বৃক্ক (Kidney):-
অবস্থানঃ-
একজোড়া বৃক্ক মানুষের প্রধান রেচন অঙ্গ। বৃক্ক দুটি উদর গহ্বরের কটি অঞলের মেরুদণ্ডের দু-পাশে পেরিটোনিয়াম পর্দার নীচে অবস্থিত। বৃক্কের ঊর্ধ্বপ্রান্ত দ্বাদশ থােরাসিক কশেরুকার নীচে এবং নিম্ন প্রান্ত তৃতীয় লাম্বার কশেরুকার ওপরে অবস্থিত।
গঠনঃ-
বৃক্ক দুটি দেখতে অনেকটা শিম বীজের মতাে। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ মানুষের বৃক্কের ওজন 150 গ্রাম এবং স্ত্রীলােকের ক্ষেত্রে 135 গ্রাম হয়। বৃক্কের অবতল অংশের খাজটিকে হাইলাম (hilum) বলে, যেখানে গবিনী, বৃক্কীয় শিরা ও ধমনি সংলগ্ন থাকে।
1 রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে গেলে জন্ডিস রােগ হয়। রক্তে বিলিরুবিনের স্বাভাবিক পরিমাণ হল 0.2-1 mg/dl.
অন্তর্গঠনে বৃক্কের দুটি স্তর থাকে। কর্টেক্স বাইরের স্তরটিকে কর্টেক্স (cortex) এবং ভেতরের স্তরকে মেডালা (medulla) বলে। বৃক্কের মেডালায় কয়েকটি (10-15) বৃক্কীয় ধমনি পিরামিডাকার স্থান থাকে, তাদের বৃক্কীয় পিরামিড বলে। বৃক্কের পেলভিস অঞ্চলের সংকীর্ণ গহ্বরকে রেনাল সাইনাস বলে। এর মধ্যে গবিনী উন্মুক্ত থাকে। এই অঞ্চলে গবিনীর মুক্ত প্রান্ত মেজর ক্যালিক্স এবং মাইনর ক্যালিক্স-এ বিভেদিত।
বৃক্কের কাজঃ-
(i) মুত্র উৎপন্ন ও নিঃসরণ করা বৃক্কের প্রধান কাজ।
(ii) বৃক্ক দেহে লবণ ও জলের সাম্যতা বজায় রাখা,
(iii) রক্তের কয়েকটি উপাদানের পরিমাণ নির্দিষ্ট রাখা,
(iv) এরিথ্রোসায়েটিন ও প্রােস্টাগ্লান্ডিন নিঃসরণ করা ইত্যাদি কাজও করে।
মানবদেহের নেফ্রন (Human Nephron)
সংজ্ঞা (Definition):-
ম্যালপিজিয়ান করােসল ও বৃক্কীয় নালিকা নিয়ে গঠিত বৃক্কের গঠনমূলক ও কার্যমূলক একককে নেফ্রন বলে।
সংখ্যা (Number) :- মানুষের প্রতিটি বৃক্কে প্রায় দশ লক্ষ নেফ্রন ১ থাকে।
অবস্থান (Location):-
নেফ্রন প্রধানত বৃক্কের কর্টেক্স অঞ্চলে অবস্থিত। এদের মধ্যে 85% বৃক্কের কর্টেক্সের পরিধির দিকে অবস্থিত, এদের সুপারফিসিয়াল বা কর্টিক্যাল নেফ্রন (superficial or cortical nephron) বলে এবং 15% কর্টেক্সের ভিতরের দিকে অর্থাৎ মেডালা সংলগ্ন স্থানে অবস্থান করে। এদের জাক্সটামেডালারি নেফ্রন (juxta medullary nephron) বলে।
নেফ্রনের অংশ (Parts of Nephron):-
নেফ্রনের অংশগুলিকে ছকের সাহায্যে দেখানাে হল---
নেফ্রন
\/
------------------------------------------------------------
\/ \/
ম্যালপিজিয়ান করপাসল বৃক্কীয় নালিকা
\/ \/
ব্যোওম্যানস ক্যাপসুল পরসংবর্ত নালিকা
গ্লোমেরুলাস হেনলির লুপ
দুরসংবর্ত নালিকা
সংগ্রাহী নালিকা
নেফ্রনের গঠন (Structure of Nephron):-
গঠনগতভাবে একটি আদর্শ নেফ্রন দুটি প্রধান অংশ নিয়ে গঠিত, যথা—1. ম্যালপিজিয়ান করপাসল এবং 2. বৃক্কীয় নালিকা বা রেনাল টিউবিউল।
1. 40 বছর বয়সের পর প্রতি 10 বছরে 10 শতাংশ করে নেফ্রন অকেজো হয়ে পড়ে।
2. সংগ্রাহী নালিকা প্রকৃতপক্ষে, নেফ্রনের অংশ নয়।
(1) ম্যালগিজিয়ান করােসল (Malpighian corpuscle):-
এটি বৃক্কের কটেক্স স্তরে অবস্থিত নেফ্রনের সম্মুখপ্রান্ত। এটি 200 um ব্যাস সম্পন্ন এবং দুটি অংশে বিভেদিত, যথা— (i) ব্যোওম্যানস ক্যাপসুল এবং (ii) গ্লোমেরুলাস।
(i) ব্যোওম্যানস ক্যাপসুল (Bowman's capsule):-
এটি নেফনের সামনের দিকের ফানেল সদৃশ স্ফীত ও বদ্ধ প্রান্তবিশেষ। এটি গ্লোমেরুলাসকে কাপের মতাে আবৃত করে রাখে। এটি দুটি স্তর দিয়ে গঠিত, যথা—(a) ভিসেরাল স্তর (Visceral layer), যা ভিতরের দিকে অর্থাৎ গ্লোমেরুলাসের দিকে অবস্থান করে এবং (b) প্যারাইটাল স্তর (parietal layer), যা বাইরের দিকে অবস্থান করে। ভিসেরাল স্তরের কোশগুলি চ্যাপটা এবং অ্যামিবার মতাে, এদের পােডডাসাইট (podocyte) বলে।
উল্লেখ্য, ভিসেরাল স্তরের এপিথিলিয়াম এবং গ্লোমেরুলাস ক্যাপিলারির এন্ডাে থিলিয়াম সম্মিলিতভাবে পরিস্রাবণ ঝিল্লি (filtering membrane) গঠন করে।
(ii) গ্লোমেরুলাস (Glomerulus):-
এটি ব্যোওম্যান ক্যাপসুলের মধ্যে অবস্থিত এক প্রকারের রক্তজালকগুচ্ছ বিশেষ। অন্তর্মুখী ধমনিকা (afferent arteriole) ব্যোওম্যান ক্যাপসুলের মধ্যে প্রবেশ করে 0.5 মিলিমিটার দৈর্ঘ্য সম্পন্ন প্রায় 50টি রক্তনালিকায় বিভক্ত হয়ে রক্তজালকগুচ্ছ বা গ্লোমেরুলাস গঠন করে। রক্তনালিকাগুলি পুনরায় মিলিত হয়ে বহির্মুখী ধমনিকা (efferent arteriole) গঠন করে ব্যোওম্যান ক্যাপসুলের বাইরে আসে। অন্তর্মুখী রক্তনালি ছােটো ও প্রশস্ত (50 um' ব্যাসসম্পন্ন) এবং বহির্মুখী রক্তনালি দীর্ঘ ও অপ্রশস্ত (25 um ব্যাসসম্পন্ন)।
(2) বৃক্কীয় নালিকা (Renal tubule) :-
এটি ম্যালপিজিয়ান মােটা বাহু করপাসল-এর পরবর্তী প্রায় 35-50 মিলিমিটার দীর্ঘ নলাকার ও কুণ্ডলীকৃত অংশবিশেষ। এর ব্যাস সাধারণত 20-60 um নিম্নগামী পর্যন্ত হয়। এর অংশগুলি হল—সরু বাহু
(i) পরসংবর্ত নালিকা,
(ii) হেনলির লুপ,
(iii) দূরসংবর্ত নালিকা এবং
(iv) সংগ্রাহী নালিকা।
1 u মাইক্রন, um = মাইক্রোমিটার।
(i) পরসংবর্ত নালিকা (Proximal convoluted tubule) :-
এটি ব্যোওম্যান ক্যাপসুল সংলগ্ন 14 মিলিমিটার দৈর্ঘ্য সম্পন্ন অংশ। এর ব্যাস 57-60 um। এর প্রাচীর যুক্ত ঘনতলাকার (cubical) একক কোশস্তর দিয়ে গঠিত।
(ii) হেনলির লুপ (Henle's loop):-
এটি বৃক্কীয় নালিকার ‘U’ আকৃতিবিশিষ্ট অংশ, যা পরসংবর্ত ও দুসংবর্ত নালিকার মাঝখানে অবস্থান করে। এর দৈর্ঘ্য প্রায় 20 মিলিমিটার। এটি চারটি অংশে বিভক্ত, যথা—
(a) পুরু প্রাচীরবিশিষ্ট মােটা অধােগামী বাহু (thick walled descending limb),
(b) পাতলা প্রাচীরবিশিষ্ট সরু অধােগামী বাহু (thin walled descending limb),
(c) পাতলা প্রাচীরবিশিষ্ট সরু ঊর্ধ্বগামী বাহু (thin walled ascending limb),
(d) পুরু প্রাচীরবিশিষ্ট মােটা উর্ধ্বগামী বাহু (thick walled ascendinglimb)।
হেনলির লুপের সরু অংশের গড় ব্যাস 15 um এবং মােটা অংশের গড় ব্যাস 30 um। অধােগামী ও সরু ঊধ্বগামী বাহুর নালিগাত্র চ্যাপটা কোশস্তর দিয়ে এবং মােটা উর্ধ্বগামী বাহুর নালিগাত্র ঘনতলাকার কোশস্তর দিয়ে গঠিত।
(iii) দুরসংবর্ত নালিকা (Distal convoluted tubule) :-
এটি হেনলির লুপের পরবর্তী অংশ। এটি দৈর্ঘ্যে 5 মিলিমিটার এবং ব্যাসে 22-50 um হয়। এর প্রাচীর ঘনতলাকার কোশ দিয়ে গঠিত।
(iv) সংগ্রহী নালিকা (Collecting tubule);-
দূরসংবর্ত নালিকার শেষপ্রান্ত সংগ্রাহী নালিকায় প্রবেশ করে। এর প্রাচীর ঘনতলাকার কোশস্তর দিয়ে গঠিত। বিভিন্ন নেফন থেকে আগত কয়েকটি সংগ্রাহী নালিকা পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বেলিনির নালি (duct of Bellini) গঠন করে বৃক্কের সাইনাস গহ্বরে প্রবেশ করে।
# গ্লোমেরুলাস সন্নিহিত যন্ত্র (Juxta glomerulus apparatus):-
দূরসংবর্ত নালিকার সন্নিহিত যে অংশ গ্লোমেরুলাসের অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী রক্তনালির সঙ্গে মিলিত হয়, তাকে গ্লোমেরুলাস সন্নিহিত যন্ত্র বলে। এর মূল তিনটি উপাদান। হল—গ্লোমেরুলাস সন্নিহিত কোশ (J. G. cell), ম্যাকুলা ডেনসা' (Macula densa) এবং লেসিস কোশ (Lacis cell)।
ম্যাকুলা ডেনসা (Macula densa)- , দুরসংবর্তী সংবর্ত | bd 19 3 গ্লোমেরুলাস সন্নিহিত যন্ত্র এলকার যে অংশ অন্তর্মুখী ও বহির্মুখী ধমনিকার সংস্পর্শে থাকে, ওই অঞ্চলের নলাকার কোশগুলিকে সাধারণ । অণুবীক্ষণ যন্ত্রে কালচে বর্ণের দেখায়, ওই অঞ্চলকে ম্যাকুলা ডেনসা বলে।
নেফ্রনের কাজ (Functions of nephron) :-
নেফ্রনের প্রধান কাজগুলি হল----
(1) পরিস্রুতকরণ (Filtration):-
গ্লোমেরলাস পরা-পরিস্রাবকরূপে (ultrafilter) কাজ করে। এটি প্লাজমার কলয়েড পদার্থ ছাড়া অন্যান্য উপাদানগুলিকে পরিসুত করে ব্যোওম্যানের ক্যাপসুলের গহ্বরে প্রেরণ করে।
(2) পুনঃশােষণ (Reabsorption):-
বৃক্কীয় নালিকায় পরিত তরলের প্রয়ােজনীয় পদার্থগুলি (গ্লুকোজ, অধিকাংশ লবণ এবং প্রয়ােজনীয় জল) পুনরায় শােষিত হয়ে রক্তবাহে প্রবেশ করে। ADH বৃক্কীয় নালিকার (দুরসংবর্ত অংশে) জলের পুনঃশশাষণে সাহায্য করে। এই হরমােনের কম ক্ষরণে মূত্রের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং ঘন ঘন মূত্র ত্যাগ হয়। এই রােগকে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস বলে।
(3) টিবিউবুলার ক্ষরণ (Tubular secretion):-
বৃক্কীয় নালিকা কয়েক প্রকার দষিত পদার্থ, যেমন—নানারকম সালফারঘটিত যৌগ, ক্রিয়েটিনিন এবং কয়েকপ্রকার জৈব অ্যাসিড ইত্যাদি রক্তস্রোত থেকে নালিকার গহূরে ক্ষরণ করে।
(4) নতুন পদার্থ সৃষ্টি (Manufacture of new materials);-
বৃক্কীয় নালিকার এপিথিলীয় কোশে কয়েক প্রকার যৌগের, যেমন—অ্যামােনিয়া, হিপপিউরিক অ্যাসিড, বেঞোইক অ্যাসিড ইত্যাদি সৃষ্টি হয় এবং বৃক্কীয় নালিকা গহ্বরে মুক্ত হয়।
# নেফ্রনের বিভিন্ন অংশের কাজঃ-
(১) ম্যালপিজিয়ান করপাসলঃ-
পরা-পরিস্রাবকরূপে কাজ করে। নাইট্রোজেনঘটিত রেচন পদার্থসহ পী রক্ত গ্লোমেরুলাসে পরিশ্রুত হয়।
(2) বৃক্কীয়নালিকাঃ-
পরিশ্রুত তরলের প্রয়ােজনীয় পদার্থ এখানে পুনঃশােষিত হয়। গ্লুকোজ, অ্যামাইনাে অ্যাসিড এবং জল পরসংবর্ত নালিকায় ; জল, সােডিয়াম ও পটাশিয়াম আয়ন দুসংবর্ত নালিকায় এবং হেনলির লুপে জল ও সােডিয়াম আয়নের পুনঃশশাষণ ঘটে।
(3) সংগ্রাহী নালিকাঃ-
পরিশ্রুত ও পুনঃশােষিত তরল মূত্ররূপে এই অংশে সংগৃহীত হয়ে গবিনীতে প্রবেশ করে।
0 মন্তব্যসমূহ