পলাশীর যুদ্ধ কেন হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধ সম্পর্কে কি জান

 

পলাশীর যুদ্ধ কেন হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধ সম্পর্কে কি জান

সিরাজউদ্দৌলা ও মীরকাসিম পলাশীর যুদ্ধ ও বক্সারের যুদ্ধ

আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর দিল্লির মুঘল বাদশাহদের ক্ষমতা কমে গেল। সেই সুযােগে বিভিন্ন প্রদেশের শাসনকর্তারা প্রায় স্বাধীন হয়ে বসলেন। মুশিদকুলি খাঁ নামে আওরঙ্গজেবের এক বিশ্বস্ত কর্মচারী বাংলার শাসনকর্তা ছিলেন। নামে মুঘল সম্রাটের অধীন হলেও কার্যত তিনি দীর্ঘকাল স্বাধীনভাবে রাজ্যশাসন করেছিলেন। পূর্বে বাংলার রাজধানী ছিল ঢাকা। মর্শিদকুলি খাঁ মর্শিদাবাদে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। বাংলায় নবাবী আমলের আরম্ভ মুশিদকুলি খাঁর সময়ে, আর অবসান পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে।


মুর্শিদকুলি খাঁর মৃত্যুর কিছুকাল পরে বাংলার নবাবী অধিকার করেন আলিবদী খাঁ। তাঁর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারী হলেন তাঁর দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা। সিরাজের বয়স ছিল কম, শাসনকার্য সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা মােটেই ছিল না। অথচ তখন তাঁর ঘরে শত্রু, বাইরে শত্রু। আলীবর্দী খাঁর কন্যা ঘসেটি বেগম এবং দৌহিত্র পুর্ণিয়ার নবাব শওকত জঙ্গ সিরাজকে সিংহাসন থেকে সরাবার জন্য ব্যস্ত ছিলেন। 


নবাবী দরবারের প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে অনেকেই নতুন নবাবের বিরদ্ধে ছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন সেনাপতি মীরজাফর, ধনকুবের জগৎশেঠ, রাজা রাজবল্লভ প্রভৃতি। প্রজাদের উপর নানারকম অত্যাচার করে সিরাজ তাদেরও সহানুভূতি হারিয়েছিলেন। এই অবস্থার সুযােগ গ্রহণ করল। বাইরের শত্রু ইংরেজ। 


তখন দক্ষিণ ভারতে ফরাসীদের সঙ্গে ইংরেজদের যুদ্ধ চলছিল। ইউরােপীয় বণিকেরা আর শুধু, বাণিজ্য নিয়ে সন্তুষ্ট ছিল না, রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের জন্য তারা ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল। বাংলয়ে ইংরেজদের প্রধান কেন্দ্র ছিল কলকাতায়, আর ফরাসীদের কুঠি ছিল কলকাতার কাছাকাছি চন্দননগরে। 


ফরাসীদের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিজেদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য ইংরেজরা কলকাতার দুর্গ মেরামত করল, এ সম্বন্ধে নবাবের নিষেধ তারা গ্রাহ্য করল না। বে-আইনী বাণিজ্য করে তারা নবাবের রাজস্বের ক্ষতি করতে লাগল। তারা নবাবের অবাধ্য কর্মচারী রাজা রাজবল্লভের পুত্রকে কলকাতায় আশ্রয় দিল।


ইংরেজদের দুর্ব্যবহারে ক্রুদ্ধ হয়ে সিরাজ আকস্মিক আক্রমণে কলকাতা অধিকার করলেন। তখন মাদ্রাজ থেকে ইংরেজ সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ বাংলায় এসে নবাবী ফৌজকে তাড়িয়ে দিয়ে কলকাতা দখল করলেন। সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের সন্ধি হল। কিন্তু চতুর ক্লাইভ দেখলেন যে সিরাজ যতদিন নবাব থাকবেন ততদিন ইংরেজদের নানারকম অসুবিধা ভোগ করতে হবে। তিনি মীরজাফর, জগৎশেঠ প্রভিতির সঙ্গে নবাবের বিরদ্ধে ষড়যন্ত্রে যােগ দিলেন। স্থির হল যে সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করে মীরজাফরকে নবাৰী দিতে হবে।


ষড়যন্ত্রকারীদের সমস্ত আয়ােজন সমাপ্ত হলে ক্লাইভ তিন হাজার সৈন্য নিয়ে সিরাজের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। নবাবের সৈন্য-সংখ্যা ছিল পঞ্চাশ হাজারের বেশী। নদীয়া জেলার অন্তর্গত পলাশী গ্রামে যুদ্ধ হল। নবাবের সেনাপতি মীরমদন ও মােহনলাল প্রাণপণে যুদ্ধ করে মৃত্যুবরণ করলেন। কিন্তু প্রধান সেনাপতি মীরজাফরের আদেশে তাঁর অধীন সৈন্যেরা যুদ্ধে যােগ না দিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে রইল। নবাবের প্রধান সেনাপতির বিশ্বাসঘাতকতায় ক্লাইভের জয় হল পক্ষে মাত্র ১৮ জন নিহত এবং ৫৬ জন আহত হল। মীরজাফর নবাবের সর্বনাশ না করলে বাংলা বিদেশীর হাতে পড়ত না।


পলাশীতে পরাজয়ের পর সিরাজ ফিরে গেলেন মুরশিদাবাদে । সেখানে বিপদের সম্ভাবনা দেখে তিনি বিহারের যাত্রা করলেন। পথে এক বিশ্বাসঘাতক মুসলমান ফকিরের ষড়যন্ত্রে তিনি ধরা পড়লেন। মীরজাফরের পুত্র মীরনের আদেশে তাঁকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করা হল। বাংলার স্বাধীনতা সিরাজের র রক্তস্রোতে ডুবে গেল।


পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার নবাব হলেন মীরজাফর, কিন্তু আসল কতৃত্ব গেল ইংরেজের হাতে। মীরজাফর ছিলেন অকর্মণ্য, দেশ শাসন করবার যােগ্যতা তাঁর ছিল না। ইংরেজদের তিনি অনেক টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু অত টাকা রাজকোষে ছিল না। ইংরেজরা বিরক্ত হয়ে তাঁকে পদচ্যুত করে তাঁর জামাতা মীরকাসিমকে নবাবী দিল।


ইংরেজদের অনুগ্রহে নবাবি লাভ করে মীরকাসিম কোম্পানিকে সৈন্যদলের ব্যয় নির্বাহের জন্য বাংলার তিনটি জেলার (বর্ধমান, মেদিনীপুর, চট্টগ্রাম) জমিদারী স্বত্ব প্রদান করলেন। কিন্তু তিনি স্বাধীনচেতা ও কর্মদক্ষ পুরুষ ছিলেন, শাসনকার্যে ও বাণিজ্য সম্বন্ধে ইংরেজদের কতৃত্ব স্বীকার করতে মােটেই প্রস্তুত ছিলেন না।


কোম্পানির কর্মচারীরা ব্যক্তিগত বাণিজ্য সম্বন্ধে যে সকল বে-আইনী সবিধা ভােগ করত তাতে বাধা দিয়ে মীরকাসিম তাদের বিরাগভাজন হলেন। ইংরেজদের শক্তিকেন্দ্র কলকাতা থেকে দুরে থাকবার জন্য তিনি বিহারের অন্তর্গত মঙ্গেরে নতুন রাজধানী স্থাপন করলেন। নিজের সামারিক শক্তিবৃদ্ধির জন্য তিনি ইউরোপীয় প্রথায় নবাবী সৈন্যদলকে সুশিক্ষিত করলেন। মীরকাসিমের এই ব্যবস্থায় ইংরেজদের সন্দেহ বেড়ে গেল। তারা হঠাৎ পাটনা শহর দখল করার চেষ্টা করে প্রকাশ্য যুদ্ধের সূচনা করল।


মীরকাসিম সম্মুখ সংগ্রামে জয়লাভ করতে পারলেন না। পর পর কাটোয়া, ঘেরিয়া এবং উধুয়ানালার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে তিনি নিজের রাজ্য ছেড়ে পশ্চিমদিকে চলে গেলেন। এই দুর্দিনে তাঁর পাশে দাঁড়ালেন অযােধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা এবং দিল্লির মুঘল সম্রাট শাহ আলম। অবশ্য শাহ্‌ আলমের তখন কোন ক্ষমতা ছিল না, তিনি ছিলেন অযােধ্যার নবাবের আশ্রিত। বক্সারের যুদ্ধে মীরকাসিম ও সুজাউদ্দৌলার মিলিত বাহিনীও ইংরেজদের কাছে পরাজিত হল। সুজাউদ্দৌলা ও শাহ, আলম কোম্পানির সঙ্গে সন্ধি করলেন। মীরকাসিম পথের ভিখারী হয়ে  কয়েক বৎসর পরে প্রাণত্যাগ করলেন।


ইতিমধ্যে ইংরেজদের অনুগ্রহে মীরজাফর আবার মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু নবাবের আর কোন ক্ষমতা ছিল না, ঈস্ট  ইন্ডিয়া কোম্পানিই বাংলার প্রকৃত শাসনকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মীরকাসিম বাংলার স্বাধীন নবাবী রক্ষার শেষ চেষ্টা করেছিলেন।

         খিস্টাব্দ

১৭২৭ মশিদকুলি খাঁর মৃত্যু 

১৭৪০-৫৬ আলিবদী খাঁর শাসনকাল 

১৭৫৬-৫৭ সিরাজউদ্দৌলার শাসনকাল 

১৭৫৭ পলাশীর যুদ্ধ (২৩ জন) 

১৭৬০-৬৩ মীরকাসিমের শাসনকাল 

১৭৬৪ বক্সারের যুদ্ধ


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ