ভারত ইতিহাসের উপাদান দেশীয় সাহিত্য, বিদেশি বিবরণী, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান, লিপির গুরুত্ব মুদ্রার গুরুত্ব, থাপত্য-ভাস্কর্য ও সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের নিদর্শন কি? দেশীয় সাহিত্য, বিদেশি বিবরণী, প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান , লিপির গুরুত্ব, মুদ্রারগুরুত্ব,

ভারত ইতিহাসের উপাদান দেশীয় সাহিত্য, বিদেশি  বিবরণী,প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান, লিপির গুরুত্ব মুদ্রার গুরুত্ব, থাপত্য-ভাস্কর্য ও সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের নিদর্শন  কি?


ভারত ইতিহাসের উপাদান :প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের উপর বিশেষ গুরুত্ব (Sources of Indian History : Specially the Archaeological sources):-



দেশীয় সাহিত্যঃ-

প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের মুখ্য ভূমিকা আছে। এইসব ধর্মগ্রন্থের মধ্যে চতুর্বেদ অর্থাৎ ঋক, সাম, যজুঃ, অথর্ব বেদ আর্যদের বিভিন্ন জীবনযাত্রা সম্পর্কে সম্যক ধারণা দেয়। এছাড়া বৌদ্ধ ও জৈন গ্রন্থের মধ্যে জাতক', ত্রিপিটক মহাবংশ’, দীপবংশ’, ‘দ্বাদশ অঙ্গ’, ‘জৈন কল্পসূত্র’, ‘জৈন ভাগবতী সূত্র ইত্যাদি  তৎকালীন ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে জানতে নানাভাবে সাহায্য করে।পতঞ্জলির ‘মহাভাষা’ ও পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী' দেশীয় সাহিত্য নানাভাবে হল ব্যাকরণ বিষয়ক ইতিহাসের দুটি আকরগ্রন্থ।জীবনী গ্রন্থগুলিরমধ্যে উল্লেখযােগ্য হল,কনিষ্কের সভাকবি অশ্বঘােষেরবুদ্ধচরিত’,(এটি ভগবান বুদ্ধের জীবনী), হর্ষবর্ধনের সভাকবি বানভট্টের হর্ষচরিত’ ও কাদম্বরী’, রামপালের সভাকবি। সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত’, হেমচন্দ্রের কুমারপাল চরিত’ প্রভৃতি। এছাড়া কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র, শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক’, সােমদেব ভট্টের কথাসরিৎসাগর কথামালা’, গুণাঢ্যের বৃহকথা’, প্রথম মহেন্দ্রবর্মনের ‘মত্তবিলাস প্রহসন’, কাশ্মীরি পণ্ডিত কলহণের রাজতরঙ্গিণী’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলিরও ঐতিহাসিক মূল্য অপরিসীম। তৎকালীন কাশ্মীরের ইতিহাস জানতে এটি একটি প্রামাণ্য রচনা সন্দেহ নেই।


বিদেশি  বিবরণীঃ-


গ্রিক, রােমান, চিনা, তিবৃতি, আরবি লেখক ও পর্যটকদের বিবরণী ভারতের ইতিহাস,জানতে নানাভাবে সহায়তা করেছে। ইতিহাসের 'জনক’হেরােডােটাসের লেখাইতিহাসমালা। (Histories) একটি আকর গ্রন্থ। মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা’,স্ট্রাবাের ভুগােল’ (খ্রিঃ পূঃ ৬৩-২১ অব্দ),সিসিলির বাসিন্দা ডায়ােডােরাসের ‘বিবলিয়ােথেকা হিস্টোরিকা’,প্লুটার্ক ক এর আলেকজান্ডারের জীবনী,জাস্টিনের ‘ এপিটোম’, পলিবায়াসের সাধারণ ইতিহাস,টলেমির ‘ভূগােল’ ইত্যাদি উল্লেখ্য। 

      খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে এক অজ্ঞাতপরিচিত গ্রিক নাবিকের লেখা ‘পেরিপ্লাস অফ দি ইরিথ্রিয়ান সি’ বা ‘ভারত মহাসাগরে ভ্রমণ' গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন বন্দর ও বাণিজ্যকেন্দ্র সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়। চিনা বিবরণীর মধ্যে ফা-হিয়েনের ‘ফো-কিয়াে-কি’ (৩৯৯-৪১১ এ খ্রিঃ) দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল জানতে সাহায্য করে। হর্ষবর্ধনের সময় আগত হিউয়েন ক সাঙ-এর ‘সিইউ-কি’ (৬৩০-৬৪৪ খ্রিঃ)। সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণকালে অলবেরুনি ভারতে আসেন ও ১০৩০ খ্রিঃ তার বিখ্যাত 'তহকক-ই-হিন্দ’ বইটি লেখেন। এটি প্রথম প্রামাণ্য ও নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনার উপাদান বলে স্বীকৃতি পেয়েছে।

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান :-


‘প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান’ বলতে বােঝায় খননকার্যের ফলে আবিষ্কত বিভিন্ন প্রকার উপাদান। প্রত্ন কথার অর্থ হল প্রাচীন। ইংরেজি ‘archaeolgy’ (প্রত্নতত্ত্ব) কথাটি গ্রিক শব্দ 'arkhaiologia' (অতীতের বস্তুসামগ্রীর চর্চা) থেকে এসে এই প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানকে কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন

() লিপি,

() মদ্রা,

() স্থাপত্য-ভাস্কর্য নিদর্শন এবং

() প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ।

লিপির গুরুত্ব :-


লিপি হল প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার একটি বিশ্বস্ত দলিল। এই লিপিআবার নানাপ্রকার— শিলালিপি', স্তম্ভলিপি’, তাম্রলিপি ইত্যাদি। লিপি উৎকীর্ণ বিদ্যাকে বলা হয় এপিগ্রাফি’ এবং লিপি অনুশীলনকে ‘প্যালিয়ােগ্রাফি’ (Palaeography) বলা হয়। ঐতিহাসিক ভি. এ. স্মিথ মন্তব্য করেছেন, “প্রাচীন লিপিগুলি ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবে অনেকখানি নির্ভরযােগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ। ”ঐতিহাসিক ড. রামশংকর ত্রিপাঠী একইভাবে উল্লেখ করেছেন, সাহিত্যের তুলনায় লিপির গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ সাহিত্যে পরিবর্তন আসে, কিন্তু লিপিতে তা সম্ভব নয়। সেই জন্যই ইতিহাস রচনার উপাদানরূপে লিপি এত গুরুত্বপূর্ণ। 

   প্রাচীন লিপি থেকে প্রধানত জানা যায়, ভারতীয় রাজাদের রাজ্যজয়, রাজপ্রশস্তি, রাজকাহিনি, ভূমিদান, ‘দেবদান’ বা ব্ৰহ্রদেয় অর্থাৎ ব্রাত্মণদের দান করা নিষ্কর জমি যার নাম অগ্রহার’, ভাষা, ধর্মবিশ্বাস, শাসন কাঠামাে ইত্যাদি) প্রাচীন কালে। বেশিরভাগ লিপি লেখা হত পালি, প্রাকৃত, কানাড়ি, সংস্কৃত, মালায়ালম, তামিল, তেলুগু। প্রভৃতি ভাষাতে। আনুমানিক ২৫০০ খ্রিঃ পূঃ লেখা ২০০০ সিন্ধিলিপি’র (Pictograph) আবিষ্কার হলেও লিপি বিশেষজ্ঞ ফাদার হেরাস বহু চেষ্টা করে আজও এই দুর্বোদ্ধ লিপির পাঠোদ্ধার করতে পারেননি। ভারতের প্রাচীনতম এই লিপির অন্তর্ভুক্ত বর্ণ বা অক্ষর সংখ্যা সম্ভবত ২৭০টি ছিল বলে পণ্ডিতদের অনুমান। মৌর্য সম্রাট অশােকের সময় ব্রাত্মী’ ও খরােষ্ঠী’তে লেখা শিলালিপি ও স্তম্ভলিপিগুলি মৌর্য ইতিহাস জানতে নানাভাবে সাহায্য করেছে। ১৮৩৭ খ্রিঃ স্যার জেমস প্রিন্সেপ কর্তৃক অশােকের লিপিসমূহের পাঠোদ্ধার হয়। সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেনের ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’, স্কন্দগুপ্তের “ভিতরি লিপি’, দ্বিতীয়  চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যের সভাকবি বীরসেনের ‘এরাণ শিলালিপি', চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলােকেশির ‘আইহােল প্রশস্তি’, শকরাজ রুদ্রদামনের গুজরাটের গিরনারের জুনাগড় লিপি’ (প্রাচীনতম সংস্কৃত ভাষায় লেখা লিপি), নয়নিকার নানঘাট শিলালিপি', গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর নাসিক প্রশস্তি’ ইত্যাদি থেকে তাদের নিজ-নিজ শাসন, রাজ্যজয় ও অন্যান্য কৃতিত্ব জানা যায়। প্রতিহাররাজ প্রথম ভােজরাজের ‘গােয়ালিয়র লিপি’, ব্যাকট্রীয় গ্রিক রাজা হেলিয়ােডােরাসের ‘গরুড়ধ্বজ লিপি’, গৌড়ের রাজা শশাঙ্কের ‘গঞ্জাম লিপি’, কনৌজ ও থানেশ্বরের অধিপতি হর্যবর্ধনের তাম্রশাসন’, ধর্মপালের ‘খালিমপুরের তাম্রলিপি’, সেন যুগের উমাপতি ধরের ‘দেওপাড়া প্রশস্তি’, কনিষ্কের সময়কার পেশােয়ার সম্পট লিপি ইত্যাদি প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অমূল্য আকর উপাদান। ভারতের বাইরে। এশিয়া মাইনর অঞ্চলে ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার অরেল স্টাইন খননকার্যের ফলে আবিষ্কার করেছেন, বােঘজ-কোই’ (Boghoz-Koi) লিপি (১৪০০ খ্রিঃ পূঃ)।

মন্তব্যঃ-


লিপি থেকে ভারতে আর্যদের আগমনের সময়কাল এবং আবিসিনিয়া, ব্যাবিলন, মেসােপটেমিয়ার সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতির অন্তরঙ্গতার কথা জানা যায়। আবার ইরানের পার্সেপলিশ নগরীতে প্রাপ্ত নকইরুস্তম’ শিলালিপি (৬০০ খ্রিঃ পূঃ) পারসিকদের উত্তর-পশ্চিম ভারতে রাজ্যবিস্তার সম্বন্ধে জানতে সাহায্য করে। এছাড়া ‘তেল-এল-আমরনা লিপি’, ‘রমমিনদেই লিপি’ ইত্যাদি প্রচীন ভারত সম্পর্কে জানতে নানাভাবে সহায়তা করেছে। রমেশচন্দ্র মজুমদারের মতে, “প্রাচীন ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস পুনর্গঠনে লিপির মূল্য অনেক বেশি।”


মুদ্রারগুরুত্ব:-


মুদ্রা থেকে রাজার নাম, রাজত্বকাল, বংশপরিচয়, প্রচলিত ভাষা, ধর্ম, সন,  তারিখ, দেবদেবীর মূর্তি, ধাতুর ব্যবহার, অর্থনৈতিক পরিচয় ইত্যাদি জানা যায়।ব্যাকটিরিয়ান ও সিথিয়ানদের রাজত্বকাল, রাজ্যসীমা ও রাজার নাম মুদ্রা থেকেই জানা যায়। কুষাণ, সাতবাহন ও গুপ্তরাজাদের সম্পর্কে জানতে মুদ্রা একটি প্রামাণ্য আকর। ইন্দো গ্রিকরজাদের তামা ও রুপার মুদ্রা, কুষাণদের স্বর্ণ ও রৌপমুদ্রা উল্লেখযােগ্য। তাম্র, ব্রোঞ্জ ও সিসার মুদ্রার গুরুত্ব অতুলনীয়। প্রথম চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায় লক্ষ্মীদেবীর মূর্তি, সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় বীণাবাদনরত মূর্তি’ থেকে তাঁদের ব্যক্তিগত রুচিবােধের পরিচয় জানা গেছে। পালযুগের নারায়ণী মুদ্রা’, ‘পুরাণ’, কপর্দক পুরাণ’,কড়ি’ইত্যাদি মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে। কনিষ্কের স্বর্ণমুদ্রায় যাঁড় ও শিবের মূর্তি পাওয়া গেছে। নিজেকে মহেশ্বর'ও বলেছেন। দক্ষিণ ভারতে প্রাপ্ত প্রচুর রােমান মুদ্রা থেকে ভারত-রােম বাণিজ্য সম্পর্কের কথা জানা যায়। ইতিহাসের একটা প্রধান দিক হল কাল (Time or period)। মুদ্রা থেকে যেসব সময়কাল জানা গেছে, তার মধ্যে ‘বিক্রম সম্বৎ’ (৫৮ খ্রিঃ পূঃ), কনিষ্কের শকাব্দ (৭৮ খ্রিঃ), প্রথম চন্দ্রগুপ্তের ‘গুপ্তাব্দ’ (৩২০ খ্রিঃ),হর্ষবর্ধনের হর্ষাব্দ (৬০৬ খ্রিঃ) ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য।

মন্তব্যঃ-


আর্যদের স্বর্ণমুদ্রা ‘মনা’ ও ‘নিষ্ক’ সাতবাহনদেরসিসার মুদ্রা ‘পেপাতিন এবং চোল রাজাদের স্বর্ণমুদ্রা ক্যাশু’। গুপ্ত যুগে ব্যাপকভাবে প্রচলিতস্বর্ণমুদ্রা থেকেই অন্যান্য তথ্য জানা গেলেও আর্থিক সমৃদ্ধির বড়াে প্রমাণ মিলেছে। ড. আর. সি. মজুমদার (Ancient India' গ্রন্থে) যথার্থই মন্তব্য করেছেন(“মুদ্রা রাজাদের নাম ও সংশ্লিষ্ট এলাকার শাসনকাল সম্পর্কে জানতে বিশেষভাবে সাহায্য করে।


থাপত্য-ভাস্কর্য ও সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের নিদর্শন :-


খননকার্যের ফলে মাটির নীচ থেকে যেসব কারুকার্যময় মন্দির, অট্টালিকা, মাটির ও পাথরের তৈরি বাসনপত্র, মূর্তি ও অন্যান্য শিল্পকার্য পাওয়া গেছে, তাকে থাপত্য-ভাস্কর্য শিল্পের নিদর্শন বলা হয়। শিল্প-সংস্কৃতি, ধর্ম, অর্থনীতি, সমাজ ইত্যাদির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে স্থাপত্য ভাস্কর্য নিদর্শনের ভূমিকা অতুলনীয়।প্রসঙ্গত খাজুরাহাে, কোনারক, লিঙ্গরাজ প্রভৃতি মন্দিরের শিল্পনিদর্শনের কথা উল্লেখযােগ্য। সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে আর্যযুগের কিংবা পরবর্তী কালের স্থাপত্য ভাস্কর্য শিল্পের তুলনামূলক আলােচনা করে। আমরা শিল্পের বিবর্তনের প্রকৃত পরিচয় পাই।


মন্তব্যঃ-


মহেনজোদারাে, হরপ্পা, তক্ষশিলা, সাঁচি, সারনাথ, হস্তিনাপুর, আলিগড প্রভৃতি স্থানে খননকার্যের ফলে বহু প্রাচীন শিল্পনিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের বােলপুরের কাছে অজয় নদের তীরে পাণ্ডুরাজার ঢিপি, উঃ ২৪ পরগনার চন্দ্রকেতুগড়, বেড়াচাঁপা, দঃ ২৪ পরগনার পিয়ালি নদীর তীরে ধােসা ও তিলপিতে, গােসাবায় এবং বর্ধমানের মঙ্গলকোটে খননকার্য চালিয়ে স্থাপত্য-ভাস্কর্য শিল্পের বহু নিদর্শন খুঁজে পাওয়া গেছে।সম্প্রতিকালে ইউনেস্কো (UNESCO)-র উদ্যোগে সাঁচি-সাতহারায় ১৪টি বৌদ্ধমঠ ও ৩২টি স্তূপ নতুন করে আবিষ্কার হয়েছে (১৯৯৫ খ্রিঃ)।







একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ