বাংলায় কোম্পানির সঙ্গে নবাবের সম্পর্কঃ-
নবাব সিরাজ-উদ-দৌল্লার দাদু আলিবর্দির ১৬ বছর রাজত্বকাল একদিকে যেমন বাংলার ইতিহাসে সমৃদ্ধি দান করেছিল, তেমনি আবার ভাবী শাসকদের জন্য অনেক সমস্যাও রেখে গিয়েছিল। ১৭৫৬ খ্রিঃ এপ্রিল মাসে আলিবর্দির মৃত্যুর পর তার স্নেহের দৌহিত্র মাত্র একুশ বছর বয়সে বাংলার সিংহাসনে বসেন এবং মাত্র ১৫ মাস রাজত্ব করেছিলেন। তার এই স্বল্প শাসনকালে বাংলার ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা ঘটেছিল। স্বাধীনচেতা নবাব সিরাজের রাজত্বকালে। বাংলার ইতিহাসে শঠতা ও বিশ্বাসঘাতকতার নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। দূরদর্শী সিরাজ ইংরেজদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের পথে কাটা হয়ে দাঁড়ালে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য রূপ নেয়। পলাশির যুদ্ধের আগের বিভিন্ন জটিল পরিস্থিতির কারণ সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের সম্পর্ক তিক্ত করে তুলেছিল। প্রাক-পলাশি পর্বে সিরাজ ও ইংরেজদের পারস্পরিক মনােমালিন্যের বিভিন্ন কারণ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের পলাশির যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়া কোনাে প্রকারেই সম্ভব ছিল না। সিরাজ ও হংরেজদের মধ্যে সংঘর্ষের এই কারণগুলি হল :----
(১) দুর্গ নির্মাণঃ-
* দাক্ষিণাত্যে রাজনৈতিক দুর্বলতার সুযােগে ইংরেজ ও ফরাসি বণিকরা সুরক্ষার প্রয়ােজনে দুর্গ নির্মাণ শুরু করলে কেউ বাধা দেয়নি। তাই বাংলার ক্ষেত্রে ইংরেজ ও ফরাসিরা সিরাজের বিনা অনুমতিতে দুর্গ নির্মাণ যমু করলে সিরাজ জানতে পেরে অবিলম্বে দুর্গ নির্মাণের কাজ বন্ধ করতে বলেন।
(২) দন্তকের অপব্যবহারঃ-
১৭১৭ খ্রিঃ মােগল সম্রাট ফারুকসিয়ার বার্ষিক ৩০০০ টাকার বিনিময়ে ইংরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের লাইসেন্স বা ফরমান (Forman) বা দস্তক প্রদান করেন। অর্থাৎ ‘দস্তক’ হল এক রাজকী অনুমতি (royal permit)। পরে কোম্পানির কর্মচারীরা এই দস্তকের অপব্যবহারের মাধ্যমে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করে প্রচুর মুনাফা লুঠতে শুরু করে।
(৩) কলকাতা আক্রমণ ও অন্ধকূপ হত্যাঃ-
* ইংরেজদের আচরণে ক্রুদ্ধ সিরাজ ১৭৫৬ খ্রিঃ ২০ জুন কলকাতা আক্রমণ করেন। এইসময় তিনি ১৪৬ জন ইংরেজকে বন্দি করে একটি ১২ X ১৪ ফুট ঘরের মধ্যে আটকে রাখেন। পরের দিন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এর মধ্যে ১২৩ জন মারা যান। ইংরেজ ঐতিহাসিক হলওয়েল-এর মতে পরিকল্পিতভাবে সিরাজ। তাদের নির্মমভাবে হত্যা করেছিলেন। এই ঘটনা ‘অন্ধকূপ হত্যা’ (Black Hole Tragedy) নামে পরিচিত। কিন্ত অ্যানি বেশান্ত বলেছেন, হলওয়েল যে ঘরের পরিমাপের কথা বলেছেন তা ‘পাটিগণিত ও জ্যামিতির নিয়মে মিথ্যা’ বলে প্রমাণিত হয়। কারণ অত ছােটো। ঘরে ১৪৬ জন লােককে রাখা কোনােভাবেই সম্ভব নয়। ড. যদুনাথ সরকার বলেন, তখন কলকাতায় ১৪৬ জন ইংরেজ ছিল না। ৬০/৬৫ জন ইংরেজ থাকতে পারে। ঐতিহাসিক হলওয়েল কিন্তু সিরাজকেই এজন্য দায়ী করেছেন। যাইহােক সিরাজের কলকাতা আক্রমণের কথা শুনে রবার্ট ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসন মাদ্রাজ থেকে কলকাতা আসেন এবং ১৭৫৭ খ্রিঃ ২ জানুয়ারি কলকাতা পুনর্দখল করেন। সিরাজ শেষপর্যন্ত ৯ ফেব্রুয়ারি ‘আলিনগরের অপমানজনক সন্ধি’-র শর্ত মেনে নিতে বাধ্য হন। এই সন্ধির ফলে দস্তকের ব্যবহার ও দুর্গনির্মাণের অনুমতি দিতে সিরাজ বাধ্য হন।
পলাশির যুদ্ধ (১৭৫৭ খ্রিঃ):-
১৭৫৭ খ্রিঃ ২৩ জুন বৃহস্পতিবার নদিয়ার কাছে পলাশির আম্রকাননে সিরাজের ৫০,০০০ সৈন্যকে বাধা দিতে ক্লাইভ মাত্র ২,৫০০ সৈন্য নিয়ে এগিয়ে আসেন। মিরমদন ও মােহনলাল বীরবিক্রমে যুদ্ধ করলেও সিরাজের প্রধান সেনাপতি মিরজাফর পূর্বপরিকল্পনামতাে হঠাৎ যুদ্ধ থামিয়ে দিয়ে সবাইকে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। হতবাক নবাবি সেনারা যখন যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে শিবিরে ফিরছিল, ঠিক তখনই ক্লাইভের। সেনারা পিছন দিক থেকে আক্রমণ করলে সিরাজের সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে।
পলাশির যুদ্ধের গুরুত্বঃ-
ইংরেজ ঐতিহাসিক এস. সি. হিল মনে করেন সিরাজের অহমিকা ও অর্থের লােভ তাকে যুদ্ধে প্ররােচিত করেছিল। সিরাজহ পলাশির যুদ্ধের জন্য দায়ী ছিলেন বলে ঐতিহাসিক পি. ই. রবার্টসও মনে করেন। কিন্তু ড. ব্রজেন গুপ্ত তা মানেননি। ম্যালেসনের মতে, “পলাশির যুদ্ধকে চূড়ান্ত মনে হলেও কখনও বড়াে যুদ্ধ হিসাবে গণ্য করা যায় না।”*
(১) বাংলা থেকে ভারতের রাজনীতিতে কোম্পানির উত্তরণ ঘটেছিল পলাশির যুদ্ধের দ্বারা।
(২) সিরাজ-উদ-দৌল্লার স্থলে মিরজাফর বাংলার মসনদ লাভ করেন পূর্ববর্তী গােপন চুক্তি অনুসারে। ঐতিহাসিক পার্সিভ্যাল ম্পিয়ার ‘সিংহাসনের পশ্চাতে শক্তি’ (power behind the throne') এবং নবাবের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক ‘ছায়া ও কায়ার’ (Shadow and substance') বলেছেন।
(৩) যুদ্ধে জয়লাভের পুরস্কারস্বরুপ কোম্পানির কর্মচারীরা প্রত্যেকেই প্রচুর অর্থ পান। ক্লাইভ একাই তিন লক্ষ টাকা পুরস্কারস্বরূপ পেয়েছিলেন এবং বাংলার রাজকোশ থেকে এই অর্থ প্রদান করা হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখানাে হয়েছে বাংলা থেকে ১,৭৩,৯৬,৭৬১ টাকা ইংল্যান্ডে চলে গিয়েছিল পলাশির যুদ্ধের ঠিক পরেই। নতুন নবাবও নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন।
(৪) অর্থ ছাড়াও ২৪ পরগনার ভূখণ্ডটি ইংরেজরা লাভ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথায় “বণিকের মানদণ্ড পােহালে শর্বরী, দেখা দিল। রাজদণ্ডরূপে।” টমসন ও গ্যারেট-এর মতে শ্বেতাঙ্গ ইংরেজদের প্রাপ্তিলাভের এটাই বৃহত্তর এক ঘটনা (“the most paying game in the world”)। অ্যাডামস তাই পলাশির যুদ্ধকে ‘পলাশির লুণ্ঠন’ (Plassey Plunder) বলেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ