভারতচন্দ্র লিখেছেন :


যশাের নগর ধাম        প্রতাপআদিত্য নাম

               মহারাজ বঙ্গজ কায়স্থ

 নাহি মানে পাতসায়         কেহ নাহি অটে তায়।

               ভয়ে যত ভূপতি দ্বারস্থ ৷৷


প্রতাপাদিত্যের পিতা শ্রীহরি বাংলার শেষ স্বাধীন পাঠান সুলতান দায়ুদ খাঁর বিশ্বাসভাজন কর্মচারী ছিলেন। দায়ুদ খাঁর পতনের পর তিনি বহু ধনরত্ন নিয়ে বর্তমান বাংলা দেশের অন্তর্গত খুলনা জেলার দক্ষিণ অংশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ঐ অঞ্চলে বহু নদী ও বিস্তৃত জঙ্গল ছিল। বিজয়ী মুঘলেরা ঐ  দুর্গম স্থানে প্রবেশ করতে পারবে না

মনে করে শ্রীহরি সেখানে স্থায়ী বাসস্থান নির্মাণ করলেন। মুঘলের ভয়ে ভীত হয়ে বহু লােক ঐ অঞ্চলে প্রবেশ করল। শ্রীহরি তখন ‘বিক্রমাদিত্য’ উপাধি গ্রহণ করে তাদের উপর রাজত্ব করতে লাগলেন। দক্ষিণ বঙ্গের জঙ্গলাবৃত, জলাভূমিতে এক নতুন রাজ্য গড়ে উঠল।


বিক্রমাদিত্যের মত্যুর পর এই রাজ্যের অধিপতি হলেন তাঁর পুত্র প্রতাপাদিত্য। তাঁর বাহুবলে ও সুশাসনে বর্তমান যশােহর, খুলনা ও বরিশাল জেলার অধিকাংশ এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। ততদিনে বাংলার প্রায় সকল জমিদারই মুঘল বাদশাহের বশ্যতা স্বীকার করেছেন। আকবরের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর পুত্র জাহাঙ্গীর সিংহাসনে বসে ইসলাম খাঁকে বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছেন। ইসলাম খাঁর দৃষ্টি পড়ল খুলনার জঙ্গলে লুকানাে প্রতাপের সমৃদ্ধ রাজ্যের উপর। প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে মুঘলের বিরােধ আরম্ভ হল।  


প্রবল মুঘল শক্তির সঙ্গে বিরােধিতা করা কঠিন দেখে প্রতাপাদিত্য ইসলাম খাঁর সঙ্গে সাময়িক সন্ধি স্থাপন করলেন। কিন্তু শান্তি বেশীদিন স্থায়ী হল না। ইসলাম খাঁ প্রতাপাদিত্যের রাজ্য দখল করবার জন্য ব্যস্ত হয়েছিলেন। ছয় হাজার সৈন্য এবং তিনশত রণতরী প্রতাপের বিরুদ্ধে প্রেরিত হল। প্রতাপের জামাতা ছিলেন বর্তমান বরিশাল জেলার অন্তর্গত বাকলা অঞ্চলের পরাক্রান্ত জমিদার বা ভুইঞা কন্দপরনারায়নের পুত্র রামচন্দ্র। জামাতা যাতে শ্বশুরকে সাহায্য করতে না পারেন সেজন্য বাকলাতেও বাদশাহী ফৌজ প্রেরিত হল। এদিকে প্রতাপাদিত্যও নিশ্চেষ্ট ছিলেন না। তিনি বহু সৈন্য ও রণতরী সংগ্রহ করলেন। ফিরিঙ্গি (পর্তুগীজ) এবং পাঠান সেনানায়কদের সাহায্যে তিনি যুদ্ধের আয়ােজন সম্পূর্ণ করলেন।


বর্তমান চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তর্গত বনগাঁও শহরের দশ মাইল দক্ষিণে সালকা নামক স্থানে বাদশাহী ফৌজের সঙ্গে প্রতাপাদিত্যের পুত্র উদয়াদিত্যের যুদ্ধ হল। সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেও উদয়াদিত্য জয়ী হতে পারলেন না। তাঁর রণতরীগুলি ধংস হল, তিনি পলায়ন করে পিতার রাজধানী ধুমঘাটে আশ্রয় গ্রহণ করলেন। যমুনা ও ইচ্ছামতী নদীর মিলনস্থলে ধুমঘাট অবস্থিত। বাকলার রামচন্দ্রও বাদশাহী ফৌজের কাছে পরাজিত হলেন। তাঁকে বন্দী করে ঢাকায় রাখা হল। ঢাকা তখন বাংলার রাজধানী, মুঘল সুবাদারের বাসস্থান। 


চারিদিকে সর্বনাশের কালাে ছায়া দেখেও প্রতাপাদিত্য আত্মবিশ্বাস হারালেন না। বাদশাহী ফৌজের সঙ্গে তাঁর আবার যুদ্ধ হল। এবারও পরাজিত হয়ে তিনি মুঘলদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। কিন্তু ইসলাম খাঁ বীরত্বের মর্যাদা দিলেন না। প্রতাপাদিত্যের রাজ্য কেড়ে নেওয়া হল, তিনি ও তাঁর পুত্রেরা বন্দী হলেন। প্রবাদ আছে যে ঢাকা এক লােহার খাঁচায় কিছুদিন আটক রেখে তাঁকে দিল্লিতে পাঠা ব্যবস্থা করা হয়, কিন্তু পথে বারাণসীতে তাঁর মৃত্যু হয়।


প্রতাপাদিত্য প্রসিদ্ধ ফিরিঙ্গি (পর্তুগীজ) বীর কার্ভালোকে হত্যা করেছিলেন। কাভালাে কিছুকাল কেদার রায়ের অধীনে সেনানায়ক ছিলেন। বর্তমান বাংলা দেশে নােয়াখালি জেলার অন্তর্গত সন্দীপ নামক দ্বীপটি তিনি অধিকার করেছিলেন। এই দ্বীপের অধিকার নিয়ে মুঘল, আরাকানী, মগ এবং পতুগীজদের মধ্যে দীর্ঘকাল যুদ্ধ চলেছিল। সম্ভবত আরাকানের রাজাকে সন্তুষ্ট করবার জন্যই প্রতাপাদিত্য মগদের শত্রু কার্ভালোর প্রাণনাশ করেছিলেন।


এই প্রসঙ্গে ঈশা খাঁ নামক একজন মুসলমান ভুইঞার কীতিকাহিনী বিশেষ উল্লেখযােগ্য। তাঁর উপাধি ছিল ‘মসনদ-ই-আলা'। বর্তমান ঢাকা ও ত্রিপুরা জেলার অধিকাংশ, প্রায় সমগ্র ময়মনসিংহ জেলা এবং রঙ্গপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কোন কোন অংশ তাঁর অধিকারভুক্ত হয়েছিল। বর্তমান নারায়ণগঞ্জের নিকটবতী খিজিরপুর, সাতগাঁও এবং ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে অবস্থিত এগারসিন্দুর তাঁর সামরিক কেন্দ্র ছিল। নদ-নদী-প্লাবিত এই দুর্গম অঞ্চলে থেকে তিনি বারবার বাদশাহী ফৌজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন।


শেষ জীবনে ঈশা খাঁ মানসিংহের আক্রমণে মুঘল সম্রাটের বশ্যতা স্বীকার করেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র মুসা খাঁ কিছুকাল মুঘলদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হন। তখন তাঁর রাজ্য কেড়ে নেওয়া হয়।


দীর্ঘকাল প্রবল মুঘল শক্তির আক্রমণ সহ্য করবার ক্ষমতা বাংলার ভুইঞাদের ছিল না। হয়তাে ভুইঞাদের শাসনের পরিবর্তে মুঘল-শাসন প্রতিষ্ঠা বাংলার পক্ষে মঙ্গলজনক হয়েছিল। মুঘল-শাসন বাংলায় ঐক্যস্থাপন করেছিল। তবু ভুইঞাদের বীরত্ব-কাহিনী বাঙালীর মন থেকে মুছে যায় না। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তাঁদের কঠোর সংগ্রাম তাঁদের নাম স্মরণীয় করে রেখেছে।


খিস্টাব্দ


১৫৫৬-১৬০৫ আকবরের রাজত্বকাল

১৫৭৫-৭৬ দায়ুদ খাঁর পরাজয় ও মত্যু 

১৫৯৪-১৬০৬ বাংলায় মানসিংহের শাসনকাল 

১৫৯৩ চাঁদ রায়ের মত্যু 

১৫৯৯ ঈশা খাঁর মত্যু 

১৬০৩ কেদার রায়ের মৃত্যু 

১৬০৫-২৭ জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল 

১৬০৮-১৩ বাংলায় ইসলাম খাঁর শাসনকাল 

১৬১১ মুসা খাঁর পরাজয় 

১৬১২ প্রতাপাদিত্যের পতন


  



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ