অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে আঞ্চলিক রাজন্যবর্গের সঙ্গে ইউরােপীয়দের সম্পর্ক (Relation of the Europeons with regional monarchs in the 1st half of the 18th Century):-
অষ্টাদশ শতক ইউরােপে যেমন বিপ্লবের যুগ ভারতে তেমনি ভাঙনের যুগ। বিশাল মােগল সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ায় বহু আঞ্চলিক স্বাধীন রাজ্য গডে ওঠে। যেমন বাংলা, হায়দ্রাবাদ, মহিশূর, অযােধ্যা, পাঞ্জাব, মারাঠা ইত্যাদি।
ফারুকসিয়ারের ফর্মানঃ-
১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মােগল সম্রাট ফারুকসিয়ারের (১৭১৩১৭১৯ খ্রিঃ) ফরমান লাভের পর ইংরেজ বণিকদের বাণিজ্যিক অগ্রগতি দ্রুত বাড়তে থাকে। সম্রাট ফারুকসিয়ার বার্ষিক ৩০০০ টাকার বিনিময়ে ব্রিটিশ প্রতিনিধি জন স্যারম্যানকে এদেশে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের ছাড়পত্র বা লাইসেন্স দিয়েছিলেন। 'এটাই ফারুকসিয়ারের ফর্মান’ নামে পরিচিত। এতে বলা হয় ---
(১) ইংরেজরা বিনাশুল্কে কলকাতায় কারখানা তৈরি করতে পারবে।
(২) এই ফরমান বা লাইসেন্স শুধুমাএ ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ব্যবহার করতে পারবে। (কিন্তু কার্যত কোম্পানির কর্মচারীরা তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যের জন্য তা অবৈধভাবে ব্যবহার করেছিল।)
(৩) শুধু বাণিজ্যিক নয়, রাজনৈতিক আধিপত্য ফরমানবলে ইংরেজরা লাভ করতে পারবে।
(৪) বার্ষিক ৩,০০০ টাকার বিনিময়ে কোম্পানি বিনাশুল্কে এদেশে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য করতে পারবে।
(৫) কোনােপ্রকার বাট্টা ছাড়াই। কোম্পানি মাদ্রাজি মুদ্রা বাংলাতে চালাতে পারবে।
(৬) অল্প কিছু টাকা দিয়ে কোম্পানি। কলকাতার কাছাকাছি ৩৮টি গ্রাম কিনে নিতে পারবে।
(৭) কোম্পানি মুর্শিদাবাদের টাকশালকে ইচ্ছামতাে কাজে লাগাতে পারবে।
(৮) আন্তর্জাতিক সুরাট বন্দরের কর্তৃপক্ষকে এককালীন ১০,০০০ টাকা দিলে যতদিন খুশি বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতে পারবে ইংরেজ কোম্পানি ।
(৯) কোম্পানির মালবাহী জাহাজে নবাবের লোকজন তল্লাশি করবে না।
(১০) কোম্পানির থেকে ধনী ব্যক্তিকে প্রয়ােজনে ইংরেজ কুঠিয়ালের হেপাজতে রাখা হবে।
(১১) দস্তককে কাজে লাগিয়ে হায়দ্রাবাদেও বিনা শুল্কে বাণিজ্য করা যাবে।
(১২) মােগল শাসিত দাক্ষিণাত্যে শুল্ক ছাড়াই বাণিজ্য করতে পারবে কোম্পানি তবে মাদ্রাজে এ নিয়ম বর্তাবে । এই কারণে সি. আর. উইলসন বলেছেন, ফারুকসিয়ারের ফরমান লাভ কোম্পানির কূটনৈতিক সাফল্যের একটা বড়াে দৃষ্টান্ত।
অর্থনীতিবিদ সব্যসাচী ভট্টাচার্য, ড. সুকুমার ভট্টাচার্য, ড. অমিয়কুমার বাগচি, ওর্মে (William Orme) প্রমুখ মনে করেন, এই ফরমান ছিল কোম্পানির বাংলা বাণিজ্যের ইতিহাসে এক ‘ম্যাগনাকার্টা (MagnaCarta)। তাই ব্রিটিশের এই ফরমানলাভকে ঐতিহাসিক সি. আর. উইলসন একটি কূটনৈতিক সাফল্য এবং বাংলায় ব্রিটিশ বাণিজ্যের ‘ম্যাগ্নাকার্টা’ বলে মন্তব্য করেছেন। ‘ম্যাগনাকার্টা’ একটি ল্যাটিন শব্দ। এর অর্থ হল যা যুগান্তসৃষ্টিকারী পরিবর্তনে সাহায্য করা। এরপর ব্রিটিশরা বন্দিবাসের যুদ্ধে (১৭৬০ খ্রিঃ) ফরাসিদের শােচনীয়ভাবে পরাস্ত করে। অদ্বিতীয় বাণিজ্যিক শক্তি হিসাবে গড়ে ওঠে। আর হতভাগ্য ফারুকসিয়ার সৈয়দ হােসেন। আলি ও সৈয়দ আবদুল্লার হাতে নিহত হন।
বাংলাঃ-
ঔরঙ্গজেব ১৭০০ খ্রিঃ মুরশিদকুলি খাঁকে (১৭১৭-১৭২৭) বাংলার। দেওয়ান নিয়ােগ করলে তিনি ক্রমশ স্বাধীন বংলার গােড়াপত্তন করেন। তখন বাংলার নবাব আজিম উস-শান এর সঙ্গে মুরশিদকুলির সুসম্পর্ক না থাকায় তিনি সদর দেওয়ানি কারযালয় ‘মকসুদাবাদে’ (তাঁর নামানুসারে মুরশিদাবাদ) স্থানান্তরিত করেন। তিনি বাংলার ‘মাল-জমিনি প্রথা’ (জরিপ করা) চালু করে বছরে ১ কোটি টাকা রাজস্বরূপে দাক্ষিণাত্যে মােগল সম্রাটকে পাঠাতেন। এই বিশ্বাসযােগ্যতার জন্য সম্রাট ফারুকসিয়ার তাঁকে দেওয়ানথেকে ‘সুবাদার বা নাজিম বা সিপাহসালার’ পদে উন্নীত করেন (১৭১৭ খি)। এই সময় হ্যামিলটন সাহেবের চিকিৎসায় সম্রাট আরােগ্য লাভ করেন বলে কোম্পানিকে বিনাশুল্কে বাণিজ্যের এক ‘ফরমান’ বা ‘ছাড়পত্র’ দেন মাত্র বার্ষিক ৩,০০০ টাকার বিনিময়ে। এটি ‘ফারুকসিয়ারের ফরমান’ নামে পরিচিত।
বাংলার রাজ্যবর্গের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন দলিল। ১৭২৭ খ্রিঃ মুরশিদকুলির মৃত্যুর পর তাঁরই জামাতা সুজাউদ্দিন (১৭২৭-১৭৩৯) বাংলা-বিহার-ওড়িশার সুবাদার হন। ১৭৩৯ খ্রিঃ তাঁর মৃত্যুর পর পুত্র সরফরাজ খাঁ (১৭৩৯-১৭৪০) সবাদার বা শাসক হলেও তাঁরই বিশ্বস্ত কর্মচারী বিহারের নায়েব আলিবর্দি খাঁ তাঁকে ‘গিরিয়ার’ যুদ্ধে পরাস্ত করে নবাবি মসনদ দখল করেন। তিনি ১৭৪০-১৭৫৬খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ওইসময় মারাঠি বর্গি দলের নেতা ভাস্কর পণ্ডিতের আক্রমণ থেকে বাংলাকে রক্ষাকরতে বার্ষিক ১২ লক্ষ টাকা 'চৌথ’ প্রদানের অঙ্গীকার করেন। তিনি বলতেন, “ইংরেজরা মৌমাছির জাতি, তাদের আঘাত করলে হুল ফোটায় আর তা না করলে মধু দেয়।” তাই তিনি ইংরেজদের প্রশ্রয় দিয়ে যে সমস্যাকণ্টকিত পরিস্থিতি তৈরি করেছিলেন,পরবর্তী নবাব সিরাজ-উদ-দ্দৌলার (১৭৫৬-১৭৫৭) পক্ষে তার সমাধান কঠিন হয়ে উঠেছিল। ফরমানের অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে পারস্পরিক তিক্ততা ও সংঘাত বেধেছিল। কিন্তু কোনােবারই এ ব্যাপারে সক্রিয় পদক্ষেপ কেউ নেননি সিরাজ ছাড়া। যদিও ফারমিংগার ‘ফিফথ রিপাের্টে’ অন্য কথা বলেন।*
হায়দ্রাবাদঃ-
নিজাম-উল-মুলক (আসল নাম-চিন কুলিজ খাঁ) আসফ-ঝা’ উপাধি নিয়ে হায়দ্রাবাদে স্বাধীন ‘নিজাম বংশের পত্তন ঘটান (১৭২৪ খ্রিঃ)। ১৭৪০ খ্রিঃ নিজাম নিজেকে স্বাধীন নবাব ঘােষণা করেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর (১৭৪৮) রাজনৈতিক অরাজকতার সুযােগে ইংরেজ ও ফরাসি শক্তি দক্ষিণ ভারতে প্রভাববিস্তার করে। হায়দ্রাবাদের অধীন কর্ণাটকের (রাজধানী আর্কট) নবাব দোস্ত আলির মৃত্যুর (১৭৪৩) পর নিজামের অনুগত আনােয়ারউদ্দিন ও মৃত নবাবের জামাতা চাঁদ সাহেবের মধ্যে উত্তরাধিকার যুদ্ধ শুরু হলে ইংরেজরা মাদ্রাজে ও ফরাসিরা আর্কটের পন্ডিচেরিতে বাণিজ্যঘাঁটি গড়ে তােলে এবং ওই যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এইভাবে কর্ণাটকের যুদ্ধ অবশেষে ইঙ্গ-ফরাসি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পরিণত হয়।
অযােধ্যা ও মারাঠাঃ-
স্বাধীন অযােধ্যা রাজ্যটি গড়ে তোেলেন নবাব সাদাৎ খাঁ। শক্তিশালী নবাব সুজাউদ-দৌল্লা ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। মিরকাশিমের সঙ্গে তাঁর আঁতাত গড়ে ওঠায় বক্সারের যুদ্ধের পর (১৭৬৪) ‘এলাহাবাদের চুক্তির’ দ্বারা তাঁকে ৫০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। ইংরেজরা অযােধ্যার উপর আধিপত্য স্থাপন করেন। একইভাবে ১৭৩৫ খ্রিঃ কানহােজি আংরিয়ার সঙ্গে পাের্তুগিজদের বিরােধ
বেধেছিল। ১৭৩৯ খ্রিঃ তারা মারাঠা পেশােয়ার সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হলে আংরিয়ার ক্ষমতা হ্রাস পায়। এভাবেই ইউরােপীয়দের সঙ্গে দেশীয় রাজন্যবর্গের সংঘর্ষময় সম্পর্ক তৈরি হয়।
* "The Nawab was strong enough to prevent the Company realizing the principal objects which the imperial forman had been obtained." Firminger (Fifth Report),
0 মন্তব্যসমূহ