হর্ষবর্ধনের রাজ্যজয় ও শাসননীতির পৃথক পরিচয় দাও ।
হর্ষবর্ধন (৬০৬-৬৪৭ খ্রিঃ):-
হর্ষবর্ধন (জন্ম ৪ঠা জুন, ৫৯০ খ্রিঃ) ৬০৬ খ্রিস্টাব্দে থানেশ্বরের দায়িত্বভার গ্রহণ। করেছিলেন হর্ষবর্ধন সভাসদদের অনুরােধে ‘যুবরাজ শিলাদিত্য’ উপাধি নিয়ে থানেশ্বর ও কনৌজের সিংহাসনে বসেন। হর্ষবর্ধনের সিংহাসনারােহণকাল থেকে ‘হর্ষাব্দ’ (৬০৬ খ্রিঃ)) গণনা করা হয় হর্ষের আধুনিক জীবনীকার এম. এল. এটিংহাউজেন ও কে, এম. পানিক্কর বলেছেন, “তিনি উত্তর ভারতের সার্বভৌম শাসক।”
রাজ্যবিস্তারঃ-
সিংহাসনে বসেই তিনি একে একে পাঞ্জাব, রাজপুতানা, গুজরাট এমনকি নর্মদা । রি তীরবর্তী অঞ্চলগুলি জয় করেন। গুজরাটের বলভী রাজ্যের রাজা ধ্রুব সেনকেও পরাজিত করে তিনি গুজরাট জয় করেন। পঞ্চভারত’ অর্থাৎ পাঞ্জাব, কনৌজ (উত্তরপ্রদেশ), বিহার, ওড়িশা ও বাংলা তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। ঐতিহাসিক কে.এম. পানিক্করের মতে, কাশ্মীর ও নেপাল তার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। এরপর হর্ষবর্ধন দাক্ষিণাত্য বিজয়ে অগ্রসর হন (৬৩০-৬৩৪ খ্রিঃ)। কিন্তু চালক্যরাজ দ্বিতীয় পলােকেশির কাছে নর্মদা (রেবা) নদীর উত্তরতীব পরাস্ত হয়ে তিনি সে আশা ত্যাগ করেন। রবিকীর্তির আইহােল প্রশস্তিতে একথা ) আছে। হর্ষবর্ধন রাজ্যজয়ের পর ‘সকলােত্তরপথনাথ’ ও ‘উত্তরাপথনাথ’ উপাধি গ্রহণ করেছিলেন।
শাসনব্যবস্থাঃ-
অশােকের মতাে প্রজাদের সুবিধার্থে তিনিও সরাইখানা, বিশ্রামাগার, দাতব্য চিকিৎসালয় প্রভৃতি নির্মাণ করেছিলেন। মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের মতাে হর্ষবর্ধনের সাম্রাজ্যও কয়েকটি প্রদেশে বা ‘ভুক্তি’তে বিভক্ত ছিল। ভুক্তিগুলি কয়েকটি বিষয় বিষয়গুলি গ্রামে বিভক্ত ছিল। তাঁর সামরিক বাহিনী চারভাগে বিভক্ত ছিল—পদাতিক অশ্বারােহী, রথ ও হস্তী। সাধারণ সেনারা ‘বড়’ ও ‘ভট’ নামে পরিচিত ছিল। ১,০০,০০০ পদাতিক, ৪০,০০০ অশ্বারােহী ও ৬০,০০০ হস্তী। তার সেনাবাহিনীতে ছিল। হর্ষবর্ধনের রাজস্ব তিনভাগে ভাগ করা যায়—’বলি’, ‘ভাগ, ও ‘হিরণ্য’। বলি ও ভাগ ছিল কৃষিসংক্রান্ত রাজস্ব। ১/৫ বা ১/৬ অংশ শস্যকররূপে গৃহীত হত। কৃষক ও বণিকদের জন্য ‘হিরণ্য’ নামক আর একপ্রকার কর প্রচলিত ছিল।
৬৪৩ খ্রিস্টাব্দে কনৌজের ধর্মমহাসম্মেলনে হিউয়েন সাঙ আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। হর্ষবর্ধন বৌদ্ধ ধর্মাসক্ত হলেও পরধর্মসহিষ্ণু ছিলেন। তিনি প্রয়াগে কুম্ভমেলার আয়ােজন করেছিলেন। রাজধানী কনৌজে ছিল চণ্ডী ও মহাকালের মন্দির। হর্ষদের যুদ্ধে যাবার আগে নীললােহিতের (রুদ্র-শিব) পূজা করতেন। তাঁর সভাকবি বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’ (৬০৫ খ্রিঃ) ও ‘কাদম্বরী’ উল্লেখযােগ্য। হর্ষবর্ধন নিজেই লিখেছিলেন। ‘নাগানন্দ', ‘সংহিতা অঞ্জলি’, ‘ঐশ্বর্য মাধুরী’, ‘প্রিয়দর্শিকা’ ও ‘রত্নাবলী’ নামক নাটক। হর্ষবর্ধনের বাকি বইগুলি—‘পরমভক্তি’, ‘পুষ্প-ধর-দেবিকা’, ‘দেব-অর্ঘ্যম’, ‘দেব-অঞ্জলি’, ‘দেব পল্লভ’, চরণামৃতম’, ‘লাবণ্যভাণ্ডার। এছাড়া হর্ষ দুটি কবিতা—সুপ্রভাত স্তোতম’ ও অষ্টোমহােত্তর স্তোত্রম্’ লেখেন। নাটক ছাড়াও বাঁশখেরা’ ও ‘মধুবন’ তাম্রশাসন নিজহস্ত, স্বাক্ষর-সহ রচনা করে উৎকর্ষের পরিচয় দেন। হর্ষবর্ধনের পৃষ্ঠপােষকতায় সমসাময়িক শ্রেষ্ঠ শিক্ষাকেন্দ্ররূপে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড-এ পরিগণিত হয়েছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়। স্নাতােকোত্তরএই বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন দশ হাজার ছাত্রের জন্য এক হাজার পাঁচ শত শিক্ষক ছিলেন। বিশিষ্ট শিক্ষকদের মধ্যে প্রজ্ঞামিত্র, জিনমিত্র, স্থিরমতি, গণমতি, ধর্মপাল ও জ্ঞানচন্দ্র অন্যতম। তখন নালন্দার অধ্যক্ষ ছিলেন এক ব্রাত্মণ মহাথবির শীলভদ্র।* বানভট্ট লিখেছেন, “হন হরিণের কাছে তিনি ছিলেন সিংহের মতাে, সিন্ধু অঞ্চলের রাজা । কাছে তপ্তজ্বরের, গুজরাটের নিদ্রায় ব্যাঘাতকারী, গজহস্তী গারপতির কাছে ভীষণ । ব্যাধির মততা, ন্যায়নীতিহীন লাটদের কাছে দস্যুর মতাে এবং মালবের গৌরবলতা কাছে কুঠারের মতাে।” (বানভট্টের লেখা ‘হর্ষচরিত’ থেকে উদ্ধৃত
* হর্ষবর্ধনের দুটি ছেলে ছিলকল্যাণবর্ধন ও ভাগ্যবর্ধন।
* শীলভদ্র সমতটের রাজপুত্র হয়েও রাজ্য ছেড়ে যােগীর জীবন গ্রহণ করেছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ