স্বাধীন ভারতের গোড়া পত্তন
সিপাহীরা ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধ করে ভারত স্বাধীন করতে পারেনি। ভারতের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে বিনা যুদ্ধে শান্তিপূর্ণ উপায়ে। এই শান্তিপূর্ণ সংগ্রামে নেতৃত্ব করেছেন কংগ্রেস।
সিপাহী যুদ্ধের পূর্বেই বাংলা দেশে ইংরেজি শিক্ষার সূত্রপাত হয়েছিল। পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারে সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় সাহিত্য উন্নতি, সমাজ সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি দেশের কৃতী সন্তানদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়। বাংলাদেশ এই নতুন যুগের প্রবর্তন করেন রামমোহন রায়। পরে ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মাইকেল মধুসূদন দত্ত কেশব চন্দ্র সেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রভৃতি এই আন্দোলনের নেতৃত্ব করেন।
যে বছর সিপাহী বিদ্রোহ আরম্ভ হয় সেই বছর কলকাতা, মাদ্রাজ এবং মুম্বাইতে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। ক্রমে দেশের সর্বত্র ইংরেজি শিক্ষার প্রসার হতে থাকে, নানা স্থানে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়,। ধীরে ধীরে ভারতের ইংরেজি শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনে ইংরেজের স্বাধীনতা থেকে মুক্তি লাভের ইচ্ছা জেগে উঠলো। ইংরেজরা একেবারে ভারত ছেড়ে যাবে এমন আশা সেখানে কারো মনে হয়তো ছিল না। কিন্তু ভারতবাসীরা ক্রমে ক্রমে স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পাবে এটাই ছিল তখনকার নেতৃবৃন্দের দাবি।
এই দাবি ইংরেজ সরকারের কাছে পেশ করার জন্য সিপাহী বিদ্রোহের ২৮ বছর পরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। মুম্বাই শহরে কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন হয়। কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি ছিলেন শুদ্ধ বাঙালি ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইংরেজি শিক্ষিত ভারতবাসীদের সমর্থনে কংগ্রেস শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগলো। ফলে কংগ্রেসের সঙ্গে সরকারের বিরোধিতা আর সূত্রপাত হয়। কংগ্রেসের সভাপতির আসন থেকে দাদাভাই নওরোজি ঘোষণা করলেন যে ভারতবাসীকে স্বরাজ দিতে হবে।
সিপাহী বিদ্রোহের প্রায় ৫০ বছর পরে লর্ড কার্জন ছিলেন ভারতের বড়লাট। তখন বাংলাদেশ ছিল কংগ্রেসের কেন্দ্র। বাঙালিরা ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামে আগ্রহী। তাই লর্ড কার্জন বাঙালি জাতিকে দুর্বল করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে দুইভাগে ভাগ করলেন। পশ্চিমবঙ্গ বিহার এবং উড়িষ্যা নিয়ে নতুন বাংলা প্রদেশ গঠিত হলো আর একটি নতুন প্রদেশ গঠিত হলো পূর্ববঙ্গ ও আসাম। বাঙালিরা এই অন্যায় ব্যবস্থার তীব্র প্রতিবাদ করল। বঙ্গবিভাগ রোধ করার জন্য প্রবল আন্দোলন আরম্ভ হলো।
এই আন্দোলনের প্রধান নেতা হলেন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিপিনচন্দ্র পাল। সুরেন্দ্রনাথ কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা থেকেই এই জাতীয় সংগঠন এর অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন। বিপিন চন্দ্র উপলক্ষে সর্বভারতীয় নেতার মর্যাদা লাভ করেন। অরবিন্দ ঘোষ ও এই সময়ে জাতীয় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। পরে তিনি রাজনীতির ত্যাগ করে ধর্ম সাধনায় রত ছিলেন।
ইংরেজ সরকারকে ভারতের দাবি মেনে নিতে বাধ্য করার জন্য কংগ্রেসের নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল। বাংলাদেশ এই আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল। ইংরেজ বণিকরা ভারতে মাল বিক্রয় করে প্রচুর লাভ করত। তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ইংরেজ সরকার নানা উপায়ে ভারতের শিল্প বিনিষ্ট করেছিল।
সেই সকল শিল্প পুনরায় বাঁচিয়ে তোলা ছিল স্বদেশী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।ভারতের শিল্প বেঁচে উঠল ভারতে বিলাতি মালের চাহিদা কমে যাবে ইংরেজ বণিকদের ক্ষতি হবে। এদিকে ভারতের জনসাধারণ নিজেদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য নিজেদের উপর নির্ভর করতে শিখবে দেশের টাকা আর সাত সমুদ্র তেরো নদীর পার হয়ে বিদেশে চলে যাবে না। তাই বাঙালি কবি গান রচনা করেছিলেন।
“মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নেরে ভাই।”
স্বদেশী আন্দোলনের ফলে দেশীয় শিল্পের কিছু উন্নতি হয়েছিল। এদিকে বঙ্গবিভাগ রদের দাবি এত প্রবল হয়ে উঠল যে ইংরেজ সরকার লর্ড কার্জনের ব্যবস্থা বাতিল করতে বাধ্য হল। পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ সম্মিলিত হল আসাম পৃথক হলো বিহার ও উড়িষ্যা নিয়ে একটি ভিন্ন প্রদেশ গঠিত হলো। ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে নেয়া হলো। এতে কলকাতার রাজনৈতিক গুরুত্ব কমে গেল।
বঙ্গবিভাগ রদ হলো বটে কিন্তু কংগ্রেসের অন্যান্য দাবি মেনে নিতে ইংরেজ সরকার মোটেই প্রস্তুত ছিল না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংল্যান্ডের ধরে বিপদকালে ভারত বর্ষ নানাপ্রকার ইংরেজদের সাহায্য করল। কিন্তু প্রতিদানে তার স্বায়তব শাস্নের দাবি স্বীকার করা হলো না। নতুন শাসনতন্ত্র পরবর্তি ত হল, কিন্তু জনসাধারণের প্রতিনিধিদের অতি সামান্য ক্ষমতা দেয়া হলো। তখন স্বরাজ লাভের জন্য হিন্দু মুসলমান মিলিত হল, নতুন সংগ্রাম শুরু হলো।
এই সংগ্রামের নায়ক হলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনি ভারতবাসীকে নতুন রাজনীতি শিক্ষা দিলেন মানুষকে ভালোবাসা দ্বারা জয় করতে হবে পরম শত্রু কেউ হিংসা করা চলবেনা শান্তিপূর্ণ উপায়ে নিজের দাবি প্রচার করতে হবে তাদের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার সাধনা করতে হবে। প্রতিদিন মানুষের ধারণা ছিল যে পরাধীন জাতি কেবল যুদ্ধ ও রক্তপাত দ্বারাই স্বাধীনতা লাভ করতে পারে। গান্ধীজীর শিক্ষা দিলেন যে অহিংসা সংগ্রামের মধ্য দিয়েও স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব।
তিনি হিন্দু মুসলমানকে এক হতে বললেন পরের ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে শিখলেন সকল জাতীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রতি প্রচার করলেন। ক্রমে তার শান্তি ও অহিংসার বাণী ভারতের সীমান্ত অতিক্রম করে বিদেশে পৌঁছালো। তিনি বিশ্ব শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মানুষ বলে সারা বিশ্বের শ্রদ্ধা অর্জন করলেন।
গান্ধীজীর যুগে কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান নায়ক ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। তাকে দেশসেবার মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। দীর্ঘকাল কংগ্রেসের সঙ্গে যুক্ত থেকে সুভাষচন্দ্র দুবার এই জাতীয় প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হয়েছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন যে বিদেশি শাসকের সঙ্গে আপোস করা চলে না জাতির স্বার্থ ও মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখতে হলে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করতে হয়। ইংল্যান্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে ভারতবর্ষকে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন করায় সুভাষচন্দ্রের লক্ষ্য ছিল।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রথম দিকে পুলিশের দৃষ্টি এড়িয়ে সুভাষচন্দ্র কলকাতা থেকে আফগানিস্তানের পথে প্রথম রাশিয়ার এবং পরে জার্মানিতে গমন করেন। সেখান থেকে তিনি মালরে এবং মলয় থেকে ব্রহ্মদেশে উপস্থিত হন। তখন জাপানিরা মলয় ও ব্রহ্মদেশ থেকে ইংরেজদের বিতারিত করেছে। সুভাষচন্দ্র ইংরেজ বাহিনীর দলত্যাগী ভারতীয় সৈন্যদের সংগ্রহ করে আজাধীন ফৌজ বা ভারতীয় জাতীয় বাহিনীর গঠন করেন। ভারত বর্ষ থেকে ইংরেজদের তাড়াবার উদ্দেশ্যে এই বাহিনী আসামের পূর্ব সীমান্ত পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিল।
সুভাষচন্দ্র ছিলেন এই বাহিনীর পরম প্রিয় নেতাজী। গান্ধীজীর নয় নেতাজী ও হিন্দু মুসলমানের মধ্যে পৃথিবীর সম্বন্ধ করেছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজ ভারতের মধ্য বেশি দূরে প্রবেশ না করলেও এর সাহস ও ঐক্য সমগ্র ভারতে নতুন আশা জাগিয়েছিল। যুদ্ধের শেষ দিকে নেতাজি এক দুর্ঘটনায় মারা যান বলে সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল। নেতাজির স্বপ্ন সফল হয়েছে তার দেশ স্বাধীন হয়েছে তার বাণী দেশবাসীর মনে শক্তি সঞ্চার করেছে। প্রকৃতি ভারতের ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।
প্রায় ৩০ বছর কাল গান্ধীজী ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ছিলেন। এই কঠোর সংগ্রামের তার প্রধান সহকর্মী ছিলেন পন্ডিত জহরলাল নেহেরু সরদার বল্লভ ভাই প্যাটেল ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ও সরোজিনী নাইডু প্রভৃতি দেশ মান্য নেতৃবৃন্দ। বহু দুঃখ ভোগের পর এই অহিংস সংগ্রাম সফল হয়। ভারতে ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটল। দীর্ঘকাল পরে ভারতবাসীর পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করল।
স্বাধীন ভারতের নাগরিক তোমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করো জাতির জনক গান্ধীজি কে মুক্তি সংগ্রামের নায়ক নেতাজিকে আর সেই সকল শহীদকে যারা আত্বগুলি দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন।
খিস্টাব্দ
১৭৫৭ পলাশীর যুদ্ধ : ইংরেজ শাসনের সুত্রপাত
১৮৫৭ সিপাহী বিদ্রোহ : ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম
১৮৮৫ ভারতীয় জাতীয় সংগ্রেস থাপন
১৯০৫ বঙ্গবিভাগ
১৯২১, ১৯৩০-৩১ মহাত্মা গান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন
১৯৩৯-৪৫ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে
১৯৪২ মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত ছাড়' আন্দোলন
১৯৪৩-৪৫ নেতাজী কতৃক ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন ও পরিচালনা
১৯৪৭ ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ (১৫ অগস্ট)
১৯৪৮ মহাত্মা গান্ধীর তিরােধান (৩০ জানুআরি)
1 মন্তব্যসমূহ
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনী আমাদের সামনে তুলে ধরার জন্য অথর কে জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি নেতাজির বাণী পড়তে পারেন।
উত্তরমুছুন