কুষান রাজবংশের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আলোচনা করো। অথবা, কনিষ্কের কৃতিত্ব আলোচনা করো।
কুষাণ রাজশক্তির প্রতিষ্ঠা (Establishment of Kushana Royal Power):-
কুষাণদের পরিচয়ঃ-
তখনই আনুমানিক ১৬৫ খ্রিঃ পূঃ হিউং-ন জাতির আক্রমণে পরাস্ত হয়ে ইউ-চিরা অক্ষুনদীর তীরবর্তী স্থানে চলে আসে। এখানে বহুদিন বসবাসের পর যাযাবর বৃত্তি ত্যাগ করে তারা কৃষিকাজের সাথে যুক্ত হয়। এইসময়। কষাণরা পাঁচটি শাখায় বিভক্ত ছিল--কুই-সাং, কাও-ফু, হি-থুম, চুং-মো ও হিউ-মি।
রুজুল কদফিসঃ-
কুষাণদের নেতা ছিলেন প্রথম কদফিসেস বা কুজুল কদফিস। মিয়ায়ােস-এর পর। আনমানিক ৩০ খ্রিঃ পূঃ প্রথম কদফিসেস কুষাণদের নেতৃত্ব হাতে নিয়ে প্রথমে হিন্দুকুশ পর্বতের দক্ষিণে পার্থিয়দের পরাস্ত করেন। তারপর কাবুল, কান্দাহার, কাশ্মীর, পেশােয়ার " প্রভৃতি জয় করে কফিসেস কুষাণ সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেন। এইসময় তিনি ‘ওয়াং’ বা রাজা উপাধি নেন এবং নিজের নামে মদ্রা প্রবর্তন করেন। তিনি ৮০ বছরের বেশি বেঁচেছিলেন। প্রথম কদফিসেস-এর পর তাঁর। পত্র দ্বিতীয় কদফিস বা বিম কদফিসেস রাজা হন। তিনি ৬৫-৭৫ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।
প্রথম কনিষ্ক বা কনিষ্কের কৃতিত্বঃ-
বিম কদফিসের পর কনিষ্ক সিংহাসনে বসেন। তবে তাঁদের পরস্পর সম্পর্ক কী তা জানা যায়নি। কনিষ্ককে কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা বলা হয় কারণ তিনি আর্যাবর্তে রাজনৈতিক অনৈক্যের অবসান। ঘটিয়ে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করেছিলেন।
সিংহাসনারােহণঃ-
ড. ফার্গুসন, র্যাপসন, টমসন, ওল্ডেনবার্গ, ডি. সি. সরকার, বি. এন. মুখার্জি, এইচ. সি. রায়চৌধুরি প্রমুখ বলেন, ১৭৮ খ্রিঃ কনিষ্ক | সিংহাসনে বসেন এবং 'শকাব্দ’-এর প্রবর্তন করেন। এ. সি. ব্যানার্জির মতে, পশ্চিম ভারতের শক যুবরাজরা বহুদিন ধরে। * এই অব্দটি (সন) ব্যবহার করেছিলেন বলে একে ‘শকাব্দ’ বলে। অধ্যাপিকা লােহই জেন এই মতটি যুক্তিযুক্ত মনে করেন। ভারত সরকারও ৭৮ খ্রিঃ শকাব্দের তারিখ ও কনিষ্কের সিংহাসনারােহণের কালসীমা বলে স্থির করেছে। তিনি মােট ৪২ বছর রাজত্ব করেছিলেন।
কনিঙ্কের রাজ্যজয়ঃ-
কল্হণের 'রাজতরঙ্গিণী’র মতে কাশ্মীর, হিউয়েন সাঙ্-এর মতে গান্ধর ও পুরষপুর, চিনা ও বৌদ্ধ মতে অযােধ্যা, পূর্ব-ভারত ও পাটলিপুত্র, আলবেরুনির মতে আফগানিস্তান ও মধ্য-এশিয়া-র বহু অঞ্চল প্রভৃতি তার সাম্রাজ্যভুক্ত হয়েছিল। শকক্ষএপ নহপানকে পরাস্ত করে সৌরাষ্ট্র ও মালবের উপর তিনি আধিপত্য কায়েম করেন। মধ্যএশিয়ার কাশগড়, খােটান, ইয়ারখন্দ, সমরখন্দ জয় করেন। উত্তরপ্রদেশের গােরখপুর, গাজিপুর (সাঁচি ও মথুরা) তিনি নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। চিনের রাজা হাে-তি-র রাজত্বকালে (৮৯-১০৫ খ্রিঃ) কনিষ্ক চিনা সেনাপতি ‘প্যানচাও’-এর কাছে পরাস্ত হয়ে দেশে ফিরে দ্বিতীয়বার যুদ্ধযাত্রা করেন। এইসময় ‘প্যান-চাও’ এর পুত্রকে পরাস্ত করে সন্ধির জামিনস্বরুপ এক চিনা যুবরাজকে তাঁর রাজধানী পুরুষপুরে নিয়ে আসেন।*এখানে কনিষ্কের সভাকবি নাগসেনের উদ্যোগে ‘চতুথ বৌদ্ধ সংগীতি’ বসে। এর সবচেয়ে বড়াে গুরুত্ব হল হীনযান ও মহাযান পন্থার মধ্যে বিবাদের অবসান ও উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সমন্বয়সাধন ঘটে ও মহাযানপন্থা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়।
বৈদেশিক সম্পর্কঃ-
কনিষ্কের সময় ভারত-চিন ও ভারত-রােম সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়। ব্যাবসা-বাণিজ্য ও ধর্মপ্রচারের সুত্রে কনিষ্ক রােমান সম্রাট ট্রজানের (৯৮-১১৭ খ্রিঃ) সঙ্গে দূত বিনিময় করতেন। কনিষ্কের মধ্যে যে আন্তর্জাতিকতাবােধ গড়ে উঠেছিল তার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে তিনি ভারতীয় উপাধি 'মহারাজা’, পারসিক উপাধি 'রাজাধিরাজ' ও চিনা উপাধি ‘দৈবপত্র’ প্রভৃতি গ্রহণ করেছিলেন। চিন, মধ্যএশিয়া ও আফগানিস্তান-এর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে।
উত্তরাধিকারঃ-
এইভাবে কনিষ্ক অল্পকালের মধ্যে এক বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেছিলেন। তাঁর পরবর্তী বংশধর বাসিষ্ক, হবিষ্ক, দ্বিতীয় কনিষ্ক ও বাসুদেব একে একে সিংহাসনে বসেন বটে কিন্তু কুষাণ সাম্রাজ্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ে। কনিষ্ক শিল্প-স্থাপত্য ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপােষক ছিলেন। কাশ্মীরের কনিষ্কপুর নগরটি তিনি নির্মাণ করেন। রাজধানী পুরুষপুরকে তিনি সুসজ্জিত করেছিলেন।
সাংস্কৃতিক উন্নতির ধারকঃ-
এজিসেলস (Agesilaus) নামে এক গ্রিক শিল্পী তাঁর রাজসভায় ছিলেন। তাঁর সময় গ্রিক-রােমান ও ভারতীয় শিল্পের সমন্বয়ে গঠিত ‘গান্ধার শিল্প’ চরম উন্নতি লাভ করে। পণ্ডিত অশ্বঘােষ, বসুমিত্র, পার্শ্ব, নাগার্জুন, চরক তার রাজসভায় ছিলেন। এছাড়াকূটনীতিজ্ঞ মাথুর তাঁর সভা অলংকৃত করেছিলেন। ভারতের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় তক্ষশিলা তাঁর আমলে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছিল। কনিষ্কই প্রথম ভারতে ব্যাপকভাবে স্বর্ণমুদ্রা চালু করেছিলেন।
0 মন্তব্যসমূহ