বৌদ্ধধর্মের মূল শিক্ষা ও তার প্রভাব (Main
teachings and impact of Buddhism):
জীবনীঃ-
বুদ্ধকে ‘শাক্যমুনি’ বলা হয়। কেউ বলেন ৫৬৬ খ্রিঃ পূঃ আবার কারও মতে ৫৬৩ খ্রিঃ পূঃ বুদ্ধের জন্ম হয়। সেই হিসাবে বুদ্ধের মৃত্যু ৪৮৬ খ্রিঃ পূঃ ও ৪৮৩ খ্রিঃ পূঃ-কে অনেকে চিহ্নিত করতে চান। তাঁর পিতা শুদ্ধোদন নেপালের তরাই অঞ্চলের চার কিমি. দক্ষিণে কপিলাবস্তুর নির্বাচিত ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন। তিনি শাক্য জাতির অন্তর্ভুক্ত। তাঁর মাতা দেবদাহের রাজকন্যা মায়াদেবী কপিলাবস্তুর লুম্বিনী । উদ্যানের শালকুঞ্জে ভ্রমণকালে বুদ্ধের জন্ম দেন। ‘গৌতম গােত্রে’ এক বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে তাঁর জন্ম হয়। উনত্রিশ বছর বয়সে তাঁর রাহুল নামে এক পুত্রসন্তান জন্মলাভ করে। এরপর ঝুদ্ধের গৃহত্যাগের ঘটনাকে বৌদ্ধগ্রন্থে ‘মহাভিনিষ্ক্রমণ’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ত্রিপিটকঃ-
ভগবান বুদ্ধের ধর্মমত পালি ভাষায় লেখাবৌদ্ধদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ “ত্রিপিটক’ থেকে জানা যায়। ত্রিপিটকের তিনটি ভাগ আছে—
(১) সূত্র পিটক (বুদ্ধের ধর্মোপদেশসমূহ),
(২) বিনয় পিটক (বৌদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের ও সংঘের নিয়মাবলি) ও
(৩) অভিধর্ম পিটক (বৌদ্ধধর্মের দার্শনিক তত্ত্বসমূহের আলােচনা) জাতক থেকে কিছু কথা জানা যায়।
(ক) ধর্মমত-এর মূলকথাঃ-
বাস্তববাদী ও সাম্যবাদী ধর্মবিপ্লবী বুদ্ধ বলতেন “সমুদ্রের জলের যেমন স্বাদ একটাই তা হল লবণাক্ত, আমার ধর্মের তেমনি একটি লক্ষ্য, তা হল মানুষকে দুঃখ থেকে মুক্ত করা।” এই দুঃখের কারণ অবিদ্যা এবং আসক্তি। নাস্তিক বুদ্ধ নৈতিকতা, অহিংসা, কর্ম, বিশ্বধর্ম ও বিশ্বভ্রাতৃত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। যাগযজ্ঞ, পশুবলি ধর্মীয় আড়ম্বর ও মূর্তিপূজায় তাঁর আস্থা ছিল না।
(খ) জগৎ দুঃখময়ঃ-
ঐতিহাসিক দামােদর ধর্মানন্দ কোশাম্বী বলেন, যেহেতু সব মানুষ দুঃখের অধীন, তাই আর্যসত্য সকলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এই আর্যসত্য চারটি--
(১) জগতে দুঃখকষ্ট আছে,
(২) দুঃখকষ্টের কারণও আছে,
(৩) এই দুঃখ নিবারণ করা সম্ভব এবং
(৪) দুঃখকষ্ট থেকে নিবৃত্তির পথ বা মার্গ আছে।
(গ) অষ্টাঙ্গিক মার্গঃ-
এই দুঃখ নিবৃত্তির মােট আটটি পথের কথা ভগবান বুদ্ধ উল্লেখ করেছেন,যা অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ (Eight fold Path) নামে পরিচিত। এই পথ বা মার্গগুলি হল—
(১) সৎ-চিন্তা,
(২) সৎকর্ম,
(৩) সৎবাক্য,
(৪) সৎ-জীবিকা,
(৫) সৎ-চেষ্টা,
(৬) সৎদৃষ্টি,
(৭) সৎ-সংকল্প এবং
(৮) সৎ বা সম্যক সমাধি।
এই আটটি পথ ঠিকভাবে কেউ অনুসরণ করে চললে পরম জ্ঞান বা প্রজ্ঞা লাভ হয়।ড. কোশাম্বী বলেন এই পথগুলি সামাজিক কল্যাণসাধনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য,বুদ্ধ প্রচারিত ‘পঞ্চশীল’ হল ব্যভিচার, মদ্যপান, মিথ্যাভাষণ, পরস্বপহরণ ও হিংসা থেকে দূরে থাকা।
বুদ্ধ সর্বদা মধ্যম পন্থা (Middle Path) অনুসরণের কথা বলতেন। তাই জৈনদের কঠোর কৃচ্ছসাধন ও তপস্যা এবং লােকায়ত চার্বাকদের অতিরিক্ত ভােগলিঙ্গাকে তিনি পছন্দ করতেন না। এই দুই-এর মাঝামাঝি পথ ছিল অষ্টমাগ, যা পালনের জন্য কঠিন তপস্যা বা ভােগ-বিলাসিতার দরকার ছিল না। এই আটটি পথকে তাই মধ্যপন্থা বা পালি ভাষায় ‘মঝ্ঝিম্’ বলা হত।
আত্মার চরম মুক্তি বা নির্বাণঃ-
সমস্ত জাগতিক আসক্তি ও দুঃখকষ্ট থেকে আত্মার চরম মুক্তিই হল ‘নির্বাণ। নির্বাণ অর্থ নিভে যাওয়া (to be defused)। এই তত্ত্বটি জন্মান্তরবাদ ও কর্মফলবাদের এক অনিবার্য কার্যকারণসূত্রে বাঁধা। কারণ জন্মালেই কর্ম করতে হয় এবং তার ফলভােগ এক জন্মে না হলে আবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। এইভাবে জন্মমৃত্যুর দুষিত চক্ৰবলয়ে মানবজীবন আবর্তিত হচ্ছে। আর নিয়ত দুঃখ-যন্ত্রণা বেড়েই চলেছে। তাই অষ্টমার্গের আদর্শ মেনে চললে জন্মমৃত্যু-আসক্তি-দুঃখ-কষ্ট থেকে চিরমুক্তি বা মােক্ষ বা নির্বাণ লাভ করতে পারে। তবে বৌদ্ধ গবেষক বি. এম. বড়ুয়া, নলিনাক্ষ দত্ত প্রমুখ মনে করেন নির্বাণতত্ত্বের স্বরূপ ও সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা বুদ্ধ দিয়ে যাননি |
বৌদ্ধধর্মের জনপ্রিয়তা বা প্রভাবঃ-
বৌদ্ধধর্মের প্রভাব বিস্তারের ও জনপ্রিয়তার পিছনে বহু কারণ বিদ্যমান।
(১) বৌদ্ধধর্মে ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞ, মন্ত্রতন্ত্র,উপনিষদের জটিল দার্শনিক তত্ত্ব ছিল না। তাই সাধারণ মানুষ এই ধর্মের বিশেষ অনুগামী হয়ে ওঠে।
(২) ভগবান বুদ্ধের সহজ, সরল উপদেশ,সৌম্য ভাবমূর্তি, চারিত্রিক শুচিতা ও গভীর আত্মপ্রত্যয় মানুষকে আকৃষ্ট করেছিল।
(৩) সব জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও সংকীর্ণতার বিরথে বৌদ্ধধর্ম যে নৈতিক ও সামাজিক কর্তব্য পালনের কথা তুলে ধরেছে, এককথায় ও অনবদ্য ঘটনা। গবেষক রিজ ডেভিডস, কোশাম্বী প্রমুখ এই সামাজিকতাকে বৌদ্ধধর্মে জনপ্রিয়তার আর একটি কারণ বলে মনে করেন।
(৪) এই ধর্মে মধ্যপন্থার অস্তিত্বে কারণে সংসারী মানুষ ও সাধু-সন্ন্যাসী সকলের কাছে তা গ্রহণযােগ্য হয়ে ওঠে।
(৫) তাছাড়া বুদ্ধের ধর্মপ্রচারের ভাষা সাধারণ মানুষের কথ্যভাষা—পালি ও প্রাকৃত হওয়ায় মানুষের মধ্যে সহজেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
(৬) বণিকরা (শেঠঠী) বৌদ্ধধর্মে জনপ্রিয়তায় বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল।
(৭) রাজানুকূল্য লাভও বৌদ্ধধর্মের স্বদেশে-বিদেশে জনপ্রিয়তার আর একটি বড়ো কারন। আশোক, কনিষ্ক, হর্ষবর্ধন, বাংলার পাল রাজারা বৌদ্ধ ধর্মের সাফল্যের জন্য সক্রিয় চেষ্টা করেছিলেন।
(৮) বিভিন্ন বৌদ্ধ সংগীতি অর্থ পন্ডিতের ধর্ম বিষয়ক আলোচনা সভার এক্ষেত্রে গুরুত্ব ছিল। প্রথম( রাজগৃহ), কালাশোক দ্বিতীয়( বৈশালীতে) অশোক তৃতীয় ( পাটলিপুত্রে)ও চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি করেছিলেন পুরুষপুরে (মতান্তরে কাশ্মীর বা জলন্ধরে)।
0 মন্তব্যসমূহ