মুঘল চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য । মুঘল যুগের শিল্পের উন্নতি

মুঘল চিত্রকলার বৈশিষ্ট্য

মুঘল যুগে ভারত  

মুঘল সম্রাটদের শাসনকালে বিদেশ থেকে অনেক পর্যটক ভারতে ভ্রমণ করতে এসেছিলেন। এদের মধ্যে ফরাসী পর্যটক বারনিয়ে তা তেভারনিয়ে, ওলন্দাজ বণিক, ফ্রান্‌সিস্কো পে্‌লসার্ট, ইংরেজ ধর্মযাজক টেরি এবং ইংলন্ডের রাজদূত স্যার টমাস রাে—এই কয়েকজনের নাম বিশেষ প্রসিদ্ধ। এদের লেখা বিবরণী থেকে আমরা ভারতের সে-সময়কার অবস্থা সম্বন্ধে অনেক সংবাদ জানতে পারি। তবে একথা মনে রাখতে হবে যে বৈদেশিক পর্যটকেরা সাধারণত সম্রাটের দরবার এবং সাম্রাজ্যের বড় বড় লােকদের কথাই লিখেছেন। দেশের সাধারণ লােকের কথা, তাদের সুখ-দুঃখের কাহিনী আমাদের বিস্তৃতভাবে জানবার বিশেষ কোন উপায় নেই।


প্রাচীনকাল থেকেই বিদেশে ভারতের ঐশ্বর্যের কথা প্রচারিত ছিল। ভারতের ঐশ্বর্যে লুব্ধ হয়েই ভিন্ন ভিন্ন যুগে বিদেশীরা ভারতবর্ষ আক্রমণ করেছিল। মুঘল আমলে ভারতের সম্পদে আকৃষ্ট হয়ে ইউরােপীয় বণিকেরা এদেশে বাণিজ্য করতে এসেছিল। মুঘল আমলের শেষদিকে লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যে পারস্যরাজ নাদির শাহ, ভারত আক্রমণ করেন।


বিদেশী লেখকদের বিবরণে দেখা যায়, সম্রাট ও সভ্রান্ত আমীরওমরাহ্‌গণ কল্পনাতীত বিলাসিতার মধ্যে বাস করতেন। তার উৎসবাদিতে অজস্র অর্থ ব্যয় করা হত। সম্রাটের জন্মদিন আজ রাজধানীতে বিপুল উৎসব হত। প্রাচীন হিন্দু, রাজাদের অনুকরণে মুঘল সম্রাটেরা জন্মদিনে নিজেদের ওজনে সােনা প্রভৃতি মূল্যবান্‌ দ্রব্য প্রজাদের মধ্যে বিতরণ করতেন ব্যাবসায়ীদের অবস্থাও খুব সমৃদ্ধ ছিল। আরঙ্গজেবের রাজত্বকালে পশ্চিম ভারতের সুরাট বন্দরে বহু ধনবান্‌ ভারতীয় বণিক্‌ বাস করতেন। তাঁদের ধন সম্পদের লােভেই শিবাজী দুবার সুরাট লুণ্ঠন করেছিলেন।


আমির-ওমরাহ্‌ বণিক্‌ এবং মধ্যবিত্ত প্রজাদের আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল বটে, কিন্ত সমাজের নিম্নস্তরের লােকদের অবস্থা মােটের উপর খারাপ ছিল বলেই মনে হয়। রাজকর্মচারীরা প্রায়ই গরিব কৃষক এবংমজুর-মন্ত্রিদের উপর অত্যাচার করত। গরিব লােকদের অনেক সময় দুবেলা আহার জুটত না। দেশে মধ্যে মধ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দিত। তখন গরিবেরা খাদ্য সংগ্রহের জন্য ছেলেমেয়ে পর্যন্ত বিক্রয় করতে বাধ্য হত।


যাতায়াতের অসুবিধার জন্য দুর্ভিক্ষের সময় তাড়াতাড়ি এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় খাদ্যদ্রব্য চালান দেওয়ার সুব্যবস্থা করা সম্ভব হত না, তবে প্রজাদের কষ্ট লাঘবের জন্য শস্য না জন্মিলে রাজস্ব মুকুব করা হত। শাহজাহানের রাজত্বকালে একবার ভীষণ দুর্ভিক্ষে বহু লােক মারা যায়। শহরের লােকদের অবস্থা পল্লীগ্রামের লােকদের অবস্থার তুলনায় ভাল ছিল বলে মনে হয়। তবে পল্লীগ্রামের লােকেরা খাদ্য সম্বন্ধে অনেকটা স্বাবলম্বী ছিল, এবং তাদের অভাববােধ কম ছিল।


ফরাসী পর্যটক বানিয়ে বাংলা দেশের অর্থসম্পদের কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন। বাংলা থেকে বিভিন্ন স্থানে প্রচুর পরিমাণে ধান ও চিনি রপ্তানি হত। বাংলার রেশমী ও সুতী বস্ত্র তখন জগদ্বিখ্যাত ছিল। বানিয়ে বলেছেন, কেউ বাংলায় এলে আর বাংলা ছেড়ে যেতে চাইত না। আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে—চট্টগ্রামবিজয়ী শায়েস্তা খাঁ যখন বাংলার শাসনকর্তা তখন— টাকায় আট মণ চাল বিক্রি হত বলে প্রবাদ আছে। তবে একথা মনে রাখতে হবে যে ভারতবর্ষের মতাে বিশাল দেশের সকল প্রদেশের অবস্থাই এত সমৃদ্ধ ছিল না।

প্রতিষ্ঠিত 

এখন সুদুর পল্লীগ্রামেও সকলে সরকারের শাসন মেনে চলে, মুঘল আমলে কেবল বড় বড় শহরে বাদশাহি শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার তেমন ব্যবস্থা ছিল না। স্থানীয় রাজকর্মচারীরা অনেক সময় গরিবদের উপর অত্যাচার করতেন। তবে যুদ্ধের সময় সৈন্যদল কৃষকদের চাষের ক্ষতি করলে তাদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হত। পল্লীর শাসনভার জমিদার এবং পল্লীবাসীদের উপরই ন্যস্ত ছিল


মুঘল যুগের শিল্পের উন্নতি


ভারতে নানাবিধ শিল্পের উন্নতি হয়েছিল। শিল্প বিভাগে সুশিক্ষিত সরকারী কর্মচারী নিযুক্ত হত। সেকালে লাহোরের শাল, ফতেপুর সিক্রির গালিচা, গুজরাটের কাপাস কার্পাস বস্ত্র এবং ঢাকার মসলিন সুপ্রসিদ্ধ ছিল।


মুঘল যুগে সম্রাট এবং আমীর-ওমরাহগণের পৃঠপােষকতায় স্থাপত্য বিদ্যার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। দিল্লিতে হুমায়ুনের সমাধি ভবন, ফতেপুর সিক্রিতে আকবর কতৃক নির্মিত প্রাসাদ, আগ্রায় জাহাঙ্গীরের আমলে নির্মিত ইতিমদ্দৌলার সমাধি, আগ্রায় ও দিল্লিতে শাহজাহানের নিমিত প্রাসাদসমূহ মুগল যুগের স্মরণীয় কীর্তি । মুঘল সম্রাটেরা স্থাপত্য শিল্পের ন্যায় চিত্রশিল্পেরও বিশেষ অনুরাগী ছিলেন। আকবর এবং জাহাঙ্গীরের সময়ে এবং তাঁদের পঠপােষকতায় চিত্রশিল্পের বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে তাঁর পৃষ্ঠপােষকতার অভাবে শিল্পের অবনতি আরম্ভ হয়।


মুঘল যুগের স্থাপত্য উন্নতি


মুঘল আমলে সাহিত্য এবং বিদ্যাচর্চারও বিশেষ উন্নতি হয়েছিল। আকবর নিজে নিরক্ষর হয়েও বিদ্যার অনুরাগী এবং পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। ফৈজী, আবুল ফজল প্রভৃতির নাম পর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে। জাহাঙ্গীরের আত্মজীবনী ফারসী ভাষায় লেখা একখানি উৎকৃষ্ট গ্রন্থশাহজাহান এবং আওরঙগজেবের রাজত্বকালে ফারসী ভাষায় কয়েকটি উৎকৃষ্ট ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচিত হয়েছিল। প্রসিদ্ধ হিন্দি তুলসীদাস ছিলেন আকবরের সমসাময়িক। তাঁর লেখা ‘রামচরিতমানস’ কাব্যে রামায়ণের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। বাঙালী কবি কাশিরাম দাস এই যুগে ‘মহাভারত' রচনা করেন।



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ