ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিভাবে ভারতে বাণিজ্য বিস্তার করেছিল

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিভাবে ভারতে বাণিজ্য বিস্তার করেছিল
 

ভারতে ইউরােপীয় বণিক


অতি প্রাচীন কাল থেকে ভারতবর্ষের সঙ্গে ইউরােপের বাণিজ্য চলত। দুই হাজার বৎসর পূর্বেও ভারতবর্ষে তৈয়ারী নানারকম জিনিস সুদূর রােম সাম্রাজ্যে বিক্রয় হত। ভারতে উৎপন্ন মসলা, বস্ত্র প্রভৃতি পণ্যদ্রব্যের ইউরােপে খুব আদর ছিল। এক সময় আরব দেশের মুসলমান বণিকেরা এই সকল জিনিস ভারতবর্ষ থেকে ইউরােপে চালান দিত। সাড়ে-চারশত বৎসর আগে ইউরােপীয় বণিকেরা সাক্ষাৎভাবে ভারতবর্ষের সঙ্গে বাণিজ্য করতে উৎসক হল। দিল্লিতে তখন সুলতানী আমল চলেছে, বাবর তখনও ভারত বিজয়ের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন নাই।


ইউরােপ থেকে ভারতবর্ষে আসবার জলপথ আবিষ্কারের উদ্দেশ্যে প্রসিদ্ধ নাবিক কলম্বাস  স্পেন দেশ থেকে সমদ্রযাত্রা করেন। ঘটনাচক্রে তিনি আটলান্টিক মহাসাগর অতিক্রম করে এক নতুন মহাদেশে উপস্থিত হন। আমেরিকা আবিষ্কারক রূপে তাঁর কীর্তি চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। ভারতবর্ষে আসার জলপথ আবিষ্কার করলেন ভাস্কো -দা-গামা নামে পর্তুগালের এক নাবিক। আফ্রিকা মহাদেশের দক্ষিণপ্রান্তে অবস্থিত উত্তমাশা অন্তরীপ অতিক্রম করে ভারত মহাসাগরের মধ্য দিয়ে তিনি ভারতবর্ষের পশ্চিম উপকূলে কালিকট বন্দরে উপস্থিত হন। এখন ইউরােপ থেকে জাহাজ ভারতবর্ষে আসে সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে, কিন্তু ভাস্কো-দা-গামার সময় সুয়েজ খালের অস্তিত্বই ছিল না


ভাস্কো-দা-গামা নতুন পথের সন্ধান দেবার পর পর্তুগীজ বণিকেরা বাণিজ্য বিস্তারে প্রবৃত্ত হল। নানাস্থানে পর্তুগীজ বাণিজ্যপ্রতিষ্ঠিত হল। বাংলায় পর্তুগীজদের প্রধান কেন্দ্র ছিল হুগলীস্ম্রাট শাহজাহানের আদেশে হুগলীর পর্তুগীজ কুঠি ধংস করা ছিল। যশােহর, খুলনা, ঢাকা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, নােয়াখালি ইত্যাদি মগের বিভিন্ন জেলায় পর্তুগীজরা লুটপাট এবং নানারকম অত্যাচার করত। ভারতের পশ্চিম উপকুলে পর্তুগীজদের প্রতিপত্তি বিস্তার করেছিলেন আলবউকারক নামক এক শাসনকর্তা । এক সময়ে বোম্বাই পর্তুগীজদের অধীন ছিল। গােয়া, দমন এবং দিউ কয়েক বৎসর আগে পর্তুগালের অধীন ছিল। 


ভাস্কো-দা-গামার শতবর্ষ পরে ইউরােপের অন্যান্য দেশের বণিকেরাও ভারতবর্ষে বাণিজ্য করতে আরম্ভ করে। তখন এদেশে মুঘল সাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেইংরেজ এবং ওলন্দাজগণ (হল্যান্ডের অধিবাসী) এদেশে উপস্থিত হয় আকবরের রাজত্বের শেষভাগে। ফরাসীরা এল আওরঙ্গজেবের আমলে।


ভারতবর্ষে বাণিজ্য করবার জন্য কয়েকজন ইংরেজ বণিক্‌কে সনদ দিয়েছিলেন ইংলন্ডের রানী এলিজাবেথ। এই বণিকেরা সম্মিলিত হয়ে ‘ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি’ গঠন করেছিল। দেড়শত বৎসর পরে এই কোম্পানি ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের গােড়াপত্তন করে।

এলিজাবেথের পরে ইংলণ্ডের রাজা হয়েছিলেন প্রথম জেমস। তিনি ভারতে ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্যের সুবিধার জন্য সম্রাট্‌ জাহাঙ্গীরের দরবারে এক দূত পাঠিয়েছিলেন। এই দূতের নাম ছিল স্যার টমাস রাে। তিনি রাজপুতানার অন্তর্গত আজমীর শহরে বাদশাহের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি এদেশের যে বিবরণ লিখেছেন তা' পড়লে জাহাঙ্গীরের সময়ের অনেক কথা জানা যায়।।



সম্রাট্‌ শাহজাহানের সময়ে মাদ্রাজে ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠি স্থাপিত হয়। আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে ইংরেজ বণিকেরা পর্তুগীজদের নিকট থেকে বোম্বাই দ্বীপের অধিকার লাভ করে। পশ্চিম ভারতে তাদের প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল সুরাট। আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষভাগে জব চার্নক বর্তমান কলকাতা নগরীর গােড়াপত্তন করেন। এখানে ইংরেজেরা একটি দুর্গ নির্মাণ করে। তখন ইংলন্ডের রাজা ছিলেন তৃতীয় উইলিয়ম। তাঁর নাম অনুসারে কলকাতা দুর্গের নাম হল ‘ফোট উইলিয়ম। হুগলী, কাসিমবাজার (বহরমপুরের নিকটবতী), ঢাকা, মালদহ প্রভৃতি স্থানেও ইংরেজদের কুঠি স্থাপিত হয়েছিল।


বাংলায় এবং দক্ষিণ ভারতে ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফরাসী বণিকেরাআওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে মাদ্রাজের দক্ষিণে পণ্ডিচেরী নামক স্থানে এবং বাংলার অন্তর্গত চন্দননগরে ফরাসী বণিকেরা বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করেন। ভারত স্বাধীন হবার পর পণ্ডিচেরীতে ও চন্দননগরে ফরাসী-শাসন বিলুপ্ত হয়েছে


যতদিন মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি ও গৌরব ক্ষুগ্ন ছিল ততদিন ইউরােপীয় বণিকেরা বাণিজ্য করেই সন্তুষ্ট থাকত। কিন্তু আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর যখন মুঘল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়তে লাগল, তখন এদের মনে রাজ্যের লােভ জাগল। ভারতবর্ষ তখন ছিন্নবিচ্ছিন্ন ও দুর্বল হয়ে পড়েছে, রাজায়-নবাবে লড়াই চলছে। সকলেই চায় নিজের সুবিধা, দেশের স্বার্থ কেউ দেখে না। সেই দুর্দিনে ইংরেজ ও ফরাসী বণিকেরা ভারতে সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ করল। নানাকারণে ফরাসীরা যুদ্ধে পরাজিত হল—ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন হল।


ইংরেজ ও ফরাসীর মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার একটি প্রধান কারণ ছিল বাংলা দেশে বাণিজ্য করার অধিকার। সেকালে বাংলা দেশ কেবল যে কৃষিসম্পদে সমৃদ্ধ ছিল তা নয়, বাংলায় শিল্পেরও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। বিশেষত বয়ন শিল্পে বাঙালীর কৃতিত্ব অতুলনীয় ছিল। মা তৈয়ারী মস্‌লিনের মতাে সূক্ষ্মবস্তু অন্য কোন দেশে প্রস্তুত হত না। 


বাংলা দেশ থেকে কার্পাস এবং রেশম বােনা কাপড় প্রচুর পরিমাণে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হত। ইংলণ্ডের জনসাধারণ ভারতীয় বস্ত্র এত পছন্দ করত যে, ইংলন্ডে তৈয়ারী বস্ত্রের চাহিদা কমে গল। ইংলন্ডের ব্যাবসায়ীরা বিপন্ন হলতখন ইংলন্ডে আইনের সাহায্যে ভারতীয় বস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করা হল। ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার উৎপন্ন বস্ত্র কিনে ইংলন্ড ছাড়া ইউরােপের অন্যান্য দেশে চালান দিত।


ইংরেজ বণিকেরা বুঝেছিল যে বাংলার শাসনভার হাতে পেলে । তাদের বাণিজ্যের সুবিধা হবে, তখন তারা বাংলার বয়ন শিল্প ধবংস করে বাঙালীর কাছে বিলাতী কাপড় বিক্রয়ের সুযােগ পাবে। ফরাসীরা পরাজিত হল, বাংলার নবাব হলেন কোম্পানির হাতের পুতুল। তখন ইংরেজ বণিকের সেই সুযােগ এল। বাংলায় ইংরেজ-শাসন স্থাপনের পর পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যেই বাংলার বয়ন শিল্প ইংরেজের অত্যাচারে নষ্ট হয়ে গেল। 


তাঁতীরা বাধ্য হয়ে নিজেদের বৃদধাগুলি কেটে ফেলল, তাদের মস্‌লিন তৈয়ারি করবার সামর্থ্য থাকল না। ঢাকাই মস্‌লিন বিলাতে যাবার পরিবর্তে বিলাতের কলে তৈয়ারী মিহি কাপড় বাংলা দেশে আসতে লাগল। ম্যানচেস্টারের কাপড়ে বাংলার বাজার ছেয়ে গেল। পরাধীন বাঙালী ইংরেজ শাসকের নতুন ব্যবস্থায় দেশী কাপড় ফেলে বিদেশী কাপড় পরতে শিখল।

                  খিস্টাব্দ

১৪৯৮ ভাস্কো -দা-গামার কালিকটে আগমন 

১৫২৬ বাবর কতৃক মঘল সাম্রাজ্য স্থাপনা 

১৫৫৬-১৬০৫ আকবরের রাজত্বকাল

১৬০০ ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি গঠন

 ১৬০৫-২৭ জাহাঙ্গীরের রাজত্বকাল 

১৬১৫-১৮ স্যার টমাস রাে’র দৌত্য 

১৬২৭-৫৮ শাহজাহানের রাজত্বকাল

১৬৩১ মাদ্রাজে ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কুঠিস্থাপন

১৬৫৮-১৭০৭ আওরঙ্গজেবের রাজত্বকাল 

১৬৬১ ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বােম্বাই লাভ 

১৬৬৪ ফরাসীদের ভারতে বাণিজ্যের সূত্রপাত 

১৬৯০ জব চার্নক কতৃক কলকাতা স্থাপন 

১৭৫৭ বাংলায় ইংরেজ প্রভুত্বের সুত্রপাত


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ