মনসবদারি প্রথা এবং জায়গিরদারী সংকট সম্পর্কে আলোচনা করো।
মনসবদারি প্রথা (Mansabdari System):-
মনসবদারি প্রথা একটি পারসিক প্রথা। ১৫৭৭ খ্রিঃ সম্রাট আকবর প্রথম এই প্রথার প্রবর্তন করেছিলেন। এ. জে. কাইজার বলেন, সরকারি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আকবর প্রথম মনসব প্রথা চালু করেন। ড. গৌতম ভদ্র, এম. আতাহার আলি, ইস্তিয়ার্ক হােসেন কুরেশি, ড. ইরফান হাবিব প্রমুখ এই প্রথার ক্রমবিবর্তনের স্তরগুলির মধ্যে প্রাথমিকভাবে নিয়মানুবর্তিতা লক্ষ করেছিলেন। 'মনসব’ কথার অর্থ হল ‘সরকারি পদমর্যাদা’ (Govt. given rank)। এই প্রথার বেশিষ্ট্য হল—
মনসবের বিভিন্ন স্তর ও বৈশিষ্ট্যঃ-
(১) মােগল ইতিহাসে সামরিক ও বেসামরিক শাসনব্যবস্থার অঙ্গ হিসাবে ‘মনসবদারিপ্রথা’এক অধ্যায়-এর সূচনা করেছে সন্দেহ নেই। 'মনসব' প্রথার সঙ্গে যুক্ত সামরিক কর্মচারীদের বলা হয় মনসবদার'।
(২) সমগ্র মনসবদারি ব্যবস্থার কোন মনসবদার কতসংখ্যক সেনা ও অশ্ব সংরক্ষণ করবে, তা ঠিক করে দিতেন আকবর নিজেই কোনাে সৈনিকের একটি ঘােড়া থাকলে তাকে এক আসপা’, দুটি ঘােড়া মনসবের বিভিন্ন । স্তর ও বৈশিষ্ট্য।থাকলে দো-আসপা’, তিনটি থাকলে ‘শি-আসপা’ এবং দুজন সৈনিকের একটি ঘােড়া থাকলে তাকে 'নিম-আসপা’ বলা হত।
(৩) মনসবদারদের অশ্ব ও সৈন্যসংখ্যার উপর ভিত্তি করে সম্পূর্ণ মুনসবদারি ব্যবস্থাকে ৩৩টি স্তরে (grade) ভাগ করা হয়েছিল।সর্বনিম্ন স্তর হল ১০ এবং সর্বোচ্চ স্তর হল ১০,০০০। ভগবানদাস পেয়েছিলেন পাঁচহাজারি মনসব। রাজা মানসিংহের সাতহাজারি মনসবকে বাড়িয়ে দশহাজারি করা হয়েছিল।
(৪) ঔরঙ্গজেবের সময় তা বেড়ে ৪০,০০০ ও ৫০,০০০ পর্যন্ত হয়। প্রতিটি মনসবদার ‘জাঠ’ ও ‘সাওয়ার’ বাহিনী সংরক্ষণ করতেন।
(৫) কোনাে কোনাে মনসবদারকে নগদ অর্থে বেতনের ব্যবস্থা হলে এদের বলা হত। মনসবদার-ই-নগাদ’ | আবার কোনাে কোনাে মনসবদারকে বেতনের পরিবর্তে জায়গির দেওয়া হত। বংশানুক্রমিক জায়গিরকে ‘ওয়াতন জায়গির’ এবং স্থায়ী জায়গিরকে ‘তনখা জায়গির’ বলা হত। এইভাবে মনসবদারি প্রথার মধ্যে জায়গির প্রথার উন্মেষ ঘটেছিল।
জায়গিরদারি সংকট (Jagirdari Crisis):-
জায়গির প্রথার মূল কথা হল জমি। বেতনের পরিবর্তে জমি দানের ফলে এই প্রথা গড়ে ওঠে। মােগল সাম্রাজ্যের পতনের একটি প্রধান কারণ হল জায়গির দানের সংকট। জাহাঙ্গিরের সময় থেকে জায়গিরদারি সংকট তীব্র রুপ নিলেও ঔরঙ্গজেবের আমলে তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মনসবদারদের অনুপাতে জায়গিরদার সংখ্যা ঔরঙ্গজেবের আমলে বেড়ে হয় ৭০০০ থেকে ১৪,৪৪৯। ঐতিহাসিক জে. এফ. রিচার্ডসবলেন তিনি গােলকুণ্ডায় ঠিকভাবে জায়গির বণ্টন করলে হয়তাে এই সংকট দর হতসামরিক ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত মনসবদারি প্রথায় মনসবদারদের নগদে বেতনের পরিবর্তে জায়গির বা জমি প্রদান করা হত।
তখন জমির তিনটি ভাগ ছিল—জায়গির, খালিসা ও পাইবাকি। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের শেষের দিকে মনসবদারদের । সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে জায়গিরদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। অথচ জমি ‘গার্ডারের মতাে টেনে লম্বা করার উপায় ছিল না। ফলে একই জমিতে আগের তলনায় এখন সংখ্যা অনেক বেশি হয়। সবাই কৃষকের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কর আদায় করতে থাকেন।
সংকটের কারণঃ-
আধ্যাপক সৈয়দ নুরুল হাসান তাঁর ‘জায়গিরদারি ক্রাইসিস ইন্ মােগল ইন্ডিয়া’গ্রন্থে মটর চিত্রটি
সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন—
(১) 'তন্খা’ (৭৫% এই জায়গির) ও ‘ওয়াতন’ জায়গিরের মধ্যে বংশানুক্রমিক জায়গির (ওয়াতন)-এর সংকটকে আরও ভয়াবহ বলে মন্তব্য করেছেন। এছাড়াও ছিল ‘মাসরুত’ ও ‘ইনাম জায়গির’ যথাক্রমে বিশেষ পদমর্যাদা ও গুণীজনের জন্য দেওয়া হত। কারণ নির্দিষ্ট পরিমাণ জমিতে অনির্দিষ্ট পরিমাণ জায়গিরদারের উদ্ভব হয়ে ছিল।
(২) অস্থায়ী জায়গিরদাররা বিশৃঙ্খলময় দাক্ষিণাত্য অপেক্ষা উত্তর ভারতের বব জমির জায়গির পেতে ভিড় জমিয়েছিল।
(৩) তাছাড়া জায়গিরদাররা ‘জমা’ অর্থাৎ কাগজ-কলমের হিসাব ও ‘হসিল’-এর অর্থাৎ প্রকৃত আদায়ীকৃত রাজস্বের মধ্যে বিস্তর ব্যবধান সৃষ্টি করতেন। ফলে প্রকৃত রাজস্ব কোনােদিনই সরকারের কোশাগারে জমা হত না বা মনসবদাররা জানতে পারত না।
(৪) জমা ও হাসিলের মধ্যে কারচুপি ছাড়াও জায়গিরদান বা ভূমিবণ্টনের ব্যাপারে হিন্দুদের বঞ্চিত করার ফলে জায়গিরপ্রথা সংকটজনক হয়ে ওঠে।
(৫) ঐতিহাসিক সতীশচন্দ্র বলেন, বিতরণযােগ্য জমির স্বল্পতা ও জায়গিরপ্রার্থীর সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য জায়গিরদারি সংকট বৃদ্ধি পায়। এটিই মােগল সাম্রাজ্যের পতনে লক্ষণীয় ভূমিকা পালন করেছিল।
(৬) ড. হাবিব মনে করেন, জায়গিরদার ও ইজারাদারদের অমানবিক শােষণে মােগল সাম্রাজ্যের পতন ঘটে। ঐতিহাসিক এন. এ. সিদ্দিকি বলেন, জায়গির প্রথা থেকেই সামন্তপ্রথার উৎপত্তি ও আমলাতান্ত্রিক সামন্ততন্ত্র সংকটকে তীব্র করে তুলেছিল।
0 মন্তব্যসমূহ