বাংলার সেন রাজাদের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করো । বাংলার সেনরাজাদের রাজনৈতিক ইতিহাস, ব্রাহা-ক্ষত্রিয়, বখতিয়ার খলজির আক্রমণ, সেনবংশের পতন, লক্ষ্মণসেন ,বল্লালসেন , বিজয়সেন , নবম শ্রেণী

বাংলার সেন রাজাদের রাজনৈতিক ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করো ।


বাংলার সেনরাজাদের রাজনৈতিক ইতিহাস:-

উৎপত্তি:-

সেনদের আদি বাসভূমি কর্ণাটক বা মহিশূর বা দক্ষিণ ভারতে ছিল বলে অনেকের ধারণা। কর্ণাটকের রাজা বিক্রমাদিত্যের বঙ্গ অভিযানকালে (১০৬৮ খ্রিঃ) সেনাপতিদের অনেকে রাঢ়দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। বিশ্বসেনের পুত্র সামন্তসেন রাঢ়দেশে জন্মান। এই সামন্তসেনই সেনবংশের প্রতিষ্ঠাতা। সামন্তসেনের পুত্র হেমন্তসেন রাঢ়দেশে বা বর্ধমানে একটি স্বাধীন সামন্তরাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। 


        সেন রাজা


ব্রাহা-ক্ষত্রিয়ঃ-

হেমন্তসেনের পুত্র বিজয়সেন বাংলার শেষ পালরাজা মদনপালকে পরাস্ত করে মগধে স্বাধীন সেনবংশের প্রকৃত পত্তন ঘটান। সেনদের সম্পর্কে আর একটি কথা হল, সেনরা জাতিতে ‘ব্রাহা-ক্ষত্রিয়’। ১৮৮৫ খ্রিঃ বােম্বে গেজেটিয়ারে এ সম্পর্কে বলা হয়, পরশুরামের হাত থেকে বাঁচতে যেসব গর্ভবতী ক্ষত্রিয় রমণী নিজেদের ব্রাত্মণ বলে পরিচয় দিয়েছিলেন, তাঁদের গর্ভজাত সন্তানদের ব্রাহ্ ক্ষত্রিয়’বলা হয়। পালদের। পরবর্তীকালে এই ব্রাত্ম-ক্ষত্রিয় সেনরাজারা বাংলায় অনেকদিন রাজত্ব করেছিলেন। 

বিজয়সেন (১০৯৬-১১৫৮ খ্রিঃ) :-


হেমন্তসেনের পুত্র বিজয়সেন, সেন সাম্রাজ্যের। প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ‘দেওপাড়া প্রশস্তি’ ও ‘বিক্রমপুর তাম্রপট্ট’ থেকে জানা যায়, শূর বংশীয় এক রাজকন্যাকে বিবাহ করে তিনি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন। কলিঙ্গরাজ (ওডিশা) অনন্তবর্মা চোড়গঙ্গের সঙ্গে মিত্রতা করে সমগ্র রাঢ়ের উপর তিনি আধিপত্য স্থাপন। করেন। মিথিলার রাজা নান্যদেব, কৌশাম্বীর রাজা দবোরাপবর্ধন, কোটাটবীর রাজা বীরসেন ও বাংলার পাল রাজা মদনপালকে যুদ্ধে পরাস্ত করে সমগ্র গৌড়ের উপর তিনি প্রাধান্য স্থাপন করেন। তিনি পূর্বে ব্রক্ষ্মপুত্র থেকে পশ্চিমে কোশী ও গণ্ডক নদী। এবং দক্ষিণে কলিঙ্গ পর্যন্ত সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন। বিজয়সেন পশ্চিমবাংলার বিজয়পুর ও পূর্ব বাংলার বিক্রমপুরে মােট দুটি রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।

বল্লালসেন (১১৫৮-১১৭৯ খ্রিঃ) :-


বিজয়সেনের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র বল্লালসেন সিংহাসনে বসেন। তিনি রাঢ়, বারেন্দ্রি, মগধ, মিথিলা, বাগড়ি বা সুন্দরবন-মেদিনীপুর অঞল নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। তবে রাজ্যজয় অপেক্ষা রাজ্য-সংরক্ষণ । সংস্কৃতিবন্ধনে বল্লালসেন বেশি মনােযােগী ছিলেন। বেদ, স্মৃতিশাস্ত্র ও পুরাণে সুপণ্ডিত বল্লালসেন হিন্দুধর্মের আচার-অনুষ্ঠান বিষয়ে ‘দানসাগর’ ‘অদ্ভুতসাগর’ নামে দুটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। নবদ্বীপের শাসক বুদ্ধিমন্ত খানের নির্দেশে পণ্ডিত আনন্দ বল্লালচরিত’ নামে তাঁর জীবনীগ্রন্থ রচনা করেছিলেন। বল্লালসেন নিজের ইচ্ছায় ‘বল্লাল দিঘি’ ‘বল্লাল বাড়ি’ দিনাজপুরে তৈরি করিয়েছিলেন। মালদহের গৌড় নগরীটি তাঁর তৈরি, যা পুত্র লক্ষ্মণসেনের নাম অনুসারে পরে ‘লক্ষ্মণাবতী’ নামে পরিচিত হয়। শেষজীবনে বল্লালসেন গঙ্গার তীরে ধর্মকর্মের জন্য আশ্রম তৈরি করেছিলেন। কিন্তু তিহাসিক ড. নীহাররঞ্জন রায় বলেন, বল্লালসেন গোঁড়া রক্ষণশীল হিন্দু ছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কৌলিন্য প্রথা সামাজিক ভেদ ও অস্পৃশ্যতা বৃদ্ধির মূল কারণ ছিল। তাই ইতিহাসের কাঠগড়ায় আজও বল্লালসেনকে নানা অভিযােগে অভিযুক্ত করা হয়।

লক্ষ্মণসেন (১১৭৯-১২০৫ খ্রিঃ) :-


বল্লালসেনের পুত্র লক্ষ্মণসেন ৬০ বছর বয়সে সিংহাসনে বসেন। যৌবনে পিতামহ বিজয়সেনের শাসনকালে কামরুপ, কলিঙ্গ ও গৌড়। জয়ের ক্ষেত্রে লক্ষ্মণসেন তার সামরিক প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন। বৃদ্ধ বয়সে সিংহাসনে বসে তিনি একইভাবে সামরিক দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। এইসময় প্রয়াগ, পুরী ও বারাণসীতে তিনি বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করেছিলেন। কনৌজের গহডবাল বংশীয় রাজাকেও " তিনি পরাজিত করেছিলেন। নিজের সামরিক শক্তির প্রমাণস্বরুপ লক্ষ্মণসেন ‘গৌড়েশ্বর’ ‘অরিরাজ মর্দন শংকর’ উপাধি নিয়েছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি শৈব ছিলেন পরে বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত হয়ে ‘পরম বৈষ্ণব’ উপাধি নেন। তাঁর সভাকবির নাম জয়দেব। 

বখতিয়ার খলজির আক্রমণ:-


লক্ষ্মণসেনের রাজত্বকালের উল্লেখযােগ্য ঘটনা হল, কুতবউদ্দিন আইবকের প্রধান সেনাপতি ইক্তিয়ারউদ্দিন মহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাংলা ও বিহার আক্রমণ। 


সেনবংশের পতনঃ-


ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দিন সিরাজের লেখা ‘তাবকাৎই-নাসিরি’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১১৯৯ খ্রিঃ বখতিয়ার খলজির বাহিনী ওদন্তপুরী বিহারটি দুর্গ ভেবে ধ্বংস করে ও বহু বৌদ্ধ ভিক্ষুকে হত্যা করে। তারপর আরবি ঘােড়া বিক্রেতার ছদ্মবেশে ১৮ জন অনুচর নিয়ে বখতিয়ার খলজি মধ্যাহ্নভােজের সময় লক্ষ্মণসেনের রাজধানী নবদ্বীপের প্রাসাদে ঢুকেই অতর্কিতে আক্রমণ চালায় ১২০১ খ্রিস্টাব্দে। লক্ষ্মণসেন কোনােক্রমে নৌকাযােগে পূর্ববঙ্গের শ্রীহট্টের বিক্রমে পালিয়ে আসেন। এখানে ১২০৬ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করার পর তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর পুত্র কেশবসেন ও বিশ্বরুপসেন অযােগ্য হলেও ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তবে তারা উল্লেখযােগ্য কিছুই করতে পারেননি। তাদের মৃত্যুর পর ১২৬০ খ্রিঃ সেন রাজত্বের চিরপতন ঘটে ।









একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ