শিবাজীর জীবন-কাহিনী ও চরিত্রের কৃতিত্ব বর্ণনা কর

শিবাজীর জীবন-কাহিনী ও চরিত্রের কৃতিত্ব বর্ণনা কর


শিবাজী


দক্ষিণ ভারতের পশ্চিমাঞ্চলে মহারাষ্ট্র দেশ। এই দেশ পশ্চিমে আরব সাগর থেকে পর্বে হায়দরাবাদ এবং উত্তর-পূর্বে নাগপুর পর্যন্ত বিস্তৃত। মহারাষ্ট্রের অধিবাসীদের মহারাষ্ট্রীয় বা মারাঠা বলে। মারাঠারা বীরের জাতি। দাক্ষিণাত্যের মুসলমান সুলতানরা মারাঠা সর্দারদের বড় বড় রাজকার্যে নিযুক্ত করতেন। তাঁদের বড় বড় জায়গির দেওয়া হত। যুদ্ধের সময় সুলতানেরা তাঁদের কাছে সৈন্য ও অর্থ সাহায্য গ্রহণ করতেন। 


শাহাজী নামক এক মারাঠা সর্দার প্রথমে আহম্মদনগরের সুলতানের অধীনে, পরে বিজাপুরের সুলতানের অধীনে জায়গিরদার ছিলেন। তাঁর এক পুত্রের নাম ছিল শিবাজী। পুণা জেলার অন্তর্গত শিবনের নামক পার্বত্য দূর্গে শিবাজীর জন্ম হয়েছিল। তাঁর মায়ের নাম ছিল জিজাবাঈ। শাহাজী বিজাপুরের রাজকার্য উপলক্ষে সদর কর্ণাটকে বাস করতেন, তাই তিনি দাদাজী কোল্ডদেব নামক এক বিদ্বান, ও বিচক্ষণ ব্রাহ্মণকে শিবাজীর অভিভাবক ও শিক্ষক নির্যক্ত করেছিলেন।


 তখনকার দিনে যুদ্ধই মারাঠাদের প্রধান বৃত্তি বা কাজ বলে গণ্য হত, লেখাপড়ার তেমন আদর বা মর্যাদা ছিল না। তাই শিবাজী পড়াশনার দিকে মন দিলেন না। শিকার, অশ্বারােহণ, মল্লযুদ্ধ প্রভৃতি যে সকল কাজে সাহস ও শক্তির দরকার হয় তাতে শিবাজীর খুব আগ্রহ ও উৎসাহ ছিল। রামায়ণ ও মহাভারতের গল্প শুনতে শুনতে তাঁর মনে সৈই যুগের বীরদের মতাে যুদ্ধক্ষেত্রে গৌরবলাভের ইচ্ছা জাগল মহারাষ্ট্র দেশে স্বাধীন হিন্দু রাজ্য স্থাপন শিবাজীর জীবনের উদ্দেশ্য হলো ।


কিন্তু বিজাপুরের অধীন একজন জায়গিরদারের ছেলের পক্ষে 'কটা স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করা সহজ কথা নয়। শিবাজী ধীরভাবে নিজের উদ্দেশ্য সিদ্ধির আয়ােজন করতে লাগলেন। তাঁর নায়কত্বে মাওলিজাতীয় কৃষকেরা নিপুণ যােদ্ধায় পরিণত হল। কয়েকজন দুঃসাহসী সহকমী সংগ্রহ করে তিনি এক ক্ষদ্র সৈন্যদল গঠন করলেন এবং চারিদিকে নগর ও গ্রাম লণ্ঠন করতে লাগলেন। ক্রমে ক্রমে বিজাপুরের সুলতানের অধীন কয়েকটি দূর্গ তিনি দখল করলেন। তখনও শাহাজী বিজাপুরের সুলতানের কর্মচারী ছিলেন। সুলতান পুত্রের অপরাধে পিতাকে বন্দী করলেন। শিবাজীর চেষ্টার ফলে সুলতান কিছুদিন পারে শাহাজীকে মুক্ত করে দিলেন।


এদিকে শিবাজীর সাহস ও ক্ষমতা ক্রমশ বাড়তে লাগল। তখন বিজাপুরের সুলতান স্থির করলেন যে, তাঁকে আর তুচ্ছ করা যায় না। শিবাজীকে দমন করবার জন্য তিনি আফজল খাঁ নামক এক প্রবীণ সেনাপতির অধীনে বহু সৈন্য-সামন্ত প্রেরণ করলেন। শিবাজী সম্মুখ যুদ্ধে প্রবৃত্ত না হয়ে এক দুর্ভেদ্য দুর্গে আশ্রয় নিলেন। আফজল খাঁ অনেক চেষ্টা করেও শিবাজীকে সে দুর্গ থেকে বাইরে আনতে পারলেন না তখন তিনি সন্ধির প্রস্তাব করলেন, শিবাজীও সম্মত হলেন। আফজল খাঁর সঙ্গে শিবাজীর সাক্ষাৎ হল। সাক্ষাৎকালে শিবাজীর অস্ত্রের আঘাতে আফজল খাঁ প্রাণ হারালেন। 


শিবাজী পূর্বেই সংবাদ পেয়েছিলেন যে তাঁকে কৌশলে হত্যা করাই আফজল খাঁর উদ্দেশ্য ছিল । তাই তিনি নিজের প্রাণ রক্ষার জন্য আফজল খাঁকে হত্যা করেছিলেন । সৈনাপতির আকস্মিক মৃত্যুর পর বিজাপুরের সৈন্যদল শিবাজীকে দমন করতে পারল না।


বিজাপুরের সুলতানের আক্রমণ ব্যর্থ করে শিবাজীর সাহস বেড়ে গেল । তিনি দাক্ষিণাত্যে মুঘল অধিকারভুক্ত স্থানগুলি লুণ্ঠন করতে লাগলেন। তখন শায়েস্তা খাঁ দাক্ষিণাত্যের মুঘল শাসনকতা। আওরঙ্গজেব শিবাজীকে দমন করৰার জন্য তাঁকে জরুরী নির্দেশ দিলেন। শায়েস্তা খাঁ পুণা এবং কল্যাণ অধিকার করলেন। হঠাৎ একদিন রাত্রিতে কয়েকজন বিশ্বাসী অনুচর নিয়ে শিবাজী শায়েস্তা খাঁর শিবিরে প্রবেশ করলেন। মুঘল সৈন্যদল আকস্মিক আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। শায়েস্তা খাঁ আহত হয়ে পলায়ন করলেন। পুণা শিবাজীর হস্তগত হল।


কিছুদিন পরে শিবাজী পশ্চিম ভারতের সর্বাপেক্ষা সমৃদ্ধ বন্দর সুরাট লণ্ঠন করলেন। তখন আওরঙ্গজেব সেনাপতি দিলীর খাঁ এবং অম্বরের রাজা জয়সিংহকে তাঁর বিরুদ্ধে পাঠালেন। জয়সিংহ শিবাজীকে পরাজিত করে সন্ধি করতে বাধ্য করলেন। শিবাজী মুঘল সম্রাটের অধীনতা স্বীকার করলেন এবং কয়েকটি দুর্গ মুঘলদের হাতে ছেড়ে দিলেন। অতঃপর জয়সিংহ বিজাপুর আক্রমণ করলেন। তখন শিবাজী তাঁকে সাহায্য করলেন।


মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে মিত্রতা স্থাপনের পর শিবাজী জয়সিংহের অনুরােধে সম্রাটের সঙ্গে দেখা করবার জন্য আগ্রায় গেলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর পুত্র শন্ডাজী, কিন্তু বাদশাহ দরবারে শিবাজীকে উপযুক্ত সম্মান দেওয়া হল না ; তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানালেন। তখন সম্রাটের আদেশে তাঁর বাড়ির চারদিকে প্রহরী মােতায়েন করা হল। শিবাজী দেখলেন যে তিনি বন্দী হয়েছেন। তখন মুক্তিলাভের জন্য তিনি এক অদ্ভুত উপায় অবলম্বন করলেন। অসুখের ভান করে তিনি কয়েকদিন চুপচাপ থাকলেন।


তারপর অসুখ আরােগ্য হয়েছে ঘােষণা করে তিনি আগ্রার বড় বড় লােকদের বাড়িতে  ঝুড়ি ঝুড়ি উপহার পাঠাতে লাগলেন।  প্রথম কয়েকদিন প্রহরীরা ঝুড়িগুলি পরীক্ষা করত; পরে সন্দেহ না হওয়ায় তারা আর পরীক্ষা করত না। একনি শিবাজী নিজে এক ঝুড়িতে বসলেন এবং আর এক ঝুড়িতে তাঁর ছেলেকে বসালেন। বাহকেরা ঝুড়ি নিয়ে শহরের বাইরে চলে গেল। তখন শিবাজী ঝুড়ি থেকে বেরিয়ে গােপনে দাক্ষিণাত্যে নিজের রাজ্যে ফিরে গেলেন।


কিছুকাল পরে শিবাজী মুঘলদের বিরুদ্ধে আবার যুদ্ধ আরম্ভ করলেন। মুঘলদের কয়েকটি দূর্গ তাঁর হতগত হল। তিনি আবার সুরাট বন্দর লুণ্ঠন করলেন। অবশেষে তিনি নিজেকে স্বাধীন রাজা র বলে ঘােষণা করলেন। রায়গড় তাঁর রাজধানী হল। তিনি ‘ছত্রপতি’ উপাধি গ্রহণ করলেন। ছয় বৎসর স্বাধীনভাবে রাজত্ব করবার পর মাত্র এই পঞ্চাশ বৎসর বয়সে তাঁর মৃত্যু হল। মৃত্যুর পূর্বে তিনি কর্ণাটকের কিয়দংশ এবং মহীশরের অধিকাংশ জয় করেছিলেন।


শিবাজী যে কেবল যুদ্ধই করতেন তা নয়; তিনি তাঁর রাজ্যের সুশাসনের জন্য সুন্দর ব্যবস্থাও করেছিলেন। শাসনকার্যে তাঁকে সাহায্য করার জন্য আটজন মন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁরা ‘অষ্টপ্রধান’ নামে পরিচিত ছিলেন। রাজস্ব আদায়ের সুবিধার জন্য রাজ্যটি কয়েকটি প্রান্ত বা প্রদেশে ভাগ করা হয়েছিল। উৎপন্ন শস্যের দুইপঞ্চমাংশ রাজকর রুপে নেওয়া হত। শিবাজী ‘চৌথ’ ও ‘সরদেশমখী’ নামে আরাে দু'প্রকারের কর আদায় করতেন। ‘চৌথ' অর্থ রাজস্বের এক-চতুর্থাংশ, আর সরদেশমুখী অর্থ রাজস্বের এক-দশমাংশ। এই কর মারাঠা-রাজ্যের বাইরে মুঘল শাসনাধীন অঞ্চল থেকে আদায় করা হত।


শিবাজী কঠোরভাবে সৈন্যদলে শৃঙখলা রক্ষা করতেন। তিনি কয়েকটি দুর্ভেদ্য দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর অবারােহী সৈন্যদল দুই শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। যে অশ্বারােহীরা সরকারী তহবিল থেকে বাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও পােশাক পেত তাদের ‘বারগীর' বলা হত। বাংলায় পরে তাদের বলা হত ‘বর্গী’। যারা নিজ নিজ বাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও পােশাক নিয়ে যুদ্ধ করত তাদের বলা হত ‘শিলাদার'। জলযুদ্ধের জন্য শিবাজী নৌবহর নির্মাণ করেছিলেন।


শিবাজী সাহসী, বুদ্ধিমান এবং ধর্মভীর ছিলেন। সাধারণ জায়গিরদারের ঘরে জন্মগ্রহণ করে তিনি বিজাপুরের সুলতান এবং দিল্লীর বাদশাহের সঙ্গে যুদ্ধ করে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। এই সাফল্যেই তাঁর অসীম সাহস ও রাজনৈতিক প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। 


তিনি তাঁর সৈন্যদের কখনও বালক, বৃদ্ধ ও স্ত্রীলােকের উপর অত্যাচার করতে দিতেন না। ধর্ম মন্দির ও ধর্মগ্রন্থের অবমাননা তিনি কখনও করেন নাই। তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে সারাজীবন যুদ্ধ করেছেন বটে, কিন্তু কখনও তাদের ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখান নাই। মসজিদের খরচ চালাবার জন্য তিনি নিষ্কর জমি দিয়েছিলেন। শিবাজীর বিরােধী মুসলমান লেখকেরাও তাঁর মহৎ চরিত্র এবং উদারতার প্রশংসা করেছেন।


শিবাজী মারাঠা জাতিকে নতন উৎসাহে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পরেও মারাঠারা তাঁর আদর্শ অনুসরণ করত। তাঁর পুত্র শম্পাজী আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে নিহত হন। কিন্তু আওরঙ্গজেব দীর্ঘকাল যুদ্ধ করেও মারাঠা জাতিকে বশে আনতে পারেন নাই।


শম্ভাজীর পুত্র শাহর রাজত্বকালে ‘পেশােয়া’ উপাধিধারী ব্রাহ্মণ মন্ত্রিগণ বিশেষ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠলেন। ক্রমে তাঁরাই মারাঠা-রাজ্যের প্রকৃত প্রভু হলেন। পেশােয়াদের আমলে এক বিরাট্‌ মারাঠা-সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। পরে ইংরেজদের সঙ্গে মারাঠাদের ক্রমান্বয়ে তিনটি যুদ্ধ ঘটে এবং মারাঠা-সাম্রাজ্যের পতন হয়।


খিস্টাব্দ 


১৬৫৮-১৭০৭ আওরঙ্গজেবের রাজত্বকাল। 

১৬৩০ শিবাজীর জন্ম  খিস্টাব্দ  

১৬৮০ শিবাজীর মত্যু 

১৮১৮ মারাঠা-সাম্রাজ্যের পতন: ইংরেজ কর্তৃকপেশােয়াদের রাজ্য অধিকার



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ