শাহজাহান
সম্রাট আকবরের মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে আহরণ করেন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র জাহাঙ্গীর। তাঁর আমলে বাংলাদেশের মুঘল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, মেবার দিল্লির বশ্যসতা স্বীকার করেছিল। আকবরের মত সাহসী ও বুদ্ধিমান না হলেও জাহাঙ্গীর প্রজাদের সুখ-সুবিধার প্রতি সর্বদা দৃষ্টি রাখবেন।
জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর তাঁর তৃতীয় পুত্র খুরম বা শাহাজাহান সিংহাসন অধিকার করেন। তিনি ৩০ বছর রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্যের অনেক উন্নতি হয়েছিল।
সেকালের সকল রাজাই নিজের রাজ্য বিস্তার করবার চেষ্টা করতেন। শাহজাহান নিজে বিচক্ষণ সেনানায়ক ছিলেন এবং জাহাঙ্গীরের সময়ে নানা যুদ্ধে রণকৌশলের পরিচয় দিয়েছিলেন। সেরা সম্মান লাভ করে তিনি তাকে মারতে স্বাধীন মুসলমান রাজ্যগুলি অধিকার করার আয়োজন করলেন।
আকবর বীরঙ্গনা চাঁদ সুলতানা শাহ সুলতানের সঙ্গে যুদ্ধ আহম্মদনগর রাজ্যে অধিকার করেছিলেন। জাহাঙ্গীরের আমলে ওই রাজ্যের একটি অংশ মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। যেটুকু বাকি ছিল সেটুকু শাহজাহান দখল করেন। আহম্মদনগরের স্বাধীন রাজ-বংশ বিলুপ্ত হলো।
দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর গোলকুণ্ডা নামে আরও দুইটি মুসলমান রাজ্য ছিল। ঐ দুই রাজ্যের সুলতানগণ শাহজাহানের কাছে পরাজিত হয়ে বশ্যতা স্বীকার করলেন, তাঁদের রাজ্য মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হলো না। দাক্ষিণাত্যের মুঘল-শাসিত অংশের শাসনকর্তা নিযুক্ত হলেন শাহজাহান এর তৃতীয় পুত্র ঔরঙ্গজেব।
শাহাজাহানের রাজত্বের শতাধিক বছর আগে পর্তুগিজরা ভারতের বাণিজ্য করতে এসেছিল। পর্তুগিজ জলদস্যুরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর ছিল। তাঁদের নির্মম অত্যাচারের পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গের কোন কোন অংশ শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। আরাকানের দুর্দান্ত মগেরা পর্তুগিজ লুণ্ঠনকারীদের সঙ্গে যোগ দিত। ‘মগের মুলুক’ কথাটির মধ্যে সেকালের ভয়াবহ স্মৃতি বেঁচে রয়েছে ।
পর্তুগীজদের অত্যাচার বন্ধ করবার জন্য শাহজাহান বাংলার শাসনকর্তা কে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মুঘল দৈনদল পর্তুগীজদের প্রধান কেন্দ্র হুগলি অধিকার করল এবং বহু পর্তুগীজকে বন্দি করে দিল্লিতে সম্রাটের দরবারে পাঠিয়ে দিল।
আফগানিস্তানের অন্তর্গত কান্দাহার শহরের অধিকার নিয়ে বহুদিন যাবত পারস্যের শাহ্দের সঙ্গে দিল্লীর মুঘল বাদশাহ্দের বিরোধ চলছিল। শাহজাহানের রাজত্বকালে পারস্যের একজন রাজ কর্মচারী কান্দাহার মুঘলদের হস্তের সমর্থন করেন। কয়েক বছর পরে পারস্যের শাহ্ কান্দাহার অধিকার করেন। শাহজাহান তিনবার কান্দাহার আক্রমণ করেও পারস্যের সৈন্যদলকে বিতাড়িত করতে পারলেন না।মধ্য এশিয়ার অন্তর্গত বল্খ্ ও বদকশান জয় করার জন্য শাহজাহানের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।
শাহজাহান জাঁকজমক ও আড়ম্বর খুব ভালোবাসতেন।তুমি রাজকোষের সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করে নতুন নতুন কারুকার্য শোভিত প্রাসাদ-দুর্গ অন মসজিদ নির্মাণ করেন। এই দিক থেকে বিচার করলে তাঁর কৃতিত্ব তুলনা নেই।
শাহজাহান দিল্লিতে যমুনার তীরে শাহজাহানবাদ নামক এক নতুন শহর নির্মাণ করেন। আকবরের আমলে নির্মিত আগ্রার প্রসাদ দুর্গে ও তিনি বহু নতুন অট্টালিকা নির্মাণ করেছিলেন। দিল্লির জুম্মা মসজিদ দেওয়ান-ই-আম ও দেওয়ান-ই-খাস এবং আগ্রহী মোতি মসজিদ সৌন্দর্যে অতুলনীয়। এগুলি শাহজাহানের স্মরণীয় কীর্তি।
শাহজাহান ৬ কোটি টাকা খরচ করে ময়ূর সিংহাসন নামে প্রসিদ্ধ এক অপূর্ব আসুন নির্মাণ করেছিলেন। এমন বিচিত্র সিংহাসন পৃথিবীতে আর ছিল না। এর চারটি পা ছিল সোনার তৈরি বারটি মণিমাণিক্যখচিত স্তম্ভের উপর মনোহর চন্দ্রাতপ বৃষ্টি পড়ছিল প্রত্যেকটি স্তম্ভের ছিল উজ্জ্বল রত্নখচিত দুইটি ময়ূরের মূর্তি । ময়ূরগুলির ফাঁকে ফাঁকে ছিল মণিমাণিক্য খচিত বৃক্ষ। শাহজাহানের মৃত্যুর প্রায় একশত বৎসর পরে পারস্যের রাজা নাদির শাহ্ ভারতবর্ষ আক্রমণ করেন এবং দিল্লি লুণ্ঠন করে ময়ূর সিংহাসন পারসে্য নিয়ে যান ।
শাহজাহানের শিরস্ত্রাণে কোহিনুর নামক অপূর্ব মনি শোভা পেত। ময়ূর সিংহাসনের সঙ্গে এই মণিও লুণ্ঠন নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন নাদির শাহ্। দীর্ঘকাল পরে ঘটনাচক্রে কোহিনুর মহারানী ভিক্টোরিয়া হস্তগত হয়েছিল।
শাহজাহানের সর্বপ্রধান কীর্তি আগ্রায় যমুনা নদীর তীরে অবস্থিত তাজমহল। এমন সুন্দর সমাধিমন্দির পৃথিবীতে আর নাই। প্রিয়তমা পত্নী মমতাজমহলের মৃত্যুর পর তাঁর স্মৃতি রক্ষার জন্য শাহাজাহান প্রায় ৫০ লক্ষ মুদ্রা ব্যয়ে এই সমাধি মন্দির নির্মাণ করেন। প্রায় 20 হাজার লোক বাইশ বছর পরিশ্রম করে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন।
তাজমহল উদ্দিষ্ট মার্বেল পাথরে নির্মিত দেয়ালে বিচিত্র কারুকার্য। দেশ-বিদেশের শিল্পীরা একত্রিত হয়ে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন। পারস্যের অন্তরগত সিরাজ অধিবাসী ওস্তাদ ঈশা তাজমহলের নির্মাণকার্যের তত্ত্বাবধান করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ অপূর্ব কবিত্বময় ভাষায় তাজমহলের বর্ণনা করেছেঃ
এক বিন্দু নয়নের জল
কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল
এ তাজমহল
শাহজাহানের শেষ জীবন বড়ই কষ্ট করেছিল। তাঁর চার পুএ ছিলেন--দারা, সুজা, আওরঙজেব ও মুরাদ। বৃদ্ধবয়সে শাহজাহান একবার কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত হন। তাঁর মৃত্যুর সম্ভাবনায় তাঁর পুএদেরদ মধ্যে প্রত্যেকেরই সিংহাসন লাভের লোভ হল। ভাইদের মধ্যে আওরঙজেব সর্বাপেক্ষা সুচতুর ও রণনিপুন ছিলেন। তিনি দারা,সুজা ও মুরাদকে প্রাজিত করলেন। দারা ও মুরাদকে তাঁর আদেশে হত্যা করা হল। সুজা ব্রম্ভদেশের অন্তর্গত আরাকানে পালিয়ে গিয়ে সেখানে মগদের হাতে প্রাণ হারালেন। আওরঙজেব দিল্লির সিংহাসন অধিকার করে ‘আলমগির’ (ভুবনবিজয়ী) উপাধি গ্রহণ করলেন। শাহজাহান আগ্রার প্রাসাদে বন্ধী অবস্থায় জীবনের শেষ কয়েক বছর কাটালেন। শেষ জীবনে তাঁর আদ্রের মেয়ে জাহানারা তাঁর সেবা যত্ন করেছিলেন।
খ্রিস্টাব্দ
১৪৯৮ --- পর্তুগীজদের ভারতে আগমন
১৬০৫-১৬২৭ - জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল
১৬২৭-১৬৫৮ - শাহজাহানের রাজত্বকাল
১৭৩৯ ---- - নাদির শাহের ভারত আক্রমণ
0 মন্তব্যসমূহ