ছিয়াত্তরের মন্বন্তর–ওআরেন হেস্টিংস
পলাশীর যুদ্ধের পরে ক্লাইভ স্বদেশে ফিরে যান। কিন্তু বাংলা দশে নানারকম গোলযােগের কথা শুনে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ তাঁকে আবার বাংলার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে এদেশে পাঠিয়ে দেন। এবার তনি দিল্লির বাদশাহ, শাহ্ আলমের নিকট থেকে কোম্পানির নামে বাংলা, বিহার এবং উড়িষ্যার দেওয়ানির সনদ (অর্থাৎ রাজস্ব আদায়ের অধিকার) গ্রহণ করলেন। তারপর তিনি বাংলা দেশ শাসনের নতুন ব্যবস্থা করে আবার ইংলন্ডে ফিরে গেলেন।
কিন্তু বাংলা দেশে শান্তি স্থাপিত হল না। নবাবের কোন ক্ষমতা ছিল না, তাঁর কর্মচারীরা ইংরেজদের আশ্রয়ে থেকে প্রজাদের উপর অত্যাচার করতে লাগল। কিন্তু ঈস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানিও দেশ শাসনের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করল না। অনাবৃষ্টি ও কুশাসনের ফলে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ইতিহাসে এই দুর্ভিক্ষ “ছিয়াত্তরের মন্বন্তর' নামে পরিচিত। বাংলা ১১৭৬ সালে (১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে) এই দুর্ভিক্ষ ঘটেছিল। নিদারুণ খাদ্যাভাবে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ লােক প্রাণ হারিয়েছিল।
মুর্শিদাবাদ থেকে একজন ইংরেজ কর্মচারী লিখেছিলেন যে মৃতদেহের স্তূপ রাজপথ ঢেকে রেখেছে এবং লােকে ক্ষুধার জালায় মূতদেহ ছিঁড়ে খাচ্ছে। দুর্ভিক্ষের প্রায় কুড়ি বৎসর পরে বড়লাট লর্ড কর্নওয়ালিস বলেছিলেন যে, বাংলার এক-তৃতীয়াংশ জমি গভীর জঙ্গলে পরিণত হয়েছে এবং সেখানে বন্য জন্তু বাস করছে।
বাংলার এই ভীষণ দুর্দিনে কোম্পানির কর্মচারীরা লােকে প্রাণ বাঁচাবার জন্য কোন চেষ্টা করে নাই, বরঞ্চ তাদের মধ্যে অনেকে নানা কৌশলে চড়া দামে চাউল বিক্রয় করে লাভবান হয়েছিল। মুঘল আমলে দুর্ভিক্ষ হলে সরকারী খাজনা মকুব করা হত। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা মন্মান্তরের বৎসর আগের চেয়েও বেশী খাজনা আদায় করেছিল। সরকারী অত্যাচারে জনসাধারণের দুর্দশা বেড়ে গেল।
বাংলার দুরবস্থার সংবাদ পেয়ে কোম্পানির কর্তৃপক্ষ ওআরেন হেস্টিংসকে বাংলার শাসনকর্তা বা ‘গভর্নর’ নিযুক্ত করলেন। পরে ইংলন্ডের পার্লামেন্টের এক আইন অনুসারে হেস্টিংস ‘গভর্নর-জেনারেল’ উপাধি পয়েছিলেন। তিনি সুদীর্ঘ তের বৎসর কাল বাংলার শাসনকর্তার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর সময়েই ভারতে ব্রিটিশ সামাজ্য
প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
কোম্পানির কতৃপক্ষের আদেশে হেস্টিংস শাসনকার্যের নূতন স্বন্দোবস্ত করেছিলেন। নবাবের ক্ষমতা একেবারে বিলপ্ত হল। তিনি ইংরেজের বৃত্তিভােগী হলেন। কোম্পানি শাসনকার্যের সম্পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করল মুর্শিদাবাদের বদলে কলকাতা শাসনকার্যের কেন্দ্র হল। প্রতি জেলায় ইংরেজ কর্মচারী নিযুক্ত হল। গুরতর মকদ্দমার বিচারের জন্য কলকাতায় তিনটি প্রধান আদালত স্থাপিত হল। মুর্শিদাবাদের পতন এবং কলকাতার উন্নতি আরম্ভ হল। বাংলাবিহার-উড়িষ্যায় ইংরেজ-শাসন কায়েম হল।
কিন্তু কেবলমাত্র শাসনকার্যেই হেস্টিংসের মনােযােগ আবদ্ধ ছিল না। অযােধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌলা বক্সারের যুদ্ধের পর ঈস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনউগত মিত্র হয়েছিলেন। বর্তমান উত্তরপ্রদেশের উত্তরপশ্চিম অঞ্চলে তখন রােহিলা আফগান সর্দারেরা রাজত্ব করতেন। সুজাউদ্দৌলা রাজ্যলাভে তাঁদের সঙ্গে যুদ্ধে প্রবত্ত হলে হেস্টিংস কোম্পানির সৈন্য দ্বারা তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। এই সাহায্যের বিনিময়ে হেস্টিংস নবাবের নিকট থেকে কোম্পানির জন্য প্রচুর অর্থ আদায় করেন। কোম্পানির সাহায্যে বলীয়ান হয়ে সজাউদ্দৌলা রােহিলাদের রাজ্য অধিকার করলেন।
হেস্টিংসের সময়ে মারাঠাদের সঙ্গে কোম্পানির যুদ্ধ হয়েছিল। তখন বিশাল মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রধান নায়ক ছিলেন পেশােয়া। পুনায় পেশােয়াদের রাজধানী ছিল। পেশােয়া পরিবারের মধ্যে কলহের সুয়োগ নিয়ে ইংরেজরা পশ্চিম ভারতে কয়েকটি স্থান দখল করেছিল। এর ফলে যে যুদ্ধ আরম্ভ হয় তা' আট বৎসর চলেছিল। এই যুদ্ধে নবপ্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে শক্তিপরীক্ষা হল। মারাঠারা তখনও শক্তিশালী ছিল, তাই যুদ্ধের ফলে কোম্পানি বিশেষ লাভবান মারাঠা যুদ্ধের শেষদিকে হেস্টিংস মহীশূরের অধিপতি হায়দর আলির সঙ্গে যুদ্ধ আরম্ভ করেছিলেন।
হেস্টিংস এদেশে কতকগুলি অন্যায় কাজ করেছিলেন। মহারাজ নন্দকুমার নামক একজন উচ্চপদস্থ বাঙালী তাঁর বিরদ্ধে নকল মীরজাফরের পত্নীর নিকট থেকে ঘুষ নেওয়ার অভিযােগ এনেছিলেন। কিছুদিন পরে জালিয়াতির অভিযােগে নন্দকুমারের প্রাণদণ্ড হয়। সম্ভবত হেস্টিংসের বিরােধিতা করার জন্যই তাঁর এই চরম দণ্ড হয়েছিল।
অযােধ্যার নবাব পরিবারের সভ্রান্ত মহিলাদের উৎপীড়ন করে হেস্টিংস প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। অর্থলাভের জন্য তিনি বারাণসীর রাজা চৈৎসিংহকে পদচ্যুত করেন। এই সকল কারণে হেস্টিংস স্বদেশে ফিরে গেলে পার্লামেন্টে তাঁর বিচার হয়েছিল। বিচারে তিনি মুক্তিলাভ করেছিলেন, কিন্তু বিচার উপলক্ষে দীর্ঘকাল তাঁকে মানসিক উদ্বেগ ও অর্থকষ্ট ভােগ করতে হয়েছিল।
হেস্টিংস বিদ্যোৎসাহী ছিলেন। আরবী ও ফারসী ভাষা শিক্ষাদানের জন্য তিনি কলকাতায় মাদ্রাসা স্থাপন করেন। তাঁর সময়ে মনীষী স্যার উইলিয়ম জোন্স কলকাতায় ‘এশিয়াটিক সােসাইটি’ স্থাপন। করেন।
খিস্টাব্দ
১৭৫৭ পলাশীর যুদ্ধ
১৭৬৫ কোম্পানির দেওয়ানি লাভ
১৭৭০ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর
১৭৭২-৮৫ ওআরেন হেস্টিংসের শাসনকাল খিস্টাব্দ
১৭৭৪ রােহিলা যুদ্ধ
১৭৭৫ নন্দকুমারের ফাঁসি
১৭৭৫-৮২ প্রথম মারাঠা যুদ্ধ
১৭৮০-৮৪ দ্বিতীয় মহীশর যুদ্ধ
0 মন্তব্যসমূহ