আওরঙ্গজেবের রাজ্যবিস্তারের কৃতিত্ব বর্ণনা কর

আওরঙ্গজেবের রাজ্যবিস্তারের কৃতিত্ব বর্ণনা কর

 আওরঙ্গজেব


শাহজাহান জীবিত থাকাতেই আওরঙ্গজেব দিল্লির সিংহাসন অধিকার করেছিলেন। তিনি পঞ্চাশ বৎসর রাজত্ব করেন।


ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ মুসলমান সম্রাটদের মধ্যে আওরঙ্গজেবএকজন। তাঁর অনেক গুণ ছিল। তিনি অসাধারণ সাহসী, বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী ছিলেন। সাম্রাজ্য-শাসক রপে তাঁর কর্তব্যনিষ্ঠা ছিল অতুলনীয়। তিনি সেকালের অন্যান্য রাজাদের মতাে বিলাসী ছিলেন না। তিনি অনেকটা ফকিরের মতাে সরল ও সাদাসিধা জীবন যাপন করতেন। 


তিনি বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের শাসনসংক্রান্ত সকল গুরতর বিষয়ের তত্ত্বাবধান নিজেই করতেন, কর্মচারীদের উপর নির্ভর করতেন না। অবসর সময়ে তিনি কোরান নকল এবং টুঁপি সেলাই করতেন। কোরান ও টুঁপি বিক্রয় করে তিনি যে অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন, তাঁর ইচ্ছানুসারে সেই সামান্য অর্থেই তাঁর সমাধির ব্যয় নির্বাহ করা হয়েছিল। 


ইসলাম ধর্মে তাঁর অগাধ ভক্তি ছিল। এই ধর্মের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবার জন্য তিনি বাদশাহী দরবারে গানবাজনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাঁর পাণ্ডিত্য ছিল প্রগাঢ়। তাঁর লেখা চিঠিপত্র পড়লে আরবী ও ফারসী ভাষায় এবং সাহিত্যে তাঁর পারদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যায়।


কিন্তু এত গুণ থাকতেও আওরঙ্গজেব আদর্শ সম্রাট রুপে গণ্য করা যায় না। কোন কোন বিষয়ে তাঁর দৃষ্টি ছিল সঙ্কীর্ণ। মােটের উপর তাঁর চরিত্রে রাজনৈতিক দরদর্শিতার অভাব ছিল। তিনি কা’কেও বিশ্বাস করতেন না। নিজের ছেলেদের অধীনেও তিনি বেশী সৈন্য রাখতেন না, তারা কখন বিদ্রোহী হয় এই ভয়ে তিনি সন্ত্রস্ত থাকতেন। 


এই জন্যই শাসনসংক্রান্ত সকল কাজ তিনি নিজে দেখতেন। কিন্তু এতবড় সাম্রাজ্যের সকল কাজ একজন লােকের পক্ষে তত্ত্বাবধান করা অসম্ভব ছিল। তাঁর ব্যবহারে বড় বড় রাজকর্মচারিগণ ও সেনাপতিগণ তাঁর উপর অসন্তুষ্ট ছিলেন।


আওরঙ্গজেবর চরিত্রের সব চেয়ে বড় ত্রুটি ছিল ধর্ম বিষয়ে উদারতার অভাব। আকবর যে উদার নীতির ফলে হিন্দুদের আনুগত্য ও শ্রদ্ধা লাভ করেছিলেন, আওরঙ্গজেব তা অনুসরণ না করে শাসনকার্যে বিপরীত নীতি অনুসরণ করেছিলেন। হিন্দুদের বিশ্বাস করে আকবর পেয়েছিলেন তাদের বিশ্বাস এবং সহযােগিতা, আর হিন্দুদের অবিশ্বাস করে ঔরঙ্গজেব  পেয়েছিলেন তাদের সন্দেহ ও শত্রুতা। 


আওরঙ্গজেব রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য আয়তনে ও খ্যাতিতে উন্নতির চরম সীমায় উঠেছিল; কিন্তু তাঁর ভ্রান্ত এবং অনুদার নীতির জন্য তাঁর ১ম জীবনেই এই বিশাল সাম্রাজ্যের ধংস আরম্ভ হয়েছিল।


সিংহাসন লাভের অল্পদিন পরেই ঔরঙ্গজেব  তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মীর জুমলাকে কোচবিহার ও আসাম জয় করতে প্রেরণ করেন। মীর জুমলা পথে বহু কষ্ট সহ্য করে আসামে উপস্থিত এবং আসামের অহােম রাজাকে দিল্লির অধীনতা স্বীকার করতে বাধ্য করেন। আসামের রাজধানী গড়গাঁও এবং গৌহাটি শহর মুঘলদের হস্তগত হয়। কিন্তু কয়েক বৎসরের মধ্যেই অহােম রাজা গৌহাটি , গড়গাঁও আবার অধিকার করেন। আসামে মুঘল অধিকার স্থায়ী হয় নাই। কিন্তু মীর জুমলার আক্রমণে কোচবিহারের রাজা বাদশাহের প্রভুত্ব স্বীকার করেছিলেন।


মীর জুমলার পর শায়েস্তা খাঁ বাংলার সুবাদার হন। তিনি আরাকানের মগদের বিতাড়িত করে চট্টগ্রাম অধিকার করেন। আকবরের বাংলা আক্রমণের প্রায় শতবর্ষ পরে বাংলার পূর্ব-দক্ষিণ প্রান্তে মুঘল অধিকার স্থাপিত হয়।


আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যের অন্তর্গত বিজাপুর ও গােলকুণ্ডা নামক মুসলমান-রাজ্য দুইটি অধিকার করেছিলেন। তাঁর আমলে দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য সর্বাধিক প্রসার লাভ করে।

 

আওরঙ্গজেব রাজত্বকালে মেবারও যােধপুর (বা মারবাড়া রাজ্যের রাজপুতেরা মুঘল আধিপত্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। রাজপুতেরা আকবরের সময়ে নানা প্রকারে মুঘল সাম্রাজ্যের সাহায্য করেছিল। ধর্মের জন্য এবং অন্যান্য কারণে তাদের সন্দেহ উৎপাদন করে আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের যথেষ্ট ক্ষতি করেছিলেন। 


যোধপুরের রাজা যশােবন্তসিংহ অকালে মারা যান। তখন তাঁর শিশুপুত্র অজিত সিংহকে সিংহাসন না দিয়ে ঔরঙ্গজেব যােধপুর রাজ্য অধিকার করেন। রাজপুতেরা এই অন্যায় ব্যবস্থা মেনে না নিয়ে যুদ্ধ আর করে। মুঘল-বিরােধী রাজপুতদের নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন নাবালক অজিত সিংহের অভিভাবক রাঠোর সরদার দুর্গাদাস এবং মেবারের রানা মহাবীর  রাজসিংহ। 

দীর্ঘকাল যুদ্ধ করেও আওরঙ্গজেবর রাজপুত বিদ্রোহ দমন করতে পারলেন না। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বাহাদুর শাহ, অজিত সিংহকে যােধপুরের রাজা বলে স্বীকার করলেন। তখন রাজপুতদের সঙ্গে মুঘলদের সন্ধি হল।


আওরঙ্গজেবর সময়ে কেবল যে রাজপুতরাই বিদ্রোহী হয়েছিল তা নয়, শিবাজীর নেতৃত্বে দাক্ষিণাত্যে মারাঠা জাতিও স্বাধীন হয়েছিল। ক্রমাগত বহু বৎসর কাল তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেও আওরঙ্গজেব মহারাষ্ট্রে মুঘলশাসন পুনঃস্থাপন করতে পারলেন না। পঞ্জাবের শিখগুরু তেগ বাহাদুর আওরঙ্গজেবের আদেশে নিহত হন। তাঁর পুত্র গুরু গােবিন্দসিংহ শিখ সম্প্রদায়কে নতুন ভাবে ও শক্তিতে অনুপ্রাণিত করে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আরম্ভ করেন। 


মথুরায় জাঠেরা বিদ্রোহী হল। ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আফ্রিদি প্রভৃতি কয়েকটি দুর্দান্ত পার্বত্য জাতিও বিদ্রোহ ঘােষণা করল। দীর্ঘকাল বিভিন্ন রণক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে মুঘল বাহিনীর শক্তিক্ষয় হল। দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা কালে বৃদ্ধ বয়সে আওরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়।


মুঘল সাম্রাজ্যের পতনঃ-


আওরঙ্গজেবর শেষ জীবনে মুঘল সাম্রাজ্যে ভাঙন ধরেছিল। | তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্যের পতন আরম্ভ হল। তাঁর বংশধরেরা ছিলেন দুর্বল, এতবড় সাম্রাজ্য রক্ষা করার ক্ষমতা, তাঁদের ছিল না। সম্রাটদের দুর্বলতার সুযােগ নিয়ে প্রাদেশিক শাসনকতারা স্বাধীন হতে লাগলেন। মারাঠাদের শক্তিবৃদ্ধি হল। 


পারস্যের রাজা নাদির শাহ ভারতবর্ষ আক্রমণ করলেন। তিনি দিল্লী অধিকার করে বহু সহস্র লােককে হত্যা করলেন। তারপর শাহজাহানের মহামূল্য ময়ূর সিংহাসন ও কোহিনুর মণি এবং প্রচুর ধনরত্ন সঙ্গে নিয়ে তিনি পারস্যে ফিরে গেলেন। কিছুদিন পরে কাবুলের অধিপতি আহম্মদ শাহ আবদালি পঞ্জাব অধিকার করলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি ও গৌরব নিঃশেষিত হয়ে গেল।


যদি ঔরঙ্গজেব দূরদর্শী আকবরের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে হিন্দুদের সঙ্গে উদার ব্যবহার করতেন তবে হয়তো মুঘল সাম্রাজ্য আরাে বহুদিন স্থায়ী হত। তাঁর সময়ে রাজপুত, মারাঠা, শিখ প্রভৃতি সাহসী ও যুদ্ধ নিপুণ জাতির মনে অসন্তোষ সৃষ্টি না হলে মুঘল সাম্রাজ্য বােধ হয় এত শীঘ্ন ভেঙে পড়ত না। কিন্তু আওরঙ্গজেব অনুদারতা এবং তার বংশধরদের অযােগ্যতা ছাড়া মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের আরাে কারণ ছিল। সেকালে যাতায়াতের সুব্যবস্থা ছিল না, সংবাদ দেওয়া-নেওয়া সময়সাপেক্ষ ছিল। দিল্লি বা আগ্রা থেকে এতবড় সৗম্রাজ্যের উপর কর্তৃত্ব বজায় রাখা দুঃসাধ্য ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের বিশাল আয়তন তার পতনের অন্যতম কারণ।


খিস্টাব্দ


১৬৫৮-১৭০৭ আওরঙ্গজেবের রাজত্বকাল 

১৭৩৯ নাদির শাহের রাজত্বকাল 

১৮৫৮ শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের পদচ্যুতি


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ